মানব ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই অহিংসা অর্থাৎ সহিংসতা পরিহারের নীতি
মানব ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই অহিংসা অর্থাৎ সহিংসতা পরিহারের নীতি সর্বদা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। বহু পুরনো ধর্ম ও সংস্কৃতিতে অহিংসাকে পরম ধর্ম বা উচ্চতর আদর্শ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আধুনিক সময়ে মহাত্মা গান্ধী এই নীতির প্রচার ও প্রসার করেছেন, যা তাকে একটি অনন্য অবস্থানে পৌঁছে দেয়। গান্ধীজির জীবন ও কর্মে অহিংসা এতটাই মূর্ত হয়েছিল যে, এটি শুধু তাঁর মতবাদ বা রাজনৈতিক কৌশল ছিল না, বরং এটি তার অস্তিত্বেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান সময়ে যখন পৃথিবীজুড়ে সহিংসতা, হিংসা ও প্রতিশোধের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন গান্ধীর অহিংস নীতি পুনর্বিবেচনা করা ও অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মহাত্মা গান্ধী বিশ্বাস করতেন সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থেকে যেকোনো ধরনের পরিবর্তন বা সমাধান অর্জন করা সম্ভব, যেখানে সহিংসতার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর এই বিশ্বাসের মূল ভিত্তি ছিল ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ বা চূড়ান্ত ধর্মের ধারণা। যার মানে হলো ন্যায় ও নৈতিকতার পথে থেকে এমন কাজ করা যাতে কারও প্রতি সহিংসতার অবকাশ না থাকে। অহিংসা কেবলমাত্র শারীরিক সহিংসতা থেকে বিরত থাকা নয়, এটি মানসিক ও মৌখিক হিংসার বিরুদ্ধেও এক শক্তিশালী অবস্থান। গান্ধীজির মতে, প্রকৃত ধর্ম হলো এমন এক নৈতিকতা অনুসরণ করা যা সকল জীবের প্রতি সমানভাবে সদয় ও সহানুভূতিশীল থাকে।
গান্ধী অহিংসার মাধ্যমে নিজেদের চাওয়া-পাওয়া পূরণের জন্য ক্ষমা ও সহমর্মিতার চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অহিংসার এই আদর্শ মানুষকে তার নিজের ক্রোধ, অহংকার ও প্রতিহিংসার অনুভূতি দমন করতে শেখায়, যা তাকে আরও শান্তিপূর্ণ ও শক্তিশালী করে তোলে। গান্ধীজির এই নীতি ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে শুরু করে জাতীয় আন্দোলন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অহিংসার মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে স্থায়ী সমাধানের জন্য তার এই আহ্বান এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে, যা মানবজাতিকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সমতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
অহিংসা নীতির কার্যকারিতা ও প্রাসঙ্গিকতা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে, যা বিশ্বকে দেখিয়েছে যে, শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অস্ত্রের চেয়ে শান্তিপূর্ণ পন্থা অধিক কার্যকরী হতে পারে। তিনি প্রমাণ করেছেন, জনসাধারণের ঐক্য, সহমর্মিতা ও সংহতির শক্তিতে সহিংসতা ছাড়াই সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব।
অহিংসা একটি নৈতিক পন্থা হিসেবে মানুষের সম্মান ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার সুযোগ দেয়, যা সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। বর্তমান বিশ্ব নানা সংকট যেমন ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন, রাজনৈতিক বিরোধ, বর্ণবৈষম্য, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সম্মুখীন। এই প্রেক্ষাপটে গান্ধীজির অহিংস নীতি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
অহিংসা অনুসরণের মাধ্যমে প্রতিশোধের পরিবর্তে সংলাপ, বোঝাপড়া ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে সমাধান খুঁজে বের করার পথ প্রশস্ত হয়। অহিংসার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণে এই নীতি মানুষকে তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়, যাতে শত্রুতা ও বিভাজন কমে আসে। এভাবে অহিংসা নীতির চর্চা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে।
মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির গুরুত্ব আধুনিক বিশ্বে আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। অস্থির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অহিংসার এই নীতি কেবল সমস্যার সমাধানের উপায়ই নয়, বরং তা একটি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে রাজনৈতিক বিরোধ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে সহিংসতা বেড়ে চলেছে। এই ধরনের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে অহিংস আন্দোলন একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ হতে পারে। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা আমেরিকায় সিভিল রাইটস মুভমেন্টের মতো অহিংস আন্দোলনগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়েছে। গণতন্ত্রে জনগণের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে অহিংস পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন আনা সম্ভব, যা সহিংসতার কুফল এড়িয়ে দেয়।
বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গান্ধীর অহিংস নীতি সব ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সহনশীলতার ওপর জোর দেয়। এই নীতি সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক ও বোঝাপড়া বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে, যা ধর্মীয় বিরোধ মেটাতে কার্যকর।
অহিংস নীতি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পারিবারিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে সহিংস আচরণের পরিবর্তে সংলাপ ও সহানুভূতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, যা সম্পর্ককে দৃঢ় করে তোলে এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখে।
