ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

সম্প্রীতি সুরক্ষায় সরকার

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২১:২২, ১১ অক্টোবর ২০২৪

সম্প্রীতি সুরক্ষায় সরকার

.

আবহমান বাংলার স্বরূপ পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-অঞ্চল নির্বিশেষে বাঙালি জাতি এক ও অভিন্ন সংস্কৃতিতে বিশ্বাসীধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবারঐতিহ্যিক শাশ্বত নান্দনিক ধারণায় সমুজ্জ্বল জাতির সম্প্রীতির ইতিহাস দীর্ঘ প্রাচীনসকল ধরনের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও গুজব সন্ত্রাসকে সংহার করে প্রত্যেকেই যার যার ধর্ম মতে প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠান-উসব সাবলীল ধারায় উপভোগ করে আসছেসাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার যুগান্তকারী সফল ও সার্থক গণঅভ্যুত্থানের অনুপম ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার

শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসদৃঢ়তার সঙ্গে তিনি ব্যক্ত করেছেন ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যবিহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কোনো বিভাজনে দেশ নয়, বরং সমতার ভিত্তিতে সকল নাগরিকের অধিকার-নিরাপত্তা ও সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই বর্তমান সরকারের অঙ্গীকাররাজনৈতিক পটপরিবর্তনে স্বল্প সময়ের জন্য আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কিছুটা অসংগতি বিরাজ থাকলেও বর্তমানে বহুলাংশেই তা নিয়ন্ত্রিত

চলতি মাসের ৯ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আনন্দ উসব শারদীয় দুর্গপূজাবিগত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উদ্বেগ-উকণ্ঠা পরিলক্ষিত

কতিপয় দুর্বৃত্তদের নষ্টামির কারণে তারা ও তাদের মন্দিরসমূহ যসামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়উল্লেখ্য, প্রেক্ষাপটে শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়ে নিরাপত্তার শঙ্কা প্রকাশ পেলেও সরকারের চলমান যৌথ অভিযানে সকল বিশৃঙ্খলা দমন করা হয়েছেদেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে পূর্ণাঙ্গ নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে পূজা উদ্যাপন করার আহ্বান সর্বত্রই সমাদৃতদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও আশঙ্কার যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসকে প্রতিহত করার প্রতিশ্রুতি উচ্চারিতপবিত্র ইসলামের অমিয় নির্দেশনা পর্যাপ্ত ধারণ করেই মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ তাদের পাশে থেকে পূজা উসব সর্বাঙ্গীণ সফল করার আশ্বাস দিয়েছেনভয়ভীতি প্রদর্শন বা দমন-নিপীড়নের বেড়াজাল থেকে শারদীয় দুর্গাপূজাকে সামগ্রিক উসবমুখর রাখতে সরকারের সঙ্গে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধচিরায়ত সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বন্ধনে বাংলাদেশের মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের অভূতপূর্ব সম্পর্কে ফাটল ধরানোর যে কোনো উস্কানি প্রত্যাখ্যাত

এটি সর্বজনবিদিত যে, পবিত্র ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্মএর প্রতিটি শিক্ষায় রয়েছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-শান্তির অপূর্ব সম্মিলনইসলাম ধর্মের অন্যতম মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব হলো ধরিত্রীর প্রতিটি মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানএই স্বাধীনতা কেবল ধর্মবিশ্বাস লালন-পালন করার স্বাধীনতা নয়বরং ধর্ম না করার বা ধর্ম বর্জনের স্বাধীনতাও এর অন্তর্ভুক্ত

ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে কারও ওপর আক্রমণ-গালমন্দ করা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া-সহিংসতা পবিত্র ইসলামে বর্জনীয়শুধু তাই নয়; অমুসলিমদের উপাসনালয়েও হামলা চালানোকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছেমহাগ্রন্থ কুরআনে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যাদের উপাস্যরূপে ডাকে তোমরা তাদের গালমন্দ করো নানতুবা তারা শত্রুতাবশত না জেনে আল্লাকেই গালমন্দ করবে’ (সুরা আন আম, আয়াত:১০৮)পক্ষান্তরে একজন প্রকৃত মুসলমান দ্বারা অন্য কেউ কষ্ট পাবে এটিও গ্রহণযোগ্য নয়একজন মুসলমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদ, সে-ই প্রকৃত মুসলিম’ (বুখারি)এছাড়া ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জান-মালের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও মুসলিমদের দায়িত্বএ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ভিন্নধর্মী নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না যেটি ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়’ (বুখারি শরিফ, হাসিদ : ২৯৯৫)  

বিভিন্ন ধর্মীয় উসব বা ঈদ-পূজাপার্বণ-আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি বাঙালি সংস্কৃতি-কৃষ্টির অনন্য বৈশিষ্ট্যরূপে এখনো অতিশয় দৃশ্যমানচলমান শারদীয় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে অনিন্দ্য সুন্দর আনন্দধারায় সমগ্র জাতি উদ্ভাসিতকাল-পরিক্রমায় ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে প্রতিবছরের ন্যায় শরকালের সাদা মেঘ ও প্রকৃতির কাশফুল অকাতরে এ বছরও শারদীয় দুর্গাপূজার সার্বিক আয়োজনকে অবগাহন করছেহিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উসবে শুভ মহালয়ার দিন-ক্ষণ থেকে চন্ডীপাঠের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবী দুর্গাকে

ঢাকের তালে তালে বাজনা বাজিয়ে পূজা-অর্চনায় দেবীর আরাধনা সর্বজনীন উসবে পরিণত হয়েছে পূজামন্ডপ কেন্দ্রিক এলাকাজুড়েসনাতন ধর্মের পঞ্জিকা মতে, জগতের সামগ্রিক মঙ্গল কামনায় এবার দোলা বা পালকিতে চড়ে দেবী দুর্গার মর্ত্যলোকে আগমন এবং ঘোড়া বা ঘোটকের পিঠে আসীন হয়ে স্বর্গলোকে বিদায়ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে আগমন-গমন দুইয়ের ফলই মন্দের ইঙ্গিত বাহকবাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রমতে, এ বছর সারাদেশে ৩১ হাজার ৪৬১টি মন্ডপে দুর্গপূজার আয়োজন করা হয়েছেএ বছর ঢাকায় পূজামন্ডপের সংখ্যা ২৫৩টি

উল্লেখ্য যে, বাঙালি হিন্দু সমাজের এই পূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের জন্য এই উসব একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেঅন্ধকারের শক্তিকে নিধন, অন্যায়-অবিচার ও বর্বর শক্তিকে নস্যা করে আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এই ধরনের ধর্মীয় উসব

ধর্মীয় উসবগুলো সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্বের নিগূঢ় বন্ধনকে অনন্য উচ্চতায় এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেপরমতসহিষ্ণুতা প্রদর্শনের অভিনব পন্থা অবলম্বনে অন্য ধর্মে বিশ্বাস না করা সত্ত্বেও ধর্মের রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান প্রদান ও এই ধারণাকে মর্যাদাসীন করার লক্ষ্যে মানবিকতায় উজ্জীবিত চেতনার নামই অসাম্প্রদায়িকতাবাংলা ভূখন্ডে প্রত্যেক ধর্মের বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর এই ধরনের ঈদ-রোজা-মহরম-পূজাপার্বণ-বড়দিন-বৌদ্ধপূর্ণিমার সমীকরণে স্বজাত্যবোধের পরিচিতি নিরন্তর নন্দিত এবং প্রশংসিত

আমরা সম্যক অবগত আছি, ফকির লালন শাহ আমৃত্যু জাতিভেদ তথা সাম্প্রদায়িকতার প্রতি তীব্র ঘৃণা, অসন্তোষ ও বিদ্রোহ প্রকাশ করে হিন্দু মুসলমানের পারস্পরিক সহমর্মিতা ও বন্ধুত্বের প্রেক্ষাপট রচনায় বহুভাবে তার উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছেনতার যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবেযেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান/জাতি-গোত্র নাহি রবেশোনায়ে লোভের বুলি/নেবে না কাঁধের ঝুলি, ইতর-আতরাফ বলি/দূরে ঠেলে না দেবেআমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই/সবার পাওনা খাবে সবাই, আশরাফ বলিয়া রেহাই ভবে/কেউ নাহি পাবে, ধর্ম-কূল-গোত্র-জাতি/তুলবে না গো কেহ জিগির, কেঁদে বলে লালন ফকির/কে মোরে দেখায়ে দেবেবস্তুত গাঙ্গীয় এ ব-দ্বীপ এলাকায় বাঙালিরা বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে আর্যদের আগমনের প্রায় পনেরোশবছর আগেদ্রাবিড় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত এই জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের উসে ছিল কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতিআর্যদের দখলে আসার পর রাজনীতি, ভাষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির বিষয়ে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘাত শতাব্দীর পর শতাব্দী অব্যাহত থাকলেও শ্রী দুর্গাচন্দ্র সান্যালের ভাষায় বৈদিক যুগ থেকে আর্যরা অনার্য সভ্যতা গ্রহণ শুরু করে

ঐতিহাসিক বহু তথ্য থেকে এটি প্রমাণিত যে, বাংলাদেশে আর্য হিন্দুদের শত বিরেধিতা সত্ত্বেও প্রচলিত অনার্যদের প্রচীন আমলের কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি- বধূবরণ, অন্ন প্রাশন, সংক্রান্তি, গৃহ প্রবেশ, জমি কর্ষণ, ফসল তোলা, আচার-অনুষ্ঠান, ব্রত ও প্রথার বিলুপ্তি ঘটেনি বরং বৌদ্ধ, হিন্দু এবং সূফী মনীষীদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারের পরও এ ধরনের কৃষি ও সংস্কৃতির উপাদানগুলো বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান আচার-অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অস্তিত্বকে অত্যুজ্জ্বল করেছেভাব-বস্তুবাদী দর্শনের আপেক্ষিক সম্মিলনে প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম ইহ ও পারলৌকিক বিশ্বাস এবং কর্মের ভিত্তিকে শক্তিমান করেছেমূলত মানবিক মূল্যবোধের অনুরুদ্ধ বিকাশমানতা ও জনকল্যাণে নিবেদিত কর্মযজ্ঞের অনভিভূত ধারণায় ধর্ম যুগে যুগে নানা কাঠামোয় পল্লবিত হয়েছে

জাতি-বর্ণ-মানুষ-অঞ্চলভেদে প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিপালিত ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির বর্ণিল অবগাহনে ধর্মের চিরায়তরূপ জ্ঞাপিতজীবনধর্মী কর্মপ্রবাহে ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য, সত্য-মিথ্যার দোলাচলে অদৃশ্য-অজানা অনুভূতির মানদ-ে পারলৌকিক ইতিবাচক ফল প্রত্যাশায় ধর্মভিত্তিক আচার-আচরণ কখনো সমাজকে করেছে উজ্জীবিত; কখনো অতিশয় নিষ্প্রভশারদীয় দুর্গাপূজা প্রতিবছরই নতুন বার্তা বহন করেদেশ-বিশ্বময় শান্তি-নিরাপত্তা বিধানকল্পে সকল ধরনের সন্ত্রাস-অরাজকতা-নৈরাজ্য নিধন করে অসুর বধের মতো সকল অপশক্তিকে রুখে  দেওয়ার সংকল্প জোরালোভাবেই উচ্চকিতপ্রত্যেক নাগরিকের স্ব স্ব দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের মাধ্যমে অনাচার-কদাচারমুক্ত হবে নতুন বাংলাদেশএই আশাবাদ ব্যক্ত করে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের সকল নাগরিকের প্রতি শারদীয় শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×