
মানুষকে সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) হলেন আল্লাহ প্রেরিত নবী ও রাসূলগণের মধ্যে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। মানবজাতির সত্য পথের দিশারী মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্বশান্তির অগ্রদূত, মানবতার মুক্তিদূত—‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ ও ‘উসওয়াতুন হাসানাহ’।
আরব যখন চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, তখন সেই অন্ধকার যুগে হেদায়েতের আলোকবর্তিকা নিয়ে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মা আমিনার গর্ভে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শুভাগমন ঘটে। তাঁর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনের আলোকে তিনি অন্যায়, অবিচার ও অজ্ঞানতার অবসান ঘটান এবং মানুষকে পরিচালিত করেন ইসলামের সত্য ও ন্যায়ের আলোকিত পথে।
শান্তি, মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কেবল মুসলমান কিংবা আরবদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। তাই পবিত্র কুরআনে তাঁকে বলা হয়েছে ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি আপনাকে সমগ্র জাহানের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।” (সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭)
মানবজাতির শিক্ষকরূপে রাসূলুল্লাহ (সা.) একাধারে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী। তাঁকে সমগ্র মানবজাতির অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁর সব কথায় ও কাজে এই আদর্শের ছাপ স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একাধারে একজন আদর্শ পিতা, আদর্শ স্বামী, আদর্শ যোদ্ধা, আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক এবং আদর্শ ধর্মপ্রচারক।
তাঁর জীবন ও চরিত্র ইতিহাসে এত স্বচ্ছভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, তাঁর কথা ও কাজ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর পদক্ষেপ ও পদ্ধতি ছিল অনন্য। যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, রক্তপাত ও অরাজকতা দূর করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ভিত্তিতে তিনি একটি অনুপম, কল্যাণমূলক সমাজ গড়ে তুলেছিলেন।
ইসলামী জীবন বিধানের মূল উৎস হলো কুরআন, আর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন কুরআনি আদর্শের বাস্তব রূপায়ণ। এজন্য তাঁকে বলা হয় জীবন্ত কুরআন বা কুরআনের প্রতিচ্ছবি। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের জন্য রাসূলের জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” (সূরা আহযাব: ২১)
এই আদর্শ পনেরো শ বছর ধরে মানুষের জন্য এক অনন্য জীবনগঠনের উৎস হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর কর্ম, আচরণ ও উপদেশ দিয়ে মানুষকে শিখিয়েছেন কিভাবে আদর্শ জীবনযাপন করতে হয়, সুন্দর ও শান্তিময় সমাজ গড়া যায় এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কিভাবে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীকে শান্তিময় আবাসভূমি করা যায়।
প্রিয় নবীজি নিজের ছাগলের দুধ নিজে দোহন করতেন, নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন, ছেঁড়া জুতা নিজে ঠিক করতেন, এমনকি গৃহস্থালির কাজও করতেন। তিনি বিনয় ও সরলতার জীবন্ত প্রতীক ছিলেন। মেঝেতে বসতেন, দেহরক্ষী ছাড়াই বাজারে যেতেন। দরিদ্র জনগণ তাঁকে দাওয়াত দিলে তিনি তাঁদের সঙ্গে আহার করতেন এবং যা-ই দেয়া হতো, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে খেতেন।
এই গুণের কথা পবিত্র কুরআনের সূরা আত-তাওবা’র ৬১ নম্বর আয়াতে আছে—“তিনি সকলের কথা শোনেন, যে তাঁকে ডাকেন, তিনি তার ডাকে সাড়া দেন।”
মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রিসালাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছেন। নবুয়্যত লাভের পর রাসূল (সা.)-এর অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই কঠিন হয়ে পড়ে যে, কখনো কখনো মাসের পর মাস ঘরের চুলায় আগুন জ্বলেনি। তিনি পানি, খেজুর বা দুধ খেয়ে দিনাতিপাত করতেন।
হজরত বিলাল (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) যখনই কোনো হাদিয়া পেতেন, তা গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন—নিজের জন্য কিছু রাখতেন না।
কন্যা শিশু জীবন্ত কবর দেয়া এবং দাসপ্রথা তিনিই সর্বপ্রথম উচ্ছেদ করেন। নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনিই ঘোষণা করেন—“মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত।”
বর্তমান বিশ্বের এই অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে উঠতে হলে তাঁর ন্যায়বিচার, সুশাসন ও মানবিক মূল্যবোধ বাস্তবায়ন করতে হবে।
অমুসলিম লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তাঁর ‘দ্য হানড্রেড’ গ্রন্থে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে স্থান দিয়েছেন। তিনি বলেন—“তাঁকে আমি এই তালিকার শীর্ষে রেখেছি কারণ তিনি ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় ও বৈষয়িক উভয় ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ সাফল্য অর্জন করেছেন।”
প্রখ্যাত দার্শনিক বার্নার্ড শ বলেন, “হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন মানবতার ত্রাণকর্তা।” তিনি আরো বলেন—“মুহাম্মদ (সা.) যদি আধুনিক বিশ্বে একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন, তবে তিনি এমন উপায়ে সমস্যাগুলোর সমাধান করতেন, যা পৃথিবীতে বহু কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনত।”
জীবনকে কল্যাণমুখী করতে হলে, নিজেকে মানবিক গুণে আলোকিত করতে হলে, রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ গ্রহণ করতে হবে। এই পথের কোনো বিকল্প নেই।
পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.)-এর পুণ্যময় দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক—সর্বক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করা।
লেখক : এম. মিজানুর রহমান
শিক্ষার্থী, কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা, সৌদি আরব।
সানজানা