ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১ মাঘ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২০:৩০, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ

.

ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মাস। ১৯৭১ সালের এই মাসে বাংলাদেশ তদানন্তীন পূর্ব পাকিস্তানের খোলস থেকে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়। তবে ওই সময়ের নানা গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলোর মধ্যে ৬ থেকে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আলোচনা হয়। তাই আজকের কলামে এই বিষয়ে আলোচনা করব। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার চূড়ান্ত পর্বে।

এই সময়ের ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যই নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৬ থেকে ১০ ডিসেম্বরের ঘটনাগুলো মূলত ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপ, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়করণ এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় সামরিক বাহিনী সমন্বিতভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ইতোমধ্যে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীকে দুর্বল করে ফেলেছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশে যুদ্ধের গতি দ্রুত বদলে যায়। ৬ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে যৌথ বাহিনী বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং কৌশলগত এলাকা দখল করে। বলা বাহুল্য যে, ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেটি তাদের নিজেদের স্বার্থে নাকি মানবিকতার খাতিরে নাকি দুটির মিশেল সে আলাপ বা বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু তাদের বন্ধুসুলভ আচরণের কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের একটি আক্রমণের পর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই সময় কূটনৈতিক এবং সামরিক উভয়ক্ষেত্রেই অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে কাজ করেন। ৬ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী দ্রুত বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়। ভারতের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা অত্যন্ত কৌশলগত ছিল। ৯ ডিসেম্বর মেঘনার ওপর একটি সাহসী হেলিকপ্টার অভিযান পরিচালিত হয়, যা পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। ভারতীয় নৌবাহিনীও বঙ্গোপসাগরে পাকিস্তানি নৌবহরকে ধ্বংস করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। একই সময় ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক মঞ্চে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিশ্চিত করতে সক্ষম হন, যা পাকিস্তান এবং তাদের মিত্রদের পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করে। পাকিস্তান এই সময় একটি চরম সংকটে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন মূলত ঢাকা এবং আশপাশের এলাকায় আটকে পড়েছিল। ৬ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তান ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার চেষ্টা করে। তবে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের সামনে তারা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। পাকিস্তান চেষ্টা করে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কারণ, ভারত এবং মুক্তিবাহিনী কেবল একটি স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির শর্তে রাজি ছিল। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। নিক্সন প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে কূটনৈতিক এবং সামরিক সমর্থন জোগায়। আমেরিকা ৬ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায় এবং ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। এমনকি ৭ ডিসেম্বর ভারতকে প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক সহায়তা থেকে তারা সরে আসে চাপ সৃষ্টির জন্য। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নিক্সন প্রশাসন বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করে। এটি ছিল ভারতের প্রতি একটি স্পষ্ট হুমকি, যদিও এই পদক্ষেপ ভারতের কৌশলগত অগ্রগতিকে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা সে সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয় এবং এটি অনেকাংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরাসরি হস্তক্ষেপকে উসকে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মিত্রে পরিণত হয়। ৬ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সোভিয়েট ইউনিয়ন জাতিসংঘে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত যে কোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে বারবার ভেটো প্রদান করে। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশকে যুদ্ধে হারানোর হীন পরিকল্পনা বারংবার ব্যর্থ হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সামরিক এবং কূটনৈতিকভাবে সমর্থন করে। তারা ভারতকে নিশ্চিত করে যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র বা চীন সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে দাঁড়াবে। এই সমর্থন ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এটি মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক ভারসাম্য তৈরি করে। জাতিসংঘ এই সময় বেশ দুর্বল ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা চালায়। তবে ভারতের দৃঢ় অবস্থান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে জাতিসংঘ কার্যকরভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। জাতিসংঘের কিছু সদস্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের কর্মকা-ের নিন্দা জানালেও এটি মূলত একটি কূটনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিষ্ক্রিয় ছিল।
৬ থেকে ১০ ডিসেম্বর সময়কাল মুক্তিযুদ্ধের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময় ভারত ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণ পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকা ছিল জটিল এবং বহুমুখী। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এইদিন ভারত এবং ভুটান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় এ ঘোষণা দেন, যা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়। এ সময় ভারতের বিভিন্ন শহরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। স্বীকৃতির কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের এই সিদ্ধান্তকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। এই স্বীকৃতি কেবল রাজনৈতিক গুরুত্বই নয়, কূটনৈতিকভাবেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত করে। ৬ ডিসেম্বর ফেনী, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়। যশোরে পাকিস্তানি সেনারা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালালে মুক্তিবাহিনী জয়লাভ করে। মেহেরপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের টানা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পরাজিত হয়। ঝিনাইদহ, সুনামগঞ্জ এবং ছাতকও মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে হানাদারমুক্ত হয়। এদিকে ৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আর্জেন্টিনার নেতৃত্বে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বার ভেটো দেয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এদিন ঘোষণা দেয়, মুজিবনগর থেকে শিগগির ঢাকায় সরকারি কার্যক্রম স্থানান্তর করা হবে। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় আত্মসমর্পণ।’ এ বক্তব্য মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মনোবল আরও বাড়িয়ে দেয়। ৭ ডিসেম্বর কুমিল্লা, সিলেট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী একযোগে পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হঠতে বাধ্য করে। কুমিল্লার বিমানবন্দর দখল এবং সিলেট বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ যৌথ বাহিনীর হাতে আসায় পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ত্বরান্বিত হয়। এছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকা থানায় মুক্তিবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়ে জয়লাভ করে। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য আরও সুদৃঢ় হয়। সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হানাদারমুক্ত হয়। এ সময় প্রবাসী সরকারের নেতারা ঘোষণা করেন যে, মুজিবনগর থেকে ঢাকায় কার্যক্রম স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শিগগির শুরু হবে।
৯ ডিসেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আশা প্রকাশ করেন যে, কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা মুক্ত হবে। তিনি বলেন, ঢাকার পতনের মধ্য দিয়ে মাতৃভূমি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত হবে। মুক্তি অর্জনের পরও পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে গেলে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানেরা পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। তিনি বক্তব্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশের জনগণ ও নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অভিনন্দন জানান। হুমায়ুন রশীদ বলেন, ‘যদিও ইয়াহিয়া খান আমাদের নেতাকে বন্দি করেছেন, তার মন আমাদের মধ্যে রয়েছে এবং আমাদের মন তার মধ্যে। কোনো শক্তি এই সংযোগ ধ্বংস করতে পারবে না।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একইদিন লোকসভায় জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে ‘অবাস্তব’ উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য অর্জনে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এতদিন আঘাত সহ্য করেছি, এবার পাল্টা আঘাত দিচ্ছি।’ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বলেন, ‘উপমহাদেশে শিগগির শান্তি ফিরে আসবে। আমরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছি। পাকিস্তানের সামরিক শাসন সহ্য করে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছি, কিন্তু তারা এক কোটি শরণার্থী ভারতে পাঠিয়ে আমাদের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’ ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জানান, ‘যশোর, শ্রীহট্ট ও কুমিল্লায় পাকিস্তানি বাহিনী পরাস্ত হয়েছে। শিগগির চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগোচ্ছি।’ ভারত সরকার বাংলাদেশে প্রশাসনিক সহায়তার জন্য বি আর গুপ্তকে মনোনীত করে। তার নেতৃত্বে কর্মকর্তারা ঢাকা মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে দায়িত্ব পালন করবেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন এক ভাষণে জনগণকে ‘ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর’ আহ্বান জানান। তিনি অভিযোগ করেন, ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কারণে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। জাতিসংঘ এখন কেবল একটি পুতুল মাত্র।’ এদিকে জাতিসংঘ থেকে ফিরে পাকিস্তানের প্রতিনিধি মাহমুদ আলী অভিযোগ করেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছে।’ এদিন গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, খুলনার কপিলমুনি, কুষ্টিয়ার কুমারখালীসহ আরও বহু স্থান পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়। ১০ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক ভাষণে সব ধর্মের মানুষের সাম্য ও মহান আদর্শ রক্ষার সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। একইদিনে ঢাকায় রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবী হত্যার সূচনা হয়, যেখানে আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মহলে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের আলোচনা চললেও যুদ্ধ পরিস্থিতি থামেনি। দেশজুড়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী একযোগে আক্রমণ চালিয়ে মাদারীপুর, ভোলা, নড়াইল, ময়মনসিংহ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও অন্যান্য এলাকা মুক্ত করে। খুলনা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল, যেখানে পাকিস্তানি সেনারা একের পর এক পরাজিত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনীর টানা হামলায় চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। এসব ঘটনা ১০ ডিসেম্বরকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এই সময় আন্তর্জাতিক নানা পক্ষ বাংলাদেশের যুদ্ধ বিষয়ে কথা বলা শুরু করে। নিউইয়র্কে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন জানান, ‘উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ভারত নয়, পাকিস্তানই দায়ী। বৈষম্য ও নিপীড়নের মাধ্যমে তারা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।’ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ছিল উত্তাল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-আরব সংঘাত এবং ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের মিত্রতা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়।

