
ছবি :সংগৃহীত
যে পরিবারে বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি একত্রে বসবাস করে, তা-ই একান্নবর্তী পরিবার। একবিংশ শতাব্দীতে একক বা ছোট পরিবার নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি— ছোট পরিবার মানেই সুখী পরিবার! স্বামী, স্ত্রী এবং একটি কিংবা দুটি সন্তান নিয়ে পরিবার। যৌথ পরিবারে একসঙ্গে থাকা-খাওয়া, হই-হুল্লোড়, আনন্দ-উৎসবের মজাই আলাদা।
একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। শহুরে জীবনের ঢেউ গ্রামেও লেগেছে। গ্রাম থেকেও যৌথ পরিবার উঠে যেতে বসেছে। মানুষের পুকুরভরা মাছ ছিল, ক্ষেতজুড়ে ধান ছিল, গোয়ালভরা গাভি ছিল, একান্নবর্তী পরিবারে অনেক সুখ-সাচ্ছন্দ্য ছিল। অবস্থাভেদে প্রতিটি পরিবারে সদস্য ছিল ২০-৩০ জন। কোথাও আবার এর চেয়ে বেশি। পরিবারের কর্তার আদেশ সবাই মান্য করে চলত। ভাইবোনের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকত। বিয়ে-বিচ্ছেদ হতো কম। পৃথিবী যত এগিয়ে যাচ্ছে, একান্নবর্তী পরিবার তত কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের সুবিধা, ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধন, বাড়ছে কলহ-বিবাদ আর নানা অশান্তি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বসাম্প্রতিক এক তথ্য বলছে, পরিবারের সদস্যের আকার ছোট হয়ে চারজনের নিচে নেমে গেছে। এক দশক আগে ছিল প্রায় সাড়ে চারজন। বর্তমানে সেটি কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ জন। পরিবার ছোট হওয়ার পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমেছে। দেশে এখন বার্ষিক গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ এবং এক দশক আগে ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সূত্রমতে, গত ২৯ নভেম্বর ২০২৩ প্রকাশিত বিবিএস-এর সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে এবং চিত্রটি অবশ্যই উদ্বেগের। দেশজুড়ে ২০২২ সালের ১৫-২১ জুন ষষ্ঠ জনশুমারি অনুষ্ঠিত হয় এবং একই বছরের ২৭ জুলাই শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তখন জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৫১ লাখ। ২৯ নভেম্বর ২০২৩ প্রকাশিত চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ, এর মধ্যে নারী আট কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার (৫০.৪৬ শতাংশ) এবং পুরুষ আট কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার (৪৯.৫৪ শতাংশ); অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে নারী প্রায় ১৬ লাখ বেশি। নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর আয়ুষ্কাল বেড়েছে এবং অনেক পুরুষ প্রবাসী। সে কারণে পুরুষের তুলনায় নারী বেশি।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, একান্নবর্তী পরিবার এখন পাখির বাসার মতো ক্ষণস্থায়ী, ছিন্ন জীবন সংসার। একটি-দুটি ছোট ঘর, ছোট সংসার, ছোট পরিবার; যেখানে বসবাস করে কেবলমাত্র মা-বাবা আর তাদের এক বা দুটি ছেলেমেয়ে। যেখানে নেই তেমন আনন্দ; সবই যন্ত্রের মতো, নিরানন্দ, নিঃসঙ্গ। পূর্বের সেই একান্নবর্তী পরিবারে যারা কর্তা-কর্ত্রীর ভূমিকা পালন করতেন, বর্তমান একক পরিবারে তাদের উপস্থিতি মেহমান হিসেবেই গণ্য করা হয়; ঠিক যেন বাইরের লোক। ফলে তারা যে পরিবারের সদস্য, সেটা শিশুরা জানছেই না, ওদের মধ্যে দাদা-দাদি, চাচা-ফুফিদের প্রতি কোনো ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ বা সহনশীলতা গড়ে উঠছে না। এই না জানার মূলে রয়েছে ওদের বাবা-মা। এসব পরিবারের সন্তানগুলো বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর অল্পকিছু দিনের মধ্যেই তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রী দুইজনের একক পরিবার গড়ে তুলছে; পরিবারের একমাত্র ছেলেটিও বাদ যাচ্ছে না। বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে নিজেরা আলাদা থাকতেই আজ তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যার ফলশ্রুতিতে বৃদ্ধাশ্রম। এ ছাড়াও বর্তমান সমাজে যে অসহযোগিতার চর্চা দেখা যাচ্ছে, এর জন্যও খানিকটা এই একক পরিবারব্যবস্থা দায়ী।