আধুনিক বিশ্বে অনেক দেশ আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব এবং আন্তর্জাতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে অহিংস নীতি অনুসরণের মাধ্যমে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব তৈরি করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন বা বিশ্ব শান্তির মতো সংকটগুলোর সমাধানে অহিংসা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সমাধান খোঁজা সম্ভব, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ প্রশস্ত করবে।
অহিংস নীতি তাই বর্তমান সময়ে শুধু একটি নৈতিক আদর্শ নয়; এটি ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক স্তরে শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি।
আধুনিক বিশ্বে, যেখানে প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন একে অপরকে সংযুক্ত করেছে, সহিংসতার ক্ষতিকর প্রভাব আরও তীব্র ও বিস্তৃত আকার ধারণ করছে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে যে কোনো সহিংস ঘটনার খবর মুহূর্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা নীতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
গান্ধীর ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ (১৯৩০), যা ডান্ডি মার্চ ও ডান্ডি সত্যাগ্রহ নামেও পরিচিত, ছিল ঔপনিবেশিক ভারতে অহিংস নাগরিক অবাধ্যতার একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। এই অহিংস আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে সহিংস প্রতিশোধের চেয়ে অহিংস প্রতিরোধ শক্তিশালী ও কার্যকর হতে পারে। অহিংসার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য বোঝাপড়া, সংলাপ ও মানবিকতার প্রয়োজন, যা কেবলমাত্র শক্তিশালী এবং পরিপক্ব মনোভাব থেকে আসতে পারে। অহিংসা কেবল শারীরিক সহিংসতা থেকে বিরত থাকার উপায় নয়, বরং এটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা ও সংলাপের মাধ্যমে মানুষে মানুষে বিভাজন দূর করে সম্পর্ক দৃঢ় করার এক শক্তিশালী পদ্ধতি।
আধুনিক সমাজে জাতি, ধর্ম, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বিরোধসহ বিভিন্ন সংকট অহিংস পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। আজকের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অহিংসা তাই কেবল নৈতিক আদর্শ নয়, এটি সামাজিক উন্নয়নের জন্য একটি কার্যকর নীতি, যা সত্যিকার শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে নিয়ে যেতে পারে।
অহিংসা শুধু একটি নীতি নয়, এটি আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং বৈশ্বিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার একটি শক্তিশালী উপায়। মহাত্মা গান্ধীর এই নীতি বিশ্বব্যাপী শান্তি, মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী প্রভাব ফেলেছে। অহিংসা মানুষের মধ্যে একতা ও শান্তির বোধ জাগিয়ে তোলে এবং সব ধরনের বিভেদ দূর করে সমাজে একটি মানবিক ও সমতার ভিত্তি গড়ে তোলে।
অহিংসা মানবিক মূল্যবোধের মূলে অবস্থান করে, যা সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। এটি সহিংস প্রতিরোধের বিপরীতে মানুষের মধ্যে একটি নৈতিক দায়িত্ববোধ তৈরি করে, যা কেবল সামাজিক শান্তি নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি স্থাপনেও অবদান রাখে। অহিংসা শুধু শারীরিক সহিংসতার বিরোধিতা করে না, এটি মানসিক ও মৌখিক হিংসারও প্রতিরোধ করে।
এতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি হয়, যা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার ভিত্তি দৃঢ় করে। গান্ধীর অহিংসা নীতি শক্তির একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, যা প্রতিশোধের পরিবর্তে সংলাপ ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রতিরোধের পথ খুঁজে পায়। এটি সামগ্রিক সংঘাতময় পরিস্থিতিতে নৈতিক ও মানবিক সমাধানের বিকল্প পথে পরিচালিত করে, যা আমাদের সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য অপরিহার্য।
অহিংসা কেবল একটি আদর্শ নয়, এটি শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে। বৈশ্বিক সংকটের ক্ষেত্রে গবেষণা ও আলোচনার মাধ্যমে এই নীতির প্রয়োগ দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে, যা মানুষকে অহিংসার শক্তি ও মর্ম উপলব্ধি করায়। এভাবে, অহিংসা কেবল একটি নিরাময়কারী নীতি নয়, এটি সমাজ ও বিশ্বের উন্নয়নে কার্যকর একটি শক্তি, যা মানবিকতা, সহানুভূতি ও শান্তি স্থাপনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
আজকের সহিংস ও সংঘাতময় বিশ্বে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা নীতি বাংলাদেশের মতো সমাজের জন্য এক আলোকবর্তিকার মতো কাজ করতে পারে। বর্তমান সময়ের সমাজে যখন নৈতিক অবক্ষয় ও বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে, তখন অহিংসার পরম ধর্মের পথেই সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বর্তমান বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্র ও সমাজের উচিত মহাত্মা গান্ধীর অহিংসার শিক্ষাকে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করে সহমর্মিতা, সংহতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাওয়া। অহিংসা সত্যিকারের পরম ধর্ম, যা শুধু সমস্যার সমাধানই এনে দেয় না, বরং এটি আমাদের মনুষ্যত্বের আসল অর্থের দিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়। সমাজে সহমর্মিতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য অহিংসাই একমাত্র পথ।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়