ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২

ঝিনাইগাতীর পাহাড়ি অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে ঔষধি গাছ আকন্দ

আরএম সেলিম শাহী, ঝিনাইগাতী, শেরপুর

প্রকাশিত: ১২:০৪, ১৪ মে ২০২৫

ঝিনাইগাতীর পাহাড়ি অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে ঔষধি গাছ আকন্দ

ছবি : জনকণ্ঠ

প্রাচীন ভেষজ চিকিৎসালয়ের মহৌষধি গুণসমৃদ্ধ উদ্ভিদ আকন্দ। এর পাতা গ্রামাঞ্চলের মানুষের প্রাথমিক সেবাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। পাশাপাশি ফুল, মূল, রসাল আঠা, চূর্ণ ব্যবহার করে ঘরোয়া, কবিরাজি, আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, হোমিও চিকিৎসা ও ওষুধ তৈরিতে ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষের বহুবিধ রোগমুক্তি বা নিরাময়ে মন্ত্রশক্তির মতো কাজ করত এ উদ্ভিদ।

কিন্তু কালের পরিক্রমায় ভেষজ গুরুত্বের অভাবে গ্রামবাংলার প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আকন্দ। এক সময় গ্রামীণ মেঠোপথের ধারে আকন্দ গাছ দেখা যেত। প্রকৃতির ইশারায় জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠত অনাদরে।

আকন্দ এক প্রকার গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এটি একটি মাঝারি ধরনের ঝোপজাতীয় উদ্ভিদ। আকন্দ ফুল দুই রকমের—একটি সাদা, আরেকটি বেগুনি রঙের। ফল সবুজ, বীজ লোমযুক্ত। এর বর্ণ ধূসর কিংবা কালচে। আকন্দ সাধারণত সাত থেকে আট ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় এবং এর পাতা পাঁচ থেকে সাত ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি আকন্দ গাছে ফুল ফোটে এবং মে থেকে জুন মাসের শেষের দিকে ফল ধরে। ফল পাকে আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসে।

কবিরাজ হেকিম জানান, এক সময় গ্রামীণ লোকজন এ গাছের পাতা ভাঙা-মোচকা, হাড়-জোড়া, বাতব্যথা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করত। নতুন প্রজন্ম এ গাছ না চেনা বা বিশদ গুণাগুণ সম্পর্কে না জানায় মহামূল্যবান সনাতনী চিকিৎসা ব্যবস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। ঝোপঝাড়, আগাছা মনে করে এর শেকড় উপড়ে ফেলছে।

ফাকরাবাদ গ্রামের গাছগাছড়ার কবিরাজ আব্দুল কুদ্দুস বলেন, এক সময় এলাকার সড়কের পাশে প্রচুর পরিমাণে আকন্দ গাছ দেখতে পাওয়া যেত। এখন আদৌ আকন্দ গাছ দেখা যায় না। আমাদের মায়েদের দেখতাম বাতের ব্যথার জন্য আকন্দ গাছের শেক নিত, এতে করে ব্যথা উপশম হতো।

নলকুড়ার কবিরাজ ময়সান জানান, গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আকন্দ গাছসহ বিভিন্ন ঔষধি গাছ। একসময় এসব ঔষধি গাছ বন-জঙ্গলে ও পতিত জমিতে পাওয়া যেত। কালের আবর্তনে তা হারিয়ে যাচ্ছে।

উপজেলার ফাকরাবাদ গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ইউসুফ আলী জানান, একসময় ব্যথানাশক হিসেবে মহাশংকর তেল, কেরোসিন, সরিষার তেল সহনীয় গরম করে মালিশের পর আকন্দ পাতা আগুনে হালকা সেঁকে প্রলেপ দিত। তাতে দ্রুত ব্যথা উপশম হতো। এ চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল খরচ সাশ্রয়ী, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত। এখন বিলুপ্ত প্রায় আকন্দ গাছ। টুকিটাকি চিকিৎসায়ও খুঁজে পাওয়া যায় না।

ঝিনাইগাতীর আয়ুর্বেদিক ডা. নাজমুল হাসান জানান, আকন্দের রয়েছে অনেক ভেষজ গুণাগুণ। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, দাঁতের ব্যথা, গর্ভপাত, খোসপাঁচড়া, একজিমা, বহুমূত্র রোগ, পা মচকালে, পেটের জ্বালাপোড়া, বর্ণ, হজমকারক, শরীরের কোনো স্থানে ক্ষত হলে, আকন্দ গাছের পাতা, ছাল, ফুল, ফল, মূল ও কষ মানবকল্যাণে রোগ নিরাময়ে কাজ করে।

ঝিনাইগাতীর গজনী বিট কর্মকর্তা সালেহীন নেওয়াজ জানান, আকন্দের বৈজ্ঞানিক নাম—Calotropis, গোত্রের নাম Apocynaceae (Asclepiadoideae)। পাতা রোমশ ধরনের, পাতা ও ডাল হতে দুধের মতো সাদা রঙের রসাল আঠা বের হয়। পাতা ব্যথানাশক হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। যুগের পর যুগ এই গাছ নানাবিধ রোগের মহৌষধ হিসেবে কাজ করলেও সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।

ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. সাদ্দাম হোসেন জানান, আকন্দ গাছের পাতা ছিঁড়লে কিংবা কান্ড ভেঙে ফেললে দুধের মতো কষ (তরুক্ষীর) বের হয়। পাতায় এনজাইমসমৃদ্ধ তরুক্ষীর বিদ্যমান। এতে বিভিন্ন গ্লাইকোসাইড, বিটা-এমাইরিন ও স্টিগমাস্টেরল আছে। ফল সবুজ, অগ্রভাগ দেখতে পাখির ঠোঁটের মতো। সর্বত্র আকন্দ পাওয়া যায় এবং পরিত্যক্ত স্থানে বেশি জন্মে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত, চীন ও নেপালে এ উদ্ভিদটি পাওয়া যায়। 

সা/ই

×