তবে ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের বিপরীতে বাংলাদেশের যুদ্ধ ছিল অপেক্ষাকৃত দ্রুত বিজয় অর্জনের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সমসাময়িক অন্যান্য যুদ্ধের কিছু মিল ও অমিল আমরা চিহ্নিত করতে পারি। যেমন- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধÑ উভয়ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। দুই যুদ্ধেই আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং ভেটোর রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রায় দুই দশক স্থায়ী হলেও মুক্তিযুদ্ধ মাত্র নয় মাসে বিজয় অর্জন করে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের সুসংগঠিত নেতৃত্ব এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহণ যুদ্ধকে দ্রুত শেষ করতে ভূমিকা রাখে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, ৬ থেকে ১০ ডিসেম্বর এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের অকার্যকারিতা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে কূটনৈতিক চাপ সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধ একটি চূড়ান্ত বিজয়ের পথে এগিয়ে যায় মূলত আমাদের গেরিলা যোদ্ধা, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সরাসরি হস্তক্ষেপে। ৬ থেকে ১০ ডিসেম্বরের ঘটনা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাভাস, যা কয়েকদিনের মধ্যেই পরিণত হয় বাস্তবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের দিনপঞ্জিগুলোকে আমাদের মোহমুক্ত হয়ে পাঠ করার গুরুত্ব অপরিসীম বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। 
ডিসেম্বর ১০, ২০২৪

[email protected]

জোবায়ের আহমেদ

×