
প্রত্যেক জাতির একটা নিজস্ব মাতৃভাষা আছে। যা দিয়ে সে তার মনের কথা অকপটে ও স্বচ্ছন্দ্যে প্রকাশ করতে পারে। তার কথার মাধুর্য সে তার মাতৃভাষা দিয়ে প্রকাশ করে এবং আত্মতৃপ্তি লাভ করে। বাঙালিদেরও একটি ভাষা আছে যার নাম ‘বাংলা ভাষা।’ ভাষা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সুসংবদ্ধ করে। জাতীয়তাবোধ ও জাতীয়তাবাদের ঐক্য করে বাঁচতে শেখায়। মনের ভাব প্রকাশ করে ভাষার আদান-প্রদান করে। ’
জাতীয়তাবাদ হলো আধুনিককালের রাজনীতির প্রধান শক্তি। একটি জাতি গড়েই উঠে জাতীয়তার ভিত্তিতে। জাতি ও রাষ্ট্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এই জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তার জন্যই মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেয়। এমনকি দুটি বিশ্বযুদ্ধও হয়েছিল জাতীয়তার ভিত্তিতে। ভাষা আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা করে। সেজন্যই বাঙালি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারিতে জীবন দিয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি প্রথম জাতিÑ যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল। সেদিন প্রাণ দিয়েই মান রক্ষা করেছিল বাঙালি। এই ভাষার জন্যই আপামর বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। দ্বিতীয়বার ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে।
জাতীয়তাবাদকে নিয়ে অনেকেই সংজ্ঞায়িত করেছেন। অধ্যাপক লাস্কি বলেন, ‘জাতীয়তাবাদ সাধারণত এক ধরনের মানসিকতা।’ হ্যান্স বলেন, ‘জাতীয়তাবাদ মূলত এক মানসিক অবস্থা, চেতনার এক কার্যক্রম।’ জাতীয়তাবাদ মূলত এক ধরনের চেতনা বিশ্বাস, মানসিক ও অনুভ‚তি। এই বীজমন্ত্রে কারণে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। তারা নিজেদের অন্যান্য জাতি থেকে ভিন্নভাবে দেখে। জাতীয়তাবাদের প্রধান খুঁটি হলো দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম ও ভাষা।
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আমাদের এই উপমহাদেশ। এই দেশের সম্পদের লোভে কত বৈদেশিক বাণিজ্য করার জন্য এসেছে। আরবিয়, আফ্রিকান, মিসরীয়, তুর্কি, ইউরোপীয় আফগান, পর্তুগিজ, ফরাসিদের আগমন। এ দেশের সম্পদ তাদের আকৃষ্ট করেছে। ফলে অনেকে বাণিজ্যের সুবিধা নিয়ে শাসন শোষণ করেছে। কিন্তু কেউ ভাষার ওপর আক্রমণ করেনি। কোনো ভাষা চাপিয়ে দেয়নি। বরং তারাই আমাদের ভাষাকে আয়ত্ত করেছে। সুলতানগণ, মুঘল ও ইংরেজরা ভাষাকে বিদ্রæপ করেনি। তারা যেমন ভাষাকে শিখে নিয়েছে, আমরা তাদের ভাষাকে গ্রহণ করেছি। তাদের অনেক ভাষা মিশে গেছে আমাদের ভাষার সঙ্গে।
১২০৪ সালে ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খলজির ল²ণ সেনকে পরাজিত করে নদীয়া দখলের মাধ্যমে বাংলায় মুসলমান শাসন শুরু হয়। তারপর সুলতান ও মুঘলরা প্রায় ৬শ’ বছর শাসন করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজরা দখল করে এবং কোম্পানি শাসন ও ইংরেজ শাসন শুরু হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাদের শাসন ছিল। একই বছরের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলা পড়ে যায় পাকিস্তানের সঙ্গে। যা পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজ শাসক পরিবর্তন হয়েছিল কিন্তু শোষণ তাদের থেকেও বেশি ছিল পাকিস্তানিদের। তারা প্রথমেই আমাদের ভাষাকে দমিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। বাংলা ভাষা ‘হিন্দুয়ানি ভাষা’ বলে তারা তাদের ভাষা উর্দুকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। মূলত ১৯৩৭ সালেই প্রথম ভাষা নিয়ে একরকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ৪৭’র পর থেকে বড় আকার ধারণ করে। ১১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ঢাকার পল্টন ময়দানে ঘোষণা করেন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার। ২১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জোড়ালোভাবে ঘোষণা দেন, ‘টৎফঁ ধহফ ঁৎফঁ, ংযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ.’ তখন সকল ছাত্র সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করে। শুরু হয় নতুনভাবে সভা, সমাবেশ, মিটিং, মিছিল ও ধর্মঘট। ‘তমুদ্দিন মজলিস’ সর্বপ্রথম বাংলাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। পাকিস্তানিরাও নতুন নতুন নোংরা ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং বাংলাকে আরবি হরফে লেখার উদ্যোগ নেয়। গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষা রাখার আহŸান জানান। তার আহŸান অগ্রাহ্য হয়। ১৯৫০ সালের গণপরিষদের রিপোর্টেও উল্লেখ ছিল, ‘উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে।’ ফলে আন্দোলনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দিন জোরালোভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। ৩০ জানুয়ারি প্রতিবাদ শুরু হয় এবং ৩১ জানুয়ারি ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। একই বছরের ২১ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন করার সিদ্ধান্ত হয়। তখন পূর্ব বাংলার সরকার ছিল নুরুল আমিন। ২০ ফেব্রæয়ারির মধ্যে রাত থেকে ২১ তারিখ সারাদিন ও রাত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ছাত্র সমাজ তা উপেক্ষা করে মিছিল নিয়ে বের হলে পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে। সেখানেই শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিকসহ আরও অনেকেই। সেদিন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়।
ভাষা সৈনিকদের জীবনের বিনিময়ে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। সেই শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। এই ভাষা আন্দোলন আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। একই লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সকল ধর্ম ভেদাভেদ এবং উঁচু নিচু পার্থক্যকে বিলীন করে সুসংবদ্ধ করেছে। এই ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রথম এবং প্রধান বিকাশ। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকল বাঙালি আন্দোলন করেছে, লড়াই করেছে। হিংসা, বিদ্বেষ ও অহংকার ভাষার কাছে ছিল তুচ্ছ। তবুও অনেকে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে এবং ঘৃণার চোখে দেখে। তাদের জবাব মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি, কবি আব্দুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০) বঙ্গবাণী কবিতায় উত্তর দিয়েছেন এভাবেÑ
‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি \
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জোয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায় \’
ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করেছে। কীভাবে আন্দোলন করতে হয় তা শিখিয়েছে। দাবি আদায়ের শিক্ষা দিয়েছে। এর ফলেই আমরা ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা, ৬৮’র ষড়যন্ত্র মিথ্যে মামলা, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান এবং ৭০’র নির্বাচন ও ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের দেশ ‘বাংলাদেশ’। ৫২’র ভাষাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তী আন্দোলনগুলো সফল হয়েছে এবং আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। ভাষাকে যথাযথ সম্মান এবং সঠিক ব্যবহার করার মাধ্যমে ভাষা সৈনিকদের স্মরণ করা উচিত। সেই সকল শহীদ ও সৈনিকদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছি এবং বাংলা ভাষায় প্রাণ ভরে কথা বলতে শিখেছি। ভাষার সঠিক ব্যবহারই ভাষা সৈনিকদের প্রতি যথার্থ সম্মান। তাই ভাষাকে আয়ত্ত করা সকলের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী