প্রসঙ্গ ইসলাম
ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন মসজিদ তিনটি। মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববি ও জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা। এর পর হলো মসজিদে কুবা। এই মসজিদে নামাজ আদায় করলে এক ওমরাহর সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। আল্লাহর রাসুল (সা.) নবুওয়াত লাভের পর এটিই ইসলামের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম মসজিদ। মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় মদিনার অদূরে কুবায় এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
এর আগে মক্কায় তিনি কোনো মসজিদ নির্মাণ করেননি। হিজরতের প্রথম দিন কুবা অবস্থানকালে এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। মসজিদের নির্মাণ কাজে সাহাবাদের সঙ্গে স্বয়ং রাসুল (সা.) অংশগ্রহণ করেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন ভিত্তি স্থাপন করেন তখন কেবলার দিকের প্রথম পাথরটি নিজ হাতে স্থাপন করেন। কুবা মসজিদের জায়গাটি ছিল হযরত কুলসুম ইবনুল হিদমের (রা.) খেজুর শুকানোর পতিত জমি। তিনি ছিলেন আমর ইবনে আওফের গোত্রপতি। এখানে হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ১৪ দিন ( কেউ বলেন ১০ দিন) অবস্থান করেন ও তার আতিথ্য গ্রহণ করেন।
মক্কা শরিফ থেকে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত এই মসজিদ কুবা গ্রামে অবস্থিত। মসজিদে নববি থেকে এর দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। কুবা একটি বিখ্যাত কূপের নাম। সময়ের পরিক্রমায় এ কূপকে কেন্দ্র করে যে জনবসতি গড়ে উঠেছে, তাকেও কুবা বলা হতো। এরই সূত্রে মসজিদের নাম হয়ে যায় মসজিদে কুবা। পবিত্র কুরআনে মসজিদে কুবা পবিত্র কুরআনে কুবার অধিবাসী ও মসজিদে কুবার প্রশংসা করেন আল্লাহতাআলা।
তিনি বলেন, ‘যে মসজিদ প্রথম দিন থেকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে অবস্থান করা আপনার জন্য অধিক সঙ্গত। সেখানে এমন কিছু লোক রয়েছেন যারা পবিত্রতা পছন্দ করেন। আর আল্লাহ পবিত্র ব্যক্তিদের ভালোবাসেন।’ (সুরা তওবা, আয়াত : ১০৮)।
মসজিদে কুবা শুরু থেকে এ পর্যন্ত কয়েক দফা সংস্কার ও পুনর্নিমাণ করা হয়। নবীর আমলের পর ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.) তার খেলাফতকালে মসজিদে কুবার সংস্কার ও পুনর্নিমাণ করেন। এর পর বিভিন্ন সময়ে আরও বেশ কয়েকবার এই মসজিদের পুনর্নিমাণ ও সংস্কার করা হয়। উমর বিন আবদুল আজিজ (র.), ওসমানি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ ও তার ছেলে প্রথম আবদুল মাজিদ প্রমুখ শাসক মসজিদে কুবার সংস্কার কাজ করেন। ৪৩৫ হিজরিতে আবু ইয়ালি আল-হোসায়নি কুবা মসজিদ সংস্কার করেন। তিনি মসজিদের মিহরাব তৈরি করেন।
পরবর্তী সময়ে ৬৭১, ৭৩৩, ৮৪০ ও ৮৮১ হিজরিতে ওসমানি সা¤্রাজ্যকালে মসজিদটি সংস্কার করা হয়। ওসমানি শাসনামলে ১২৪৫ হিজরিতে সর্বশেষ সংস্কার করেন সুলতান আবদুল মজিদ। ১৯৮৬ সালে বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সময় সর্বশেষ সম্প্রসারণ হয়। তখন পুরো মসজিদে এক ধরনের সাদাপাথর ব্যবহার করা হয়, যা অন্য কোনো মসজিদে সাধারণত দেখা যায় না।
মসজিদে কুবার বর্তমান আয়তন ১৩ হাজার ৫০০ স্কয়ার মিটার। চারটি উঁচু মিনার, ছাদে ১টি বড় গম্বুজ এবং ৫টি অপেক্ষাকৃত ছোট গম্বুজ রয়েছে। এছাড়া ছাদের অন্য অংশে ৫৬টি ছোট গম্বুজের অবয়ব রয়েছে। ২০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন এই মসজিদে। মূল মসজিদ ছাড়াও এখানে রয়েছে আবাসিক এলাকা, অফিস, অজুখানা, দোকান ও লাইব্রেরি। তবে মসজিদের মূল আকর্ষণ বিশাল গম্বুজ এবং চার কোণায় চারটি সুউচ্চ মিনার।
মসজিদের চতুর্দিকের সুবজ পামগাছের বলয় মসজিদটিকে বাড়তি সৌন্দর্য দিয়েছে। মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসেন। মসজিদে নারী ও পুরুষদের নামাজের জায়গা ও প্রবেশ পথ আলাদা। অজুর জায়গাও ভিন্ন। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদের ভেতরের কারুকাজও বেশ মনোমুগ্ধকর।
