
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮শে জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানাধীন বথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । ১৯৫৫ সালে কিশোর ইউনূস কানাডার মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জাম্বুরিতে যোগদানের মাধ্যমে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। ওই বয়সেই এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা ভ্রমণের অনন্য এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি । ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পুরো পৃথিবী চেনে। তিনি পরিচিতি পেয়েছেন তার সম্পাদিত কর্মের মাধ্যমে। তিনি ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসা নিয়ে কাজ করেন। তার কথা শুনতে চায় পুরো পৃথিবীর মানুষ। তিনি দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে গবেষণা হয়েছে পৃথিবীর যেকোনো প্রচলিত ব্যাংকের চেয়ে বেশি। গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে সুদি মহাজনদের খপ্পর থেকে বের করে এনে স্বাধীনভাবে তাদের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী করা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালীন ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ চলছিল। অসহায়, দরিদ্র মানুষের কষ্ট লাঘবের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে সাধারণ মানুষের কাছে টেনে আনে। নিজের পকেট থেকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে শুরু করা ছোট উদ্যোগই আজকের নোবেল বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংক।১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষের জন্য বিশেষত নারীদের জন্য অনন্য এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক।
গ্রামীণ ব্যাংকের সুনাম ছড়িয়ে পড়লো দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে। ১৯৮৯ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ট্রাস্ট নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যেটির মূল কাজ পৃথিবীর যেসব দেশ গ্রামীণ ব্যাংক অনুকরণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়তে চায়, সেসব প্রতিষ্ঠানকে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে অনুরূপ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগিতা করা। এ পর্যন্ত বিশ্বের ৪২টি দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে ১৩২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সফলভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। ১৬টি দেশে সরাসরি গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।
২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব ও কর্মপরিধি বেড়ে যায় বহুগুণ। সমস্যা সমাধানের জন্য একে একে প্রতিষ্ঠা করেন বহু সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি। যৌথ ব্যবসায় এগিয়ে আসেন ফ্রান্সের ডানোন ফুডস, ভিয়োলিয়া ওয়াটার, জার্মানির বিএএসএফ, জাপানের বিখ্যাত ইউনিক্লোসহ বিশ্বের বহু নামিদামি কোম্পানি।
২০১৮ সালে ‘অ্যা ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস: জিরো পভার্টি, জিরো আন-এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড জিরো নেট কার্বন এমিসন’ নামে একটি বই লিখেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি তার তিন শূন্যের স্বপ্নের পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। সঙ্গে আছে তার প্রতিষ্ঠিত ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস গ্লোবাল, গ্রামীণ ক্রিয়েটিভ ল্যাবসহ তার প্রতিষ্ঠিত সব প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববাসীকে তার অর্থনৈতিক তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য জাপান, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে বক্তৃতা প্রদানের আমন্ত্রণ। এক ঘণ্টা বক্তৃতার জন্য প্রস্তাব থাকে বাংলাদেশি টাকায় এক কোটি বা তার চেয়ে বেশি। তার কথার এই উচ্চ চাহিদা তৈরি হয়েছে তার সম্পাদিত কর্মের মাধ্যমে। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি একজন অতি সম্মানিত, পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তার সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য কতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, বিখ্যাত ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তর থেকে প্রতিনিয়ত আমন্ত্রণপত্র আসতে থাকে! খুব কমই তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারেন। তবে, প্রত্যেকটি আমন্ত্রণপত্রের জবাব দেয়া হয়।
সমগ্র পৃথিবীর নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিয়ত আসে আমন্ত্রণপত্র। ইতিমধ্যে ৩২টি দেশের ৮৩টি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে গবেষণা হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কর্ম ও জীবনাদর্শন নিয়ে। সামাজিক ব্যবসার ওপর কোর্স চালু হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে। পৃথিবীর মাত্র সাত জন ব্যক্তির একজন আমাদের ড. মুহাম্মদ ইউনূস- যিনি পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার, প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম ও কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেলসহ বহু পুরস্কার। বাংলাদেশকে তিনি এনে দিয়েছেন এসব বিরল সম্মাননা।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ঘোষিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। (৮ আগস্ট) দেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর কাঁধে আসে এক কঠিন দায়িত্ব। বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং একটি নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের (ব্যবস্খা করা) দায়িত্ব অর্পিত হয় ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের উপর। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারেরর অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থনীতি, উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি জাতির জন্য নতুন এক দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেবল একজন নোবেল বিজয়ী তিনি বাংলাদেশের গর্ব, তিনি তার কর্মের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে বাংলাদেশ কে পরিচিত করিয়েছেন। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে জানাই বিনম্র শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।
রাজু