ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মীর, ব্রিটিশদের সৃষ্ট সংঘাতে এখনো মরছে মানুষ!

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১২:৪২, ৭ মে ২০২৫

ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মীর, ব্রিটিশদের সৃষ্ট সংঘাতে এখনো মরছে মানুষ!

ছবি: সংগৃহীত

ঔপনিবেশিক শক্তির প্রস্থান মানেই স্বাধীনতা নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের অনেক অঞ্চলে ছেড়ে গেছে এমন সব সমস্যার বীজ, যা স্বাধীনতার বহু দশক পরেও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের রূপে দেখা দিয়েছে। এই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুটি উদাহরণ হলো ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর। দুই ভিন্ন ভৌগোলিক প্রান্তে অবস্থিত হলেও, উভয় অঞ্চলের ইতিহাসে একটি বিষাক্ত সাদৃশ্য রয়েছে— ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বিভাজনের শিকড় থেকে জন্ম নেওয়া এক দীর্ঘস্থায়ী, জটিল এবং সহিংস বাস্তবতা।

ফিলিস্তিনে আজ যা ঘটছে, তা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এর সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলেই, যখন ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণা মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনের ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়, অথচ সেখানে তখন বসবাস করত মুসলিম ও খ্রিস্টান আরবগণ, যারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের ওপর ম্যান্ডেট লাভ করে এবং ইহুদি অভিবাসনকে উসকে দিতে থাকে।

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা অঞ্চলটি ত্যাগ করার সময় ইসরায়েলের জন্ম হয় এবং সাথে সাথে শুরু হয় ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ — সাত লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিজভূমি থেকে বিতাড়িত হন, যাদের উত্তরসূরিরা এখনো প্রতিবেশী দেশের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূলেই রয়েছে এই ঔপনিবেশিক পুনর্বিন্যাস, যার কোনো ন্যায্যতা ছিল না এবং আজও যার জন্য ফিলিস্তিনের শিশু, নারী, ও পুরুষেরা প্রাণ হারাচ্ছেন।

কাশ্মীরের ইতিহাসও প্রায় একই রকম। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেবার সময় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। কিন্তু এই বিভাজন ছিল তাড়াহুড়ো ও অপরিকল্পিত, এবং তার ফলে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ দাঙ্গা ও গণহত্যা। এই বিভাজনের মধ্যেই ঝুলে পড়ে কাশ্মীর নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড। কাশ্মীরের মহারাজা হিন্দু হলেও প্রজাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল মুসলিম। ভারত-পাকিস্তান দু’দেশই কাশ্মীর দাবি করলে, সেখানে শুরু হয় প্রথম যুদ্ধ, যার ফলে নির্ধারিত হয় ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’। কিন্তু মূল সংকট থেকে যায়— কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অমীমাংসিত প্রশ্ন।

এরপর থেকে কাশ্মীর হয়ে পড়ে এক সামরিকীকৃত অঞ্চল, যেখানে নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, এমনকি মানবাধিকারও বারবার লঙ্ঘিত হয়। ২০১৯ সালে ভারতের সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিলে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয় এবং সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গৃহবন্দী করা হয়। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া এই অসম্পূর্ণ ও অবিচারপূর্ণ অবস্থা আজো মানুষের রক্তপাত, নিপীড়ন ও বঞ্চনার কারণ হয়ে আছে। কাশ্মীরকে ঘিরে নতুন করে শুরু হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।

এই দুই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যে যে ক্রমাগত বিপর্যয় চলছে, তা কেবল স্থানীয় বা আঞ্চলিক রাজনীতির ফল নয়। এর শেকড় রয়েছে ঔপনিবেশিক নকশায়, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য নয়, বরং বিভক্তি ও দাঙ্গা সৃষ্টিই ছিল উদ্দেশ্য। ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ‘Divide and Rule’ নীতি প্রয়োগ করেছিল, যার ফলাফল আজো মানুষের রক্তে লেখা হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন আজও অধরা, আর কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি প্রতিনিয়ত সামরিক শক্তির মুখে নিষ্পেষিত হচ্ছে।

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল যেমন আফ্রিকার সীমানা বা সাইপ্রাসের বিভাজনেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির একই ধরনের ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দুটি অঞ্চল এখনো আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে, এবং এখানে প্রতিনিয়ত নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। তবু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া প্রায়শই নীরব, ন্যূনতম প্রতিবাদী কিংবা কূটনৈতিক বিবৃতির বাইরে আর এগোয় না।

আজও যদি ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দায় মেনে নিয়ে এর সমাধানে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে মানবতা প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হতে থাকবে। ইতিহাসকে দায়মুক্ত করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হয়তো এখন নেই, কিন্তু তাদের সৃষ্টি করা এই অসমাপ্ত ক্ষত এখনো মানুষের শরীরে রক্ত ঝরায়। মানুষ মরছে, স্বপ্ন ভাঙছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিষণ্ন ভবিষ্যতের ভার বইছে— এবং এই দায় শুধু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর নয়, ইতিহাসকেও সে দায় নিতে হবে।

লেখক: সহ-সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ ([email protected])

এম.কে.

×