মূল মসজিদ ভবনের মাঝে একটি খালি জায়গা আছে, সেখানেও নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। দামি কার্পেট বিছানো মেঝেতে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেন। এছাড়াও রয়েছে জমজম পানির ব্যবস্থা। মসজিদের উত্তরদিক নারীদের জন্য সংরক্ষিত। ১১২ বর্গমিটার অংশজুড়ে ইমাম ও মুয়াজ্জিনের থাকার জায়গা, একটি লাইব্রেরি, প্রহরীদের থাকার জায়গা এবং সাড়ে ৪শ’ বর্গমিটার স্থানে ১২টি দোকানসমৃদ্ধ একটি বাণিজ্যিক এলাকা।
মসজিদে ৭টি মূল প্রবেশ দ্বার ও ১২টি সম্পূরক প্রবেশ পথ রয়েছে। প্রতিটি ১০ লাখ ৮০ হাজার থার্মাল ইউনিট বিশিষ্ট তিনটি কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র মসজিদকে ঠা-া রাখছে। মসজিদের বাইরে এ মসজিদ সম্পর্কে বর্ণিত পবিত্র কুরআনের আয়াত ও হাদিসের বাণীগুলো সুন্দরভাবে লিখে রাখা হয়েছে। ঐতিহাসিক কুবা মসজিদ শ্বেতবর্ণের একটি অনন্য স্থাপত্যকর্ম হওয়ার দরুন বহুদূর থেকে দৃষ্টিগোচর হয়।
রাসুল (সা.) নবুওয়াত পাওয়ার পর এটাই প্রথম মসজিদ, এমনকি ইসলামের এবং উম্মতে মোহাম্মদির প্রথম মসজিদ। এ মসজিদের আলোচনা কুরআনে করা হয়েছে এবং মসজিদ সংলগ্ন অধিবাসীদের একটি বিশেষ গুণের প্রশংসা করা হয়েছে। মসজিদে কুবায় নামাজ আদায়ে অত্যধিক ফজিলত রয়েছে। মসজিদে কুবায় নামাজের ফজিলতের কথা অসংখ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন- হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্বারোহণ করে কিংবা হেঁটে মসজিদে কুবায় আগমন করতেন এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন।
অন্য এক হাদিসে রয়েছে, প্রতি শনিবারে রাসুল (সা.) কুবায় আগমন করতেন। (বুখারি-মুসলিম)। আরেক হাদিসে বর্ণিত আছে, মসজিদে কুবায় নামাজ আদায় করার সওয়াব একটি ওমরাহর সমপরিমাণ। (তিরমিজি) রাসুল (সা.) আরও ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজের ঘরে ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করে (সুন্নাত মোতাবেক অজু করে) মসজিদে কুবায় আগমন করে নামাজ আদায় করে তাকে একটি ওমরাহর সমপরিমাণ সওয়াব দান করা হবে। (ইবনে মাজাহ) তাই তো রাসুল (সা.) এর যুগ থেকেই প্রতি শনিবার মসজিদে কুবায় নামাজ আদায় করার জন্য গমন করা মদিনাবাসীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানেও তাদের এই আমল অব্যাহত রয়েছে।
হজরত মোহাম্মদ (সা.) পবিত্র রবিউল আওয়াল মাসের প্রথম দিন আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনা অভিমুখে হিজরত করেন। আর এ হিজরতের মধ্য দিয়ে মদিনা শহরকে কেন্দ্র করে ইসলাম ও কুরআনের বাণী বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। রাসুলের (সা.) হিজরতের পর সাহাবীরাও পর্যায়ক্রমে মদিনা গমন করেন। হজরত মোহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে কুবা মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। মূলত তাঁরই তত্ত্বাবধানে মসজিদের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।
হজরত মোহাম্মদ (সা.) বেশ কয়েক রাত এই মসজিদে অবস্থান করেন এবং কসর নামাজ আদায় করেন। মহানবীর (সা.) কদমের ধুলো, মাথার ঘামের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত পবিত্র কুবা মসজিদ আজ বিশ^ মুসলিমের তীর্থে পরিণত হয়ে আছে। সারা বছর দু’রাকাত নামাজ আর ্একটি মুনাজাত দেওয়ার জন্য লাখ লাখ আশিককুল ভিড় জমায় এ মসজিদে। দূর থেকে তাকালে যেন মনে হয় মরূদ্যানের এ কুবা স্থাপনাটি একটি শাপলা ফুলের সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে প্রতি সফরে শনিবারে নিজ হোটেল থেকে অজু করে এসে নবীজীর স্মৃতিবিজরিত এই মসজিদে কাক্সিক্ষত দু’রাকাত নামাজ আদায়পূর্বক একটি বিশুদ্ধ উমরাহর সাওয়াব হাসিলের তৌফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব