ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ৩১ চৈত্র ১৪৩২

ঔষধি গ্রাম পেটভাতা

ভেষজ গাছেই জনপদের পরিচয়, বদলে গেছে জীবন ও জীবিকা

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ১৪ মে ২০২৫

ভেষজ গাছেই জনপদের পরিচয়, বদলে গেছে জীবন ও জীবিকা

বাহের দ্যাশ রংপুরের ঔষধি গ্রাম লতাপাতায় ভরা

উত্তরাঞ্চলের রংপুরের জমিদার দেবী চৌধুরাণীর এলাকার কবিরাজ আব্দুল জব্বারের হাতে গড়া আদর্শ ঔষধি গ্রাম পেটভাতা। এই গ্রামটি ঔষধি গ্রাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। স্বামীর মৃত্যুর পর সেই হালটি ধরে রেখেছেন স্ত্রী সালেহা বেগম। তাকে সহযোগিতা করছেন পড়শীরা। চারদিকে সবুজ প্রকৃতির লতাপাতা। গ্রামের প্রবেশপথের দুই পাশে সারি সারি তুলসী ও বাসক গাছ। কোনো বাড়ির আঙিনা বা উঠানে তেমন ফাঁকা  নেই, সবই ঔষধি গাছ। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গেলে দেখা যাবে বিলুপ্তপ্রায় অশোক, চিরতা, কর্র্পূর, পুনর্বভা, তেজবল, নাগেশ্বর, অশ্বগন্ধা, জাতিপু®প, গোরখ চাকুলিয়া ও কূটরাজ গাছ। এ ছাড়াও জীবন রক্ষাকারী মহৌষধ হিসেবে পরিচিত তুলশি পাতা, বাসক পাতা, কলোমেঘ, ওলটকম্বল, হরতকি, বহেরা, অর্জুন, স্বর্ণলতা, তেজপাতা ও বস গাছের দেখা মেলে সবখানে। এভাবে গ্রামটি এখন ঔষধি বা ভেষজ গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
গ্রামটির অবস্থান রংপুরের পীরগাছা উপজেলায়। রংপুর বিভাগীয় শহর থেকে ২১ কিলোমিটার
দূরে পীরগাছা ঘিরে নাম উঠে আসে ইতিহাস খ্যাত দেবী চৌধুরাণীর প্রাসাদ। বঙ্কিমচন্দ্র ব্রিটিশ রাজের আমলে রংপুরের কালেক্টর হিসেবে কাজ করতেন। এখানে কাজ করার সময়েই তিনি তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরাণী’ লিখেছেন। মন্থনা এস্টেটের রাজা রাঘবেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৭৬৫ সালে মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী মহারাণী জয় দুর্গা দেবী চৌধুরাণী তিন দশক ধরে এই রাজ্যটা রক্ষা করেন। ডাকাত সর্দার, গরিবের বন্ধ ও ইংরেজ বাহিনীর শত্রু ভবানী পাঠকের সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করেছেন দেবী চৌধুরাণী। তিনি ভবানী পাঠকের সঙ্গে সন্ন্যাসী বিদ্রোহেও অংশ নিয়েছিলেন। জনহিতৈষী কাজের জন্য তিনি তার প্রজাদের কাছে দেবী বা দেবীমাতা হিসেবে সর্বজনবিদিত ছিলেন। দেবী চৌধুরাণী  রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল ব্রজ কিশোর চৌধুরী এবং মাতার নাম কাশীশ্বরী দেবী। মন্থনা তথা পীরগাছার জমিদার নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয় এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় তিনি সেই এলাকার  জমিদার ছিলেন।  
এলাকাবাসী জানান, ২৩ বছর পূর্বে পেটভাতা গ্রামে ঔষধি গাছের চাষ শুরু করেছিলেন কবিরাজ আব্দুল জব্বার। গত চার বছর আগে কবিরাজ আব্দুল জব্বারের মৃত্যু হলে গ্রামটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। পরে তার দেখানো পথে ঔষধি গাছগুলোর হাল ধরেন কবিরাজ আব্দুল জব্বারের বিধবা স্ত্রী সালেহা বেগম। স্বামীর রেখে যাওয়া  এ গ্রাম ঔষধি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
সালেহা বেগম জানান, তিনি (স্বামী আব্দুল জব্বার) যখন বেঁচে ছিলেন ২০০২ সালে নিজের প্রয়োজনে স্বল্প পরিসরে বাড়ির আশপাশে ওষুধি গাছ লাগিয়েছিলেন। পরে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকার দরিদ্র কৃষকদের বাড়ির আঙিনা বা উঠানের পরিত্যক্ত জমিতে ঔষধি গাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন তিনি। শুরুর দিকে এলাকার ১২ থেকে ১৫ জন কৃষককে নিজ উদ্যোগে চারা সংগ্রহ করে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সেগুলো লাগিয়ে দেন আব্দুল জব্বার। সেই সঙ্গে পরিচর্যাও করেছিলেন তিনি।
পরে এক বছরের মাথায় সেসব কৃষকের বাড়িতে লাগানো ঔষধি গাছ মাসে  ৪-৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। বর্তমানে গ্রামটিতে প্রায় ৩০০ কৃষক ঔষধি গাছ লাগিয়ে প্রতি মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। সালেহা বেগম নিজেই এলাকার কৃষকদের কাছে থেকে ঔষধি গাছ ও পাতা কেনেন। পরে ক্রয়কৃত গাছ ও পাতা প্রক্রিয়াজাত করে একাধিক আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন তিনি। এ থেকে সালেহা বেগমের প্রতি মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আয় হয়। সালেহা বেগম বলেন, আমার স্বামীর ইচ্ছা ছিল গ্রামটিকে ঔষধি গ্রাম বানানোর। তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার চেষ্টা বিফলে যায়নি।
স্থানীয়রা জানান, গ্রামের লোকজন অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ঔষধি গাছ ব্যবহার করেন। এছাড়া প্রতিটি বাড়ির লোকজনই বেশিরভাগ ঔষধি গাছের গুণাগুণ সম্পর্কে জানে। গ্রামের আমেনা বেগম বলেন, পাঁচ শতক জমির ওপর আমার বাড়ি। এখানে বসবাসের পাশাপাশি ঔষধি গাছ লাগিয়েছি। প্রতি মাসে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত ঔষধি গাছ ও পাতা বিক্রি করি। এটা আমাদের বাড়তি আয়। আয়নাল মিয়া বলেন, ঔষধি গাছ লাগিয়ে প্রতি মাসে ভালোই আয় হয়। ঔষধি গাছের জন্য আলাদা খরচ করতে হয় না। শুধু পরিচর্যা করলেই আয় করা সম্ভব।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান মন্ডল বলেন, পেটভাতা গ্রামে বহু প্রজাতির ঔষধি গাছ আছে। এসব গাছের মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা উপকৃত হচ্ছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, এখানকার চাষিরা কম জমিতে ভেষজ চাষাবাদ করে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন। তাই এর উৎপাদন ও ব্যবসা সম্প্রসারণ হচ্ছে। কৃষি বিভাগ চাষিদের পাশে থেকে নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

প্যানেল

×