ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

সেনাবাহিনী পাহাড়ে শিক্ষা প্রসারের অগ্রপথিক

লে. কর্নেল মেছবাহুল আলম সেলিম, পিএসসি, জি

প্রকাশিত: ২০:১৬, ২০ এপ্রিল ২০২৫

সেনাবাহিনী  পাহাড়ে শিক্ষা প্রসারের অগ্রপথিক

শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। এটাও বলা হয়, যে জাতি যতটা শিক্ষিত, সে জাতি ততটা উন্নত। সেই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে শান্তি, সম্প্রীতি আর উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় দেশের এক-দশমাংশ অঞ্চল নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাৎপদ এলাকার মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সুদীর্ঘকাল ধরেই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাহাড় থেকে পাহাড়ে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সরকারি কার্যক্রমের পাশাপাশি নিজেদের অর্থায়নে তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় অর্ধশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সেনাবাহিনী। নিয়মিত অনুদানের মাধ্যমে সচল রেখেছে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আলো ছড়ানোর কার্যক্রম। পাহাড়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের অন্যতম নিদর্শন এই শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষিত হয়ে উঠছে লাখো পাহাড়ি শিক্ষার্থী। যার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠছে একটি শিক্ষিত সভ্যতা। উঁকি দিচ্ছে দারুণ সম্ভাবনা।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ভারত ও মিয়ানমারের সীমানা বেষ্টিত পশ্চাৎপদ পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা রক্ষার পাশাপাশি এ অঞ্চলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার সরকারি প্রয়াস ছাড়াও সেনাবাহিনী কর্তৃক শিক্ষাক্ষেত্রে সুদৃষ্টির ফলে পাহাড়ে প্রতিবছর সুশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে লাখ-লাখ শিক্ষার্থী। গড়ে উঠেছে সম্প্রীতির পরিবেশ। যারা অতীতে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে জড়িয়ে পড়ত অনিশ্চিত জীবনে, তারাও এখন ভালো আর মন্দের ফারাক খুঁজে বের করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারছে। প্রতিবছর অন্তত ১০-২০ জন পাহাড়ি শিক্ষার্থী বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে দেশের বড় বড় সেক্টর সামলাচ্ছে। অবদান রাখছে দেশ গঠনে। এসবের বড় কৃতিত্ব দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর।
পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়ন একটি দীর্ঘ সময় ধরে বিশেষ চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অশান্তির কারণে এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। তবে সেনাবাহিনী বিভিন্ন পর্যায়ে এই সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাহাড়ি অঞ্চলে সেনাবাহিনীর অবদান শুধু শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তারা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। পাহাড়ি অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারের জন্য সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে স্কুল, কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এবং দুর্গম এলাকায় সেনাবাহিনী পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে উন্নত শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক শিক্ষার উপকরণও সরবরাহ করা হয়।
পাহাড়ে শিক্ষার প্রসারে গত কয়েক বছরে ২৫০টির বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়েছে। যেখান থেকে প্রচুর স্কুল শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির দ্বারপ্রান্তে। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ২২০টির বেশি ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনী। এর বাইরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা উপকরণ, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস ও খেলাধুলার সামগ্রী বিতরণ করে পাহাড়ি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদান, শিক্ষা উপকরণসহ নানা সহায়তার পাশাপাশি শুধু রাঙামাটিতেই সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ সহায়তা দিয়ে গড়ে তুলেছে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ জেলা সদরের কাঁঠাল-তলির লকার্স পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, কাপ্তাইয়ের চৌধুরীছড়ার শিশু নিকেতন বিদ্যালয়, নানিয়ারচরে নানিয়ারচর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বগাছড়ি আল আমিন জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়, বগাছড়ি মারকাজুল মাআরিফ হাফেজিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি।
অন্যদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় সেনাবাহিনীর ২০৩ পদাতিক ব্রিগেড ও ২৪ আর্টিলারি ব্রিগেড কর্তৃক এ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার উন্নয়নে গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত ১৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, জেলা সদরের নতুন কুঁড়ি ক্যান্টনমেন্ট হাই স্কুল, গুইমারার শহীদ লেঃ মুশফিক উচ্চ বিদ্যালয়, বাজারপার নৈশ বিদ্যালয়, মহালছড়ির জয়সেনপাড়ার বর্ণমালা আইডিয়াল স্কুল, মাইসছড়ির লেমুছড়ি শান্তিপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়া কালাচাঁদপাড়া রিজিয়ন মডেল বিদ্যালয়, কবাখালী দারুল কোরআন হালিমিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা, ফটিকছড়ির মানিকপুরের বাইন্যাছোলা মানিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রাঙামাটির বাঘাইহাটের সাজেক অদ্বিতি পাবলিক স্কুল, সুজুকিছড়া বীর উত্তম এম এ গাফফার হালদার প্রাথমিক বিদ্যালয়, লংগদুর ইয়ারাংছড়ি সেনামৈত্রী উচ্চ বিদ্যালয় ও কালাপাকুইজ্জা সেনামৈত্রী উচ্চ বিদ্যালয়।
এছাড়া বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুকের চিম্বুক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলীকদম উপজেলার আলীকদম ফয়জুল উলুম মাদ্রাসা, রুপসীপাড়া ইসলামিয়া এতিমখানা ও হাফেজিয়া মাদ্রাসা, পশ্চিম শীলের তোয়া দারুল উলুম নুরানী মাদ্রাসা, নয়াপাড়া সিদ্দিকীয়া দাখিল মাদ্রাসা, মধুঝিরি নূরানী একাডেমি ও এতিমখানা, দারুল হেদায়া তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানা, আলীকদম উত্তর পালং পাড়া মহিউচ্ছুন্নাহ দারুল কোরআন হাফেজখানা ও এতিমখানা, রেফার পাড়া এতিমখানা, ইমাম বোখারী (রঃ) তাহফিজুল কোরআন নুরানী মাদ্রাসা, সাঙ্গু দুর্বার মৈত্রী স্কুল, গোয়ালমারা সাঙ্গু দুর্বার মৈত্রী স্কুল, আলীকদম কিন্ডারগার্টেন এন্ড মৈত্রী স্কুল, জীনামেজু উচ্চ বিদ্যালয়, জানালীপাড়া মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ক্লোরিংপাড়া মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিরিঞ্জা প্রত্যয়ী তেইশ স্কুল, নাইক্ষ্যংমুখ প্রত্যয়ী স্কুল, জীনামেজু টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, আলীকদম কিন্ডারগার্টেন স্কুল, উপজাতি ও মুসলিম কল্যাণ সংস্থা, ক্রানসিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, রুমা উপজেলার রয়েলপাড়া ছাত্রাবাস, হ্যাপিহিল পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাইনখিয়াং পুকুস্থ পুকুরপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রংজাং পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নতুন নকোপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নতুন সুরাহাপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ সহায়তায় স্থাপিত/পরিচালিত হচ্ছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, তিন পার্বত্য জেলায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানে বছরে নিজেদের অর্থের প্রায় ৫৭ লাখ টাকা অনুদান প্রদান করা হয়। যার পুরোটাই পাহাড়িদের শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে খরচ করছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী পরিচালিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভালো ফলের যে চিত্র, তা প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফল প্রকাশের সময় পরিলক্ষিত হয়। তাই দিন দিন সেনাবাহিনী পরিচালিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী পাহাড়ি অঞ্চলের শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। যাতে তারা আধুনিক শিক্ষাদানের কৌশল এবং পদ্ধতিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পরিচালিত নানা কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণ সেশন শিক্ষকদের মেধা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে। যার ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানও উন্নত হচ্ছে দিন দিন।
শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের মূলমন্ত্রে অপারেশন উত্তরণের আওতায় সেনাবাহিনীর শিক্ষার আলো ছড়ানোর যে অসামান্য অবদান, সেটা কোনোভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তিন পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের বসবাস হলেও স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি দূরে ঠেলে দিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণমূলক কাজ করছে সেনাবাহিনী। শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য জেলায় শান্তি আনার পাশাপাশি ভৌত অবকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে এ অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক দৃশ্যমান উন্নয়নে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। পাহাড়ে এখনো অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে। যেখানে সাধারণ কোনো নাগরিকের যাওয়া দুষ্কর। সেখানেও এখন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে সেনা সদস্যরা।
বাংলাদেশ সরকারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে সেনাবাহিনী। বিশেষ করে সেনাবাহিনী কর্তৃক দুর্গম এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দরিদ্র, অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে সহায়তা, বই ও শিক্ষা সামগ্রী প্রদানে ইতোমধ্যেই ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলের অনেক জায়গায় শিক্ষা উপকরণের অভাব ছিল। সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময়ে পাঠ্যবই, স্টেশনারি, কম্পিউটার, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ প্রদান করে এই অঞ্চলের শিক্ষার মান উন্নত করেছে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার লংগদুতে সেনাবাহিনীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে সেখানকার নামকরা দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইয়ারাংছড়ি সেনামৈত্রী উচ্চ বিদ্যালয় এবং কালাপাকুইজ্জা সেনামৈত্রী উচ্চ বিদ্যালয় নামে দুটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ওই অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে সেনাবাহিনী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তবধর্মী ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে সেনাবাহিনী সুশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে পাহাড়ের সার্বিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছে।
২০১৬ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়নে একটি অনবদ্য কাজ করে সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি রিজিয়ন। ওই মাসের ২৭ তারিখ সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল স্কুল ও বহুমাত্রিক সচেতনতামূলক কর্মসূচীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। সেসময় ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনী রুইলুই পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপন করে। দুর্গমতার কারণে স্থানীয় কোনো শিক্ষক পাওয়া যায়নি। তৎকালীন পরিস্থিতির কারণে পার্শ্ববর্তী উপজেলার কোনো শিক্ষক সেখানে শিক্ষাপ্রদানে রাজি হয়নি। তবু পিছপা হয়নি সেনাবাহিনী। কোমলমতি পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে খাগড়াছড়ি সদরে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষকদের দিয়ে সেই বিদ্যালয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়। ততটা সহজ ছিল না এই পথচলা। খাগড়াছড়ি থেকে এতদূরের দূরের বিদ্যালয়ে গিয়ে পাঠদান করাও ছিল দুঃসাধ্য। বিদ্যুতও ছিল না এখনকার মতো। তৎকালীন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে অসাধ্য সাধন হয়। সেনাক্যাম্পে ব্যবহৃত সোলার প্যানেল ব্যবহার করে সেই বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ক্লাস তথা ভিডিও ক্লাসের মাধ্যমে চালু করা হয় ডিজিটাল স্কুল প্রোগ্রাম। খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষকরা ভিডিও ক্লাসে অংশগ্রহণ করে সেসব দুর্গম পাহাড়ে শিক্ষার আলো ছড়াতে সহায়তা করেন। ডিজিটাল স্কুল প্রোগ্রামে খাগড়াছড়ি ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষকবৃন্দ ভিডিও ক্লাসের মাধ্যমে প্রথম শ্রেণি হতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব বিষয়ের পাঠ্যক্রম তৈরি করেন।
সবকিছু ছাপিয়ে, পার্বত্য তিন জেলার কোনো না কোনো উপজেলায় দুর্গম এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বই বিতরণ, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, শিক্ষার্থীদের  উপবৃত্তি প্রদানসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অবদানের কথা এখন নিয়মিত দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলোতেও দেখা যায়। সেনাবাহিনী পাহাড়ি অঞ্চলের মেয়েদের শিক্ষা প্রসারেও বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছে। তারা নারী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যাতে মেয়েরা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তারা সঠিক শিক্ষা লাভ করতে পারে। সেনাবাহিনীর এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে পাহাড়ি অঞ্চলে মেয়েদের শিক্ষার হারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিক্ষাখাতে ব্যাপক অবদান রাখার মাধ্যমে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধেও ভূমিকা রাখছে সেনাবাহিনী। যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাগত কর্মকাণ্ড দূরে সরিয়ে এখন পাহাড়ি শিশুরা বেছে নিচ্ছে স্বাভাবিক জীবন। পাহাড়ি তরুণদের বড় একটি অংশ এখন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে অনিশ্চিত-অন্ধকার জীবনের দিখে ধাবিত না হয়ে বরং কলমকে হাতিয়ার বানিয়ে ছুটে চলেছে দেশ থেকে বিদেশে। দেশের অর্থনীতিতেও রাখছে ব্যাপক অবদান। শিক্ষিত পাহাড়ি সমাজেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
পাহাড়ে গত ২০-৩০ বা ৪০ বছর আগের চিত্র আর এখনকার চিত্র একরকম নেই। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকার শিশুদের দেখা যায় ৫-১০ কিংবা ২০ কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে লেখাপড়া করতে। সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো একদিকে যেমন পাহাড়িদের শিক্ষিত করে তুলছে, অন্যদিকে অস্ত্রবাজি-চাঁদাবাজিসহ সামগ্রিক সন্ত্রাসবাদের পরিসংখ্যানও পাল্টে দিচ্ছে। অস্ত্র ছেড়ে কলম তুলে নেওয়া শিশুদের অস্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা এখন বাস্তবতা। শুধু শিক্ষার আলো পৌঁছানোর কারণে আজ পাহাড় থেকে পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে। পাহাড়ের শিক্ষিত সমাজ এখন যুগ যুগ ধরে চলে আসা অধিকার আদায়ের নামে সন্ত্রাসবাদের কবর চাইছে।
শিক্ষিত এই জাতি গড়ে তুলতে সেনাবাহিনীর সামনে প্রতিবন্ধকতাও কম ছিল না। পথে-পথে সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করে, দুর্গমতা ভেদ করে আর কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের অসহযোগিতা-বিরোধিতাকে পাশ কাটিয়ে আজকের শিক্ষিত পাহাড়ি সমাজ গড়ে তোলা হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা, জনসচেতনতা এবং শিক্ষাবান্ধব নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে শুধু শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়নি, বরং শিক্ষার মান, সুযোগ এবং অ্যাক্সেসও ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। সেনাবাহিনী তার বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করতে সহায়তা করছে। তাদের এই অবদান দেশের সার্বিক শিক্ষাক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
‘সমরে আমরা শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’Ñ এই মূলমন্ত্র বুকে ধারণ করে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর এই জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকুক। এগিয়ে যাক পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা ও শান্তির স্রোতধারা।
লেখক : সেনা কর্মকর্তা

প্যানেল

×