.
দখলদার ইসরাইলে ছোড়া প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ৯০ শতাংশই নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে বলে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) জানিয়েছে। তেহরান গত মঙ্গলবার রাতে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এর মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য ছিল নেভাতিম বিমান ঘাঁটি। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম সিএনএন হামলার ভিডিও বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, নেভাতিম ঘাঁটিতে অন্তত কয়েক ডজন মিসাইল ছুড়েছে ইরান। যেগুলো একের পর এক ঘাঁটিতে আঘাত হানতে দেখা গেছে।
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মুখে ইসরাইলি নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা জরুরি বাংকারে আশ্রয় নেয়। ইসরাইল সরকার দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইরানের সিনিয়র কমান্ডারদের হত্যার জবাবে দ্বিতীয়বারের মতো দখলদার ইসরাইলে ‘বীরত্বপূর্ণ’ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এদিকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের ভূখন্ডে স্থল অভিযান শুরুর পাশাপাশি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কেও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। আবার গত রবিবার ইসরাইল সেনাবাহিনী পশ্চিম ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরাইল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাস ইসা ও হোদেইদা সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্পকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের গাজা ও লেবাননে ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ এবং হামাস, হিজবুল্লাহ ও আইআরজিসির নেতাদের গুপ্তহত্যার জবাবে তারা ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমাদের মদদে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিতেই ইসরাইলি সৈন্যরা লেবাননে প্রবেশ করেছে। গাজায় চলমান ইসরাইলি গণহত্যার প্রতিবাদে ইরাক, ইরান, লেবানন ও ইয়েমেনের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এর জেরেই ইসরাইলের সঙ্গে দেশগুলো সংঘাতে জড়াচ্ছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ইসরাইল পৌঁছাতে পারবে না। ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়ায় বুধবার রাতেই মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী হামলা চালানো হবে বলে ইসরাইল হুঁশিয়ারি দিয়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগেরি এক বিবৃতিতে বলেন, ইরান গুরুতর কাজ করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যকে গুরুতর উত্তেজনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আজ রাতেই ইরানকে এ কর্মকান্ডের পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ইরানের হামলার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের নজর এখন ইরান-ইসরাইল পরিস্থিতির দিকে। ইরানের এবারের হামলার জবাবে ইসরাইলের পদক্ষেপ কী হবে সেটি নিয়েও বিশ্ব উদ্বিগ্ন। ইরান থেকে ছোড়া মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্যে কয়েকটি ঠেকাতে সক্ষম হয় ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম। এর আগে ইরানের জনগণকে উদ্দেশ করে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় ইরানের শাসকদের বিরুদ্ধে দেশটির জনগণকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ইরান হামলা চালায়। হামলার জবাবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, যারাই তাদের আঘাত করবে, তাদের পাল্টা আঘাত করা হবে। এর আগে গত এপ্রিলে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে তেল আবিবের প্রাণঘাতী হামলার জবাবে ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল তেহরান। এর পাঁচ মাস পর আবারও ইসরাইলে হামলা চালাল ইরান। ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার সময় ইসরাইলজুড়ে সাইরেন বেজে ওঠে।
বিস্ফোরণের শব্দ জেরুজালেম এবং জর্দান রিভার ভ্যালি থেকে শব্দ শোনা গেছে। ইসরাইলিরা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়েছে। এতে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানায়, বিপুলসংখ্যক ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করা হয়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের মুখপাত্র বলেছেন, এই হামলার পরিণতি ভোগ করতে হবে ইরানকে।
মধ্যপ্রাচ্যে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও তেহরানের সঙ্গে ইসরাইলের দ্বন্দ্বের মূল কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তিনি আঞ্চলিক উত্তেজনা ও যুদ্ধের জন্য ‘যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু ইউরোপীয় দেশকে’ দোষারোপ করেছেন। তিনি বলেন, তারা মিথ্যাভাবে দাবি করে যে, তারা এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে এসেছে। বরং এ অঞ্চলে শান্তি চাইলে তাদেরই এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত। তারা যদি এই অঞ্চলে তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করে, তাহলে নিঃসন্দেহে এসব সংঘাত সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে যাবে এবং এখানকার মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। তিনি ইসরাইলে আরও বড় হামলার হুমকি দিয়েছেন। তিনি লেখেন, ইহুদিবাদী শাসকের জীর্ণ ও ক্ষয়িষ্ণু দেহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ফ্রন্টের আঘাত আরও শক্তিশালী ও বেদনাদায়ক হবে। ইরানের মিসাইল হামলার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইরান বড় ভুল করেছে।
তারা এর মূল্য দেবে। তবে তিনি দাবি করেন যে, ইরানের হামলা ব্যর্থ হয়েছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কল্যাণে ইরানের হামলা নস্যাৎ করা সম্ভব হয়েছে। ইরানের হামলার পর নিজস্ব নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে তিনি বৈঠকে বসেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক জ্যাক সুলিভান বলেছেন, দেখে মনে হচ্ছে তাদের হামলা ব্যর্থ এবং অকার্যকর ছিল। এই হামলার কঠোর পরিণতি এবং ইসরাইলের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবে বলে তিনি জানান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার বলেছেন, আমরা ইসরাইলের পাশে আছি এবং এই আগ্রাসনের মুখে ইসরাইলের নিজেদের রক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছি।
ইরানের হামলার পর পর আকাশপথ বন্ধ করে দেয় ইসরাইল। এ ছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরাক, লেবানন ও জর্দানও তাদের আকাশপথ বন্ধ করে দেয়। আইআরজিসি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসলামিক উম্মাহ্, অসাধারণ প্রতিরোধ ফ্রন্ট ও ইসলামিক ইরানের সাধারণ জনগণ, ইসলামিক রিপাবলিকের কর্মকর্তা ও সামরিক কমান্ডাররা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে অনুযায়ী অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতায় পূর্বের ঘোষণা মতো আইআরজিসি ‘অপারেশন ওয়াদে সাদিক-২’ বাস্তবায়ন করেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই অভিযানে দখলকৃত ভূখ-ে তাদের (ইসরাইল) গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে ইরানের সন্তানরা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করেছে। কিছু বিমান ও রাডার ঘাঁটি, ষড়যন্ত্র রটানোর কেন্দ্র ও প্রতিরোধের নেতা বিশেষ করে ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহ লেবাননের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ, ফিলিস্তিন ও আইআরজিসি কমান্ডারদের হত্যার পরিকল্পনা কেন্দ্রগুলোতে হামলা করা হয়েছে।
সবচেয়ে উন্নত ও আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সেই আঞ্চলে ৯০ শতাংশ মিসাইলই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ইসলামি রিপাবলিকের গোয়েন্দা কার্যক্রম ও কর্মক্ষমতা দেখে জায়োনিস্ট শাসন ভীত হয়ে পড়েছে। আইআরজিসির দাবি, এই অভিযান আত্মরক্ষার বৈধ অধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। শত্রুপক্ষ কোনো বোকামি করলে, সেটার জবাব আরও কঠিন ও বিধ্বংসী হবে। এদিকে ইরানের প্রেসডিন্টে মানুদ পেজেশকিয়ান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, মঙ্গলবার রাতের হামলা ইরানের সামর্থ্যরে ‘ঝলক’ মাত্র। ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়াবেন না। উল্লেখ্য, লেবাননে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক অভিযানের জবাবে ইসরাইলে এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এদিকে বৃহত্তর সংঘাতের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরান বুধবার জানিয়েছে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শেষ হয়েছে। তবে ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেহরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এতে করে একটি বিস্তৃত যুদ্ধের আশঙ্কা তীব্র হয়েছে। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা সহায়তায় নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর আগে ইরানের তরফ থেকে হামলার বিষয়ে ইসরাইলকে সতর্ক করেছিল ওয়াশিংটন। হামলার প্রায় এক ঘণ্টা পর ইসরাইল সেনাবাহিনী ঝুঁকি কেটে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
নিরাপত্তা পরিষদে লেখা চিঠিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন অভিযোগ করেন, তার দেশকে ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করছে ইরান। একই সঙ্গে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত ইরানের নিন্দা জানাতে এবং দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসকে একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ক্রমবর্ধমান সংঘাত মোকাবিলায় বুধবার মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে একটি বৈঠকের সময় নির্ধারণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায় কিনা তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। কারণ, সামরিক ক্ষমতার দিক থেকে তুলনা করলে দেখা যায়, দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ইরানের অবস্থান ১৪তম এবং ইসরাইলের অবস্থান ১৭তম। ইসরাইলের ওপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নিন্দা জানিয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তিনি জানিয়েছেন, ইরানের হুমকি মোকাবিলায় মধ্যপ্রাচ্যে ফ্রান্স তার সামরিক সংস্থান সুসংহত করেছে। একইসঙ্গে লেবাননে ইসরাইলিদের সামরিক অভিযান যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এলিসি প্যালেস থেকে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, লেবাননে অনেক বেসামরিক নাগরিক ইতোমধ্যেই হামলার শিকার হয়েছেন এবং দ্রুত অভিযান বন্ধ করে লেবাননের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখন্ডতা পুনরুদ্ধার করা উচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত লেবানন ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল।
