ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

উদীয়মান প্রজন্ম ও রবীন্দ্রনাথ

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৬:৩৩, ৮ মে ২০২৫

উদীয়মান প্রজন্ম ও রবীন্দ্রনাথ

সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশের আগামী প্রজন্মের যে নজরকাড়া অভিযাত্রা তা দেশ ও জাতির জন্য অনন্য অর্জন। তাই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা অনুধাবন করতে পারব তিনি নতুন প্রজন্মকে কি মাত্রায় অভিনন্দিত করেছেন।  ২৫ বৈশাখ কবি গুরুর ১৬৪তম জন্মজয়ন্তীতে উল্লেখ করতে চাই একটি সুসংবদ্ধ জাতি গঠনে শিক্ষা যেমন অপরিহার্য তেমনি সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরাও পথ নির্দেশকের ভূমিকায় নামা পরিস্থিতির ন্যায্যতা। ঐতিহ্যিক ঠাকুর বংশে জন্ম নিয়ে শৈশব কালের নিত্য জীবন ছিল অন্য সব বালকের মতো। পারিবারিক ঐশ্বর্য আর জ্ঞানী-গুণীর মহাসম্মিলনে ঠাকুর বাড়ির নির্মল পরিবেশে বেড়ে ওঠা কবির শৈশব-কৈশোর অতিক্রমের কাল ছিল একেবারে সাধারণ বালকের মতো। শিশু বয়সের বহু স্মৃতি কবিকে ভাবিয়ে তুলত। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শৈশবের ঘটনাগুলো বারবার স্মৃতির পাতাকে ভরিয়ে রাখতে ভোলেননি কখনো। শৈশব কালের স্মৃতি রোমন্থনে বয়সের ভার সেভাবে ছাপও ফেলেনি। তাই পরিণত বয়সেও শিশুর মতো করে ছড়া লিখতে পারতেন। তেমনই একটি  ছড়ার অনুভব-
আমার রাজার বাড়ি কোথায়
কেউ জানে না সে তো-
সে বাড়ি কি থাকত যদি
লোকে জানতে পেতো।
শুধু কি তা-ই? আশি বছর বয়সে লিখছেন ‘আমার ছেলেবেলা’।  বৃদ্ধ বয়সেও বালকের অনুভব, অনুভূতিতে যে মাত্রা শিশু-কিশোর  রবি তার আপন মাহাত্ম্যে অবিচল থাকতেন সেটাও পরম বিস্ময়। শৈশবের অনেক ঘটনার সঙ্গে লেখাপড়ার হাতে খড়ি হওয়ার স্মৃতি জীবনভর নাড়া দিয়েছে। ৮০ বছর বয়সে লেখা ‘আমার ছেলেবেলা’ পড়ে বোঝারই সাধ্য নেই কবি তখন শিশু-কিশোর না বৃদ্ধ? শৈশব থেকেই কণ্ঠে ছিল সুমধুর মূর্ছনা। বিদ্যালয়ে ধরাবাধা পাঠক্রম তো ছিলই। তা ছাড়া গৃহেও ছিল এক নিয়মানুগ পড়াশোনার রীতি। তবে বালক রবির পাঠ্য বইয়ের চাইতেও বেশি নজর ছিল ভিন্নমাত্রার পড়াশোনায়। অতি বাল্যকাল থেকে কবির ভ্রমণ বিলাসী মানসিকতায় দেশ বিদেশের ছবি হৃদয়ে ধারণ করাও ছিল শিশুকালের ভিন্নমাত্রার আনন্দ আয়োজন। মাত্র এগারো বছর বয়সে পিতার সঙ্গে হিমালয় যাত্রা শৈশবকালের সুখকর এক উৎসাহ-উদ্দীপনা। জীবন স্মৃতিতে এর মুগ্ধতা আছে, অনেক স্মৃতিচারণে আবিষ্টতাও দৃশ্যমান। সেই শুরু বালক রবির সামনে দিকে এগিয়ে যাওয়ার নানামাত্রিক দুর্লভ ঘটনাপ্রবাহ। সীমাবদ্ধ আলয়ে জ্ঞানের পরিধি সেভাবে বিকশিত হয় না। তাই তেমন স্বাচ্ছন্দ্য অনুভবে কিশোর রবির মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইউরোপ যাত্রা জীবনের আর এক মাহেন্দ্রক্ষণ। যাত্রা তো নয় যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ইউরোপীয় সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ানো। কিন্তু বিলেত যাওয়ার মাঝপথে কবি যান দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থল বোম্বেতে। যার প্রতিভাদীপ্ত মনন একদিন জগতের আলোয় উদ্ভাসিত হবে তার জন্য সীমাবদ্ধ শহর কোনো বার্তা নিয়ে আসে না। তবুও জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে পরিণত বয়সেও শিশু-কিশোরদের  মতো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে দিতেন সার্বিক পরিবেশকে। পাশাপাশি তার কাব্যিক আর মনন শক্তিকেও। সেখানে পরিচয় হয় আন্না তড়খড় নামে এক ভিন দেশী নারীর সঙ্গে। আগের দেখা সব রমণীর থেকে ভিন্নমাত্রার আলাদা অনুভবের বিষয়ও কবির হৃদয়পটে বহুদিন আঁকা ছিল। বিস্মিত, বিমুগ্ধ কবির প্রথম ভালো লাগার কম্পমান অনুভূতি। মাত্র ১৭ বছরের কিশোর তার স্মৃতি বিজড়িত আখ্যানের অভিব্যক্তি স্মরণ করলেন আশি বছর বয়সে। লিখলেন আমার ছেলেবেলা। জমিদার বংশের সম্পদশালী পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য রবীন্দ্রনাথ। অতি আদর আর স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েছেন তেমন চিত্র কবির লেখনীতে অনুপস্থিত।
