
ছবি: প্রতীকী
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রযুক্তি জায়ান্ট ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগল এবং অ্যাপলের প্রায় ১৬ বিলিয়ন ব্যবহারকারীর পাসওয়ার্ড ফাঁস হয়েছে—যা এক ভয়াবহ সাইবার নিরাপত্তা হুমকির জন্ম দিয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক তথ্য ফাঁসের ঘটনায় সবচেয়ে বড় বিপদের মুখে পড়েছেন উন্নয়নশীল দেশের ব্যবহারকারীরা।
সাইবারনিউজ নামের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ১৮ জুনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। তারা জানায়, ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন ডেটাবেসে ছড়িয়ে থাকা এই তথ্যসমূহকে ‘ম্যাস এক্সপ্লয়টেশনের নীলনকশা’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে ডিভাইসে ঢুকে চুরি
এটি কোনো প্রচলিত ডেটাবেস হ্যাক নয়। বরং ব্যবহারকারীরা যখন ভাইরাসযুক্ত ফাইল ডাউনলোড করেন, তখন ইনফোস্টিলার ধরনের ম্যালওয়্যার চুপচাপ ডিভাইসে ঢুকে পড়ে এবং দুর্বল পাসওয়ার্ড ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে। এতে করে অনেকেই না জেনেই হয়ে পড়েন প্রতারণা ও পরিচয়চুরির শিকার।
সবচেয়ে ঝুঁকিতে কারা?
সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টেকলেজিসের প্রতিষ্ঠাতা বিশেষজ্ঞ সালমান ওয়ারিস বলেন, ‘এই ধরনের ফাঁস এশিয়া ও আফ্রিকার উদীয়মান অর্থনীতিতে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভারত, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া এর মতো দেশগুলিতে ডিজিটাল প্রবৃদ্ধি দ্রুত, কিন্তু নিরাপত্তা এখনও পিছিয়ে। ফলে কোটি কোটি মানুষ সাইবার অপরাধের ঝুঁকিতে।’
তথ্য অনুযায়ী, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী দেশ ভারত, যেখান থেকে অ্যাপ দুটি যথাক্রমে ২০% ও ২৬% ডাউনলোড হয়েছে। তদ্রূপ, জিমেইলের বিশাল ব্যবহারকারী ভিত্তি রয়েছে পুরো এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানও নিরাপদ নয়
ওয়ারিস জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও জরুরি অবকাঠামো পরিচালনাকারীরাও এই তথ্য ফাঁস থেকে ঝুঁকিতে পড়েছে। বিশেষ করে যারা দুই স্তরের নিরাপত্তা (Two-factor authentication) ব্যবহার করেন না, তারা ইনফোস্টিলার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হতে পারেন।
এই ধরনের ঘটনাগুলোর ইতিহাস উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আরও স্পষ্ট।
২০১৫ সালে পাকিস্তানে ১৮ কোটি ৪০ লাখ ব্যবহারকারীর ব্যাংক, সোশ্যাল মিডিয়া ও সরকারি সেবা পাসওয়ার্ড ফাঁস হয়, যার ফলে দেশজুড়ে জালিয়াতির আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে।
ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কাতেও একই বছর এক অভিযানে ২ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হন।
আফ্রিকার জন্যও ভয়াবহ বার্তা
২০২৪ সালে টেলিকম নামিবিয়া হ্যাকড হয়, যেখানে ৫ লাখেরও বেশি ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্য চুরি হয়—এর প্রভাব পড়ে দেশটির মন্ত্রিপরিষদ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ওপর।
২০২৫ সালের প্রথম দিকে নাইজেরিয়ায় ১ লাখ ১৯ হাজারের বেশি তথ্য ফাঁসের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক।
অর্থনৈতিক ক্ষতি বিশাল
সাইবার আক্রমণের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব পড়ে। যেমন ২০২২ সালে কোস্টারিকায় এক র্যানসমওয়্যার আক্রমণে সরকারি কার্যক্রম অচল হয়ে যায় এবং দেশের জিডিপির প্রায় ২.৪% ক্ষতি হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুর্বল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এই ঝুঁকিকে আরও জটিল করে তুলছে।
ভারতের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টেকনোপাক-এর জ্যেষ্ঠ অংশীদার অঙ্কুর বিসেন বলেন, ‘ভারতে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ডিজিটাল প্রতারণা দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক ঝুঁকি। লাখ লাখ মানুষ এখনও প্রাথমিক সাইবার সচেতনতা থেকেও বঞ্চিত।’
ফাঁস হওয়া তথ্যের ধরন
সাইবারনিউজের তথ্য অনুযায়ী, ছোট ডেটাসেটে ছিল ১ কোটি ৬০ লাখ তথ্য, আর সবচেয়ে বড় ডেটাসেট—যেটি মূলত পর্তুগিজভাষীদের লক্ষ্য করে তৈরি—ছিল ৩৫০ কোটির বেশি তথ্য। প্রতিটি ব্যাচে গড়ে প্রায় ৫৫ কোটি তথ্য ছিল।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, সব তথ্য সমানভাবে বিপজ্জনক নাও হতে পারে। অনেক তথ্য পুরনো, পুনঃব্যবহৃত কিংবা ভুয়া হতে পারে।
ওয়ারিস বলেন, ‘এই তথ্য ফাঁসে গুগল, ফেসবুক থেকে শুরু করে VPN ও ডেভেলপার পোর্টাল পর্যন্ত নানা সেবা আক্রান্ত হয়েছে। তবে এর অনেকটাই হয়তো পুরনো বা অকার্যকর।’
এই তথ্য ফাঁস নিয়ে এখনও মেটা (ফেসবুক), গুগল বা অ্যাপলের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি। কিন্তু নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে, তাই এদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সূত্র: https://restofworld.org/series/tech-giants/page/2
রাকিব