
“অন্যরা যেখানে সংকট দেখে, আমি সেখানে সম্ভাবনা দেখি।”—এই এক বাক্যে ধরা পড়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নামের এক নির্ভীক স্বপ্নবাজ মানুষের দর্শন। আজ তার জন্মদিন। এক সময় চট্টগ্রামের মাটিতে জন্ম নেওয়া সেই ছেলেটিই হয়ে উঠেছেন বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র, নোবেলজয়ী সমাজপ্রযুক্ত, এবং বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একটি নতুন দিগন্তের দিকে।
কেউ তাকে বলেন ‘গরিবের ব্যাংকার’, কেউ বলেন ‘সোশ্যাল বিজনেসের স্থপতি’, কেউবা আবার তাকে দেখেন ‘সমাজ পরিবর্তনের একজন নীরব যোদ্ধা’ হিসেবে। কিন্তু তার জীবনকাহিনি মূলত একটি প্রমাণ—স্বপ্ন, যদি সত্যিই বড় হয়, তবে তা সীমানা মানে না।
ড. ইউনূসের যাত্রা শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে Vanderbilt University থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষকতা করছিলেন Tennessee State University-তে।
কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে—দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। শিক্ষকতা শুরু করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই একদিন ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে দেখা হয় এক নারীকে, যার জীবনের গল্প বদলে দেয় ইউনূসের অর্থনৈতিক দর্শন। মাত্র ৮৫ টাকায় ৪২ জন দরিদ্রকে ঋণ দিয়ে শুরু হয় গ্রামীণ ব্যাংকের আত্মপ্রকাশ।
ড. ইউনূস যে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ ধারণাটি তৈরি করেছিলেন, তা ছিল এক মৌলিক বিপ্লব। ব্যাংক তখন শুধু ধনী-সম্ভ্রান্তদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ইউনূস দেখালেন, আস্থা এবং ন্যূনতম পুঁজি থাকলেই একজন দরিদ্র মানুষও উদ্যোক্তা হতে পারেন।
তার এই কাজের স্বীকৃতি আসে বিশ্বের সর্বোচ্চ আসন থেকে। ২০০৬ সালে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক একসঙ্গে লাভ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। শুধু পুরস্কার নয়, তার ভাবনা এবং প্রয়োগ বদলে দেয় অর্থনীতি, সমাজ এবং বিশ্বব্যবস্থার অনেক চর্চাকে।
ড. ইউনূস সবসময় বলে আসছেন—“ব্যবসা মানেই মুনাফা নয়, ব্যবসা হতে পারে সমাজের সমস্যার সমাধান।” তার প্রতিষ্ঠিত "সোশ্যাল বিজনেস" ধারণা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে বিশ্বের বহু প্রজেক্টে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
করোনাকালেও তিনি থেমে যাননি। দারিদ্র্য বিমোচন, বেকারত্ব, জলবায়ু সংকট—প্রতিটি ইস্যুতে তিনি রেখেছেন নেতৃত্বের ছাপ। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি সরকারকে দিচ্ছেন নতুন ধারার সামাজিক অর্থনীতির কৌশল।
আজ ২৭ জুন, ড. ইউনূসের জন্মদিন। এই দিনে তাকে শুধু ফুল আর সম্মানে নয়, তার আদর্শকেও সামনে রাখা জরুরি—বিশেষ করে তরুণদের জন্য। কারণ এই মানুষটি দেখিয়ে দিয়েছেন—একজন ব্যক্তি, একটি আইডিয়া, এবং অটল মনোভাব—এই তিনে বদলে যেতে পারে গোটা দুনিয়া।
“স্বপ্ন দেখুন ইউনূসের মতো”—কারণ তিনি প্রমাণ করেছেন, স্বপ্ন শুধু চোখে দেখার জন্য নয়, বাস্তবেও গড়া যায়। তার জন্মদিনে এই গল্প হোক অনুপ্রেরণার বার্তা, প্রতিটি তরুণ মন হোক আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
রাজু