১৭ বছর বয়সে ইউরোপ ভ্রমণ নিয়ে জ্যোতি দাদাকে লেখা চিঠি পরবর্তীতে ‘ইউরোপ প্রবাসীর পত্র’ নামে গ্রন্থাকারে বের হয়। যা কবির শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণে উদীয়মান এক তরুণের আপন মনের মাধুরী মেশানো এক অনবদ্য গদ্য রচনা। যেখানে এক নতুন প্রজন্মের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ, নব্য সংস্কৃতিকে ধারণ-লালন ছাড়াও জীবন ও সাহিত্যে তারুণ্যের উদ্ভাসিত ভাব কল্পনা। সেটা নতুন প্রজন্মকে নানামাত্রিক উৎসাহিত আর অনেক অজানা বিস্ময় জানার পথও উন্মুক্ত করে দেয়। প্রতিভাদীপ্ত কবি শুধু যে নিজের কথা বলেছেন তা কিন্তু নয় বরং অগণিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নব আনন্দ আর ভাববেগে পূর্ণ করেছেন। কারণ কবির নিজের ভাষায় যা অভিব্যক্তি ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা তাই সাহিত্য তাই ললিতকলা।
উদীয়মান প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কল্পনায় কবির যে উদাত্ত আহ্বান সেখানে তারুণ্যের জয়গান ও জীবন চলার বহুমুখী অভিযাত্রা। তবে সিংহভাগ রচনায় ছোট গল্প এবং উপন্যাসে বাল্য বিয়েকে সেভাবে ঠেকানো যায়নি। কারণ চারপাশের সমাজ ব্যবস্থাই ছিল মান্ধাতা আমলের নানামাত্রিক বিধিবদ্ধ আবহের বেড়াজাল। এখনো অনেকের মনে হয় রবীন্দ্র সংগীত তারই মনের কথা বলে যাচ্ছে। কবি নিজেও নির্দ্বিধায় বলেছেন, তার গানের আবেদন চিরন্তন। শেষ হয়েও শেষ হবার নয়। যা কবির ছোট গল্পের বেলায়ও সমানভাবে প্রযোজ্য। বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের কোনো ধারাই ছিল না। ছোট গল্পের স্রষ্টাই শুধু নন এখনো মহানায়কের ভূমিকায় অভিষিক্ত। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঠাকুর বাড়ির জমিদারি ছিল। এক সময় পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে কবি চলে আসলেন আমাদের বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর, পাবনার শাহজাদপুরে। ১৮৯০ সালে কবির বয়স ৩০ বছর। জমিদারির জৌলুস ছেড়ে হতদরিদ্র প্রজাদের দেখভালের দায়িত্ব পেলেন কবি। গ্রামীণ জনপদ আর সবুজ ঘেরা শ্যামল প্রান্তরে কবি যে মাত্রায় উচ্ছ্বসিত আবেগে আপ্লুত হতেন তা বিধৃত আছে ‘সোনারতরী’র মতো অনেক লেখায়। আর বেদনাবিধুর অনুভবে নিবেদিত হন অসংখ্য মূর্খ, দীনহীন প্রজাদের নিত্য কষ্ট চিহ্নিত করে নিজেই প্রথম লিখলেন ‘দেনা-পাওনা’ ছোট গল্প। যা শুধু রবীন্দ্র সাহিত্যেই নয় পুরো বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় নব সৃষ্টি। ‘দেনা-পাওনা’ ছোট গল্পটি সত্যিই গ্রাম বাংলার এক চিরায়ত নিষ্ঠুর বিধি পণপ্রথার অসহনীয় রূপকল্প। গল্পগুলোর সিংহভাগ কবির নিজের দেখা করুণ চিত্র বাকিটা তার সৃষ্টিকল্পনা তাকে যেখানে নিয়ে যায়। পণপ্রথার আবর্তে নির্বিত্ত পিতা আর অসহায় কন্যার যে মর্মবেদনা তা আজও বাংলাদেশের সমাজ সংস্কারের শিকড়ে গেঁথে আছে। নিঃস্ব পিতা আর বালিকা বধূর অকাল প্রয়াণ কবিকে যে মাত্রায় দগ্ধ করে সেটার সর্বশেষ ইতি টানলেন শ্বশুর মশাইয়ের নির্দয়, পীড়াদায়ক কার্যকলাপের মধ্যে। কবি লিখছেন আত্মঘাতী নিরূপণার শেষকৃত্য হয়েছিল আড়ম্বর আর আর্থিক ব্যয় বহুলতায়। সর্বশেষ উক্তি ছিল গল্পকারের উৎসব, আয়োজনে, সাড়ম্বতায় সত্যিকারের প্রতিমা বিসর্জন তো বটেই। তবে আধুনিক ও নব্য সভ্যতা সংস্কৃতির ধারক কবি গুরু কিন্তু বাল্য বিয়েকে সেভাবে ঠেকাতে পারেননি। এমনকি নতুন কোনো পথ নির্দেশনায় বালিকা বধূদের জন্য নিয়ামক বার্তাও অনুপস্থিত তার সুবিশাল সৃজন সম্ভারে। অবশ্য কট্টর সমাজ ব্যবস্থাকে সৃষ্টি আর প্রতিভাদীপ্ত মননে অতিক্রম করাও অত সহজ ব্যাপার ছিল না।

প্যানেল

×