দেশটির ওপর এখনো ফরাসি কর্তৃপক্ষের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের ওপর ইসরাইলি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইসরাইলি ভূখন্ডে প্রবেশের ক্ষেত্রে তাকে ‘পারসনা নন গ্রাটা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাটজ জানিয়েছেন, মঙ্গলবার ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ‘দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা’ জানাতে গুতেরেস ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণে তাকে ইসরাইলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। কাটজ জাতিসংঘের প্রধানকে ইসরাইলবিরোধী এবং সন্ত্রাসবাদী ও খুনিদের সমর্থন দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, আগামী প্রজন্মের জন্য গুতেরেসকে জাতিসংঘের ইতিহাসে একটি কলঙ্ক হিসেবে স্মরণ করা হবে। ইরানের হামলার পরপরই মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ক্রমবর্ধমান হওয়ার নিন্দা জানিয়ে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান গুতেরেস।
ইসরাইলের মিত্র অনেকেই ইরানে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর আক্রমণ চালানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। ইরান এখন ‘থ্রেশহোল্ড স্টেট’; অর্থাৎ তাদের নিকট পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার সব উপাদান আছে। ইসরাইলের কয়েকজন রাজনীতিবিদ ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প এবং তেলের অবকাঠামোতে আঘাত হানার জন্য এখন এটিকে সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেছেন, আমাদের এখনই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে হবে। ইরানের মদতপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সংঘাত সরাসরি তেহরানের সঙ্গে যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে চান। এ পর্যন্ত তার লক্ষ্য ছিল গাজা আক্রমণ করে হামাসকে দুর্বল করা এবং বিশেষ করে নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে হিজবুল্লাহর নেতৃস্থানীয় কমান্ড কাঠামো ধ্বংস করা। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোর বলেছে, ইসরাইলি বোমা হামলায় লেবাননে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহ এবং ইরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ইরান এই হামলা করেছে। ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রশংসা করে গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস বলেছে, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া হত্যার প্রতিশোধ নিতে এই হামলা চালানো হয়েছে। এর জবাবে ওয়াশিংটন বলেছে, মঙ্গলবারের হামলার জন্য ইরান ‘গুরুতর পরিণতির’ সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। এটা নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরাইলের সঙ্গে তারা কাজ করবে। ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাত সম্প্রসারণের বিষয়ে সতর্ক করার পর, এবার অঞ্চলটিতে মার্কিন বিমান সহায়তার সক্ষমতা বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি সেখানে সেনা মোতায়েনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতিও নিচ্ছে দেশটি।
ওয়াশিংটন ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে এবং এর যুদ্ধ জাহাজ ইসরাইলের দিকে ছোড়া কিছু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে। পেন্টাগনের মুখপাত্র মেজর জেনারেল প্যাট্রিক রাইডার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইরান ও ইরানসমর্থিত অংশীদার ও সশস্ত্র প্রতিরোধ যোদ্ধাদের এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে বা সংঘাতের সম্প্রসারণ করা থেকে বিরত রাখতে বদ্ধপরিকর যুক্তরাষ্ট্র। তিনি সতর্ক করেন, যদি ইরান বা দেশটিকে সমর্থনকারী গোষ্ঠী এই সময়টি কাজে লাগিয়ে আমেরিকান কর্মী বা এই অঞ্চলের স্বার্থকে লক্ষবস্তু করার জন্য ব্যবহার করে, তবে আমাদের জনগণকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র নেবে। এর আগেও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে বড় ধরনের পাল্টা হামলা থেকে বিরত রেখেছিল। তবে এবার নেতানিয়াহু কঠোর জবাব দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। অন্যদিকে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বলেছে, ইসরাইল এই হামলার পাল্টা জবাব দিলে তেহরানের জবাব আরও ‘মারাত্মক এবং ধ্বংসাত্মক’ হবে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি এক্স-এ এক পোস্টে বলেছেন, ইসরাইলি সরকার আরও প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত না নিলে আমাদের পদক্ষেপ শেষ। তবে এমন পরিস্থিতি হলে আমাদের প্রতিক্রিয়া শক্তিশালী এবং আরও শক্তিশালী হবে।
এদিকে পশ্চিমা মিত্রদেশ হিসেবে পরিচিত ইসরাইলের সীমান্ত রাষ্ট্র জর্দান বলছে, তারা কারও যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে না। গত এপ্রিলে ইরান যখন ইসরাইলে হামলা চালিয়েছিল, তখন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে সাহায্য করেছিল জর্দান। ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক বুর্কু ওজচেলিক বলেন, এই ধরনের হামলা উত্তেজনা বাড়ানোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং এর ফলে অপ্রত্যাশিত ঘটনার চক্র শুরু হতে পারে; যা পশ্চিমা স্বার্থকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও একটি সামরিক অভিযানের পাল্টা হামলায় নতুন সংঘাত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে যে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশে^র নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলবে। তাই বৃহত্তর স্বার্থে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়