সময়ের বিবর্তনে আজ একান্নবর্তী পরিবারের কনসেপ্ট থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। অথচ এক সময় যৌথ পরিবারকেন্দ্রিক পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, আপনজনদের পরস্পরের সান্নিধ্যে থেকে ফিল করার আবেগ-অনুভূতি বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ ছিল। চারপাশে তাকালে দেখতে পাই, বাঙালি পরিবারগুলো পরিবেশগত কারণে আজ একজন থেকে আরেকজন কতটা দূরে। যে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিলিয়ে গেল, তা যেন কেউ টেরই পায়নি।
বিশেষ করে নগরজীবনে পরিবার বলতে সবকিছু ছকে বাঁধা। নগরজীবনের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন তথা জীবনের প্রতিটি ছত্রে জেগে আছে নড়বড়ে প্রহরের ছত্রখান গল্প। যে গল্পের শুরু আর শেষার্ধেও নেই উজ্জীবনের প্রাণোচ্ছলতা। খণ্ডিত জীবনবোধের ভেতরেই যেন থমকে গেছে প্রজাপতি মন। অথচ একটা সময় ছিল, যখন পরিবারের সবাই মিলে এক বাড়িতে থাকা, এক হাঁড়িতে রান্না আর এক বৈঠকে খাওয়া পর্ব হতো অপরিসীম আনন্দ ভাগ করে। সেটা কবে? তিন দশক, চার দশক কিংবা পাঁচ দশক আগের কথা। তখন বাড়ির কর্তার আদেশ-নির্দেশে ভরপুর থাকত ভালোবাসার টান, অনুশাসনের রাঙা চোখ, মায়ের বকুনি, মুরব্বিদের খবরদারি।
একইভাবে পারিবারিক বন্ধনের রূপটাও কখনও তেমনভাবে তারা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পায়নি। ফলে ঈদ কিংবা অন্যান্য ছুটির সময় শুধু শহুরে জীবন-জীবিকার প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে এক রত্তি বউ-বাচ্চার সংসার, লাগেজ গুছিয়ে-মুছিয়ে ছোটে লঞ্চ, ট্রেন, বাস, স্টিমার, নিজেদের গাড়িতে করে শিকড়ের টানে গ্রামের পথে। যে পথের ধুলো আর ঘাসে রোদ আর শিশিরের এক অদ্ভুত কার্নিভাল ফুটে ওঠে। আগের মতোই পড়ে থাকল জীবন সায়াহ্নে পরিচর্যাহীন একাকী সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-পরিজনহীন বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা। আমাদের সমকালীন সাহিত্য, চলচ্চিত্র, গল্প, নাটক, শিল্পকর্মেও যেন একান্নবর্তী পরিবারের ছবিটা আগের মতো আর উজ্জ্বল বৈভবে ফুটে উঠছে না। পাওয়া যাচ্ছে না সেই রিদম। ডিজিটাল সময় যেন সবকিছুকেই ডিজিটালাইজড করে দিচ্ছে ক্রমাগত। পরিবার, সম্পর্ক, হৃদ্যতা চলে এসেছে হাতের মুঠোয়— মোবাইল ফোনের নীল মনিটরে। বাটন চাপলেই ভেসে উঠছে প্রিয় কারও নাম। যে নামটি ছিল একদিন একে অন্যের মধ্যে জড়িয়ে। তা যেন আজ এক পঙ্ক্তি কথোপকথনের মধ্যেই হয়ে গেছে সীমাবদ্ধ। পরিবারকেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ঝর্ণায় ছিল বাঙালি সিক্ত, সেখানে জমেছে যেন বিচ্ছিন্নতার গল্পহীন ধুলোর আস্তরণ। আবেগের পলেস্তরাগুলো ক্রমশ উঠে যেতে বসেছে। পড়ে আছে চুনকামহীন একান্নবর্তী পরিবারের সেই মর্মছোঁয়া বিমর্ষ অনুভূতি।
মায়ের আদর, বাবা, কাকা, জ্যাঠার স্নেহ; জ্যাঠিমা, চাচি আম্মার অফুরন্ত স্নেহলতার স্পর্শ কি আজ আর আছে আগের মতো? বাড়ির সব ভাইবোন মিলে সেই উৎসবমুখর ভালোবাসাময় প্রহর যেন থমকে আছে গোধূলির রঙে। মফস্বল কিংবা গ্রামে আজও এক-আধটু যৌথ পরিবারের মৃদু ঝলকানি চোখে ভাসলেও, যেন তাতেও লেগেছে ক্ষয়িষ্ণু চন্দ্রগ্রহণ। যেন অক্সিজেনের ওপর ভর করে জয়েন্ট ফ্যামিলির চিরায়ত সেই আবেগটুকু জীবনের প্রবহমানতাকে ধরে রেখেছে।
যেভাবে এই প্রজন্ম একে একে ইন্টারনেট, মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আজ টেলিগ্রাফ, ট্রাঙ্ককল, পোস্ট অফিস প্রভৃতি জীবনঘনিষ্ঠ প্রতিপাদ্য বিষয় থেকে একেবারেই দূরে সরে এসেছে; একইভাবে তারা জয়েন্ট ফ্যামিলির নিগূঢ় আত্মঘনবোধ থেকেও ক্রমশ যোজন যোজন দূরত্বে এসে দাঁড়াবে। সময়ের তাগিদে নাগরিক জীবন থেকে মুছে যাবে একান্নবর্তী পরিবারের হৃদয়জ আবেদনটুকু। শুধু পড়ে থাকবে টুটাফাটা অন্তরের টান।
সা/ই