
নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ
Convention on the Elimination of All Forms of discrimination against ড়িসবহ (CEADAW). সিডও বা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ। সমাজের পশ্চাৎপদতা ও বৈষম্য দূর করতে জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা করার আগে ১৯৪৬ সালের ২১ জুন গঠিত হয়েছিল কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেন। নারীর মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন তৈরি এবং এ জন্য কি করতে হবে তা সুপারিশ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
এর ধারাবাহিকতায় আসে দাবি দশক। তারও পরে সিডও সনদ। এতে স্বাক্ষর শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে। বাংলাদেশ সনদ অনুমোদন করে স্বাক্ষর করে ১৯৮৪ সালের ৬ নবেম্বর। এ পর্যন্ত একশ’ পঁচাশিটি দেশ সিডও সনদে অনুমোদন দিয়েছে।
সিডও সনদের মূল সুর হচ্ছে সমাজ বিকাশের ধারায়, উন্নয়ন ও এগিয়ে যাওয়ায় নারী যে ভূমিকা রেখেছে ও রাখছে তার স্বীকৃতি দেওয়া। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করা এবং নারীর বিকাশের জন্য সাবলীল পরিবেশ তৈরি করা।
এ জন্য আইন প্রণয়ন, আইনের সংস্কার ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা। নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। যেসব রাষ্ট্র সনদে স্বাক্ষর করেছে তারা এসব শর্ত পূরণ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। নারীর জন্য ‘আন্তর্জাতিক বিল অব রাইটস’ হিসেবে পরিচিত এ দলিল নারী অধিকার সংরক্ষণের স্বয়ংসম্পূর্ণ মানদ- বলে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি ধারায় সংরক্ষণ রেখে সনদে সই করেছিল। সেগুলো হলো ধারা দুই, তেরো (ক), ষোলো এক (গ) ও (চ)। ধারা দুই-এ বলা হয়েছে, বৈষম্য বিলোপ করে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার নীতিমালা গ্রহণ।
প্রতিটি দেশের জাতীয় সংবিধান, আইনকানুন ও নীতিমালায় নারী ও পুরুষের সমতার নীতিমালা সংযুক্তকরণ ও তার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনকানুন, রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক কর্মকা- থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ। আদালত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীকে সব ধরনের বৈষম্য থেকে রক্ষা করা। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি বৈষম্য রোধ করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।
ধারা তেরো বলছে, শরিক রাষ্ট্রসমূহ, পুরুষ ও নারীর সমতার ভিত্তিতে একই অধিকার বিশেষ করে নিম্নলিখিত অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অপরাপর ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য সকল উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ক. পারিবারিক কল্যাণের অধিকার, খ. ব্যাংক ঋণ, বন্ধক ও অন্যান্য আর্থিক ঋণ গ্রহণের অধিকার, গ. বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক জীবনের সব বিষয়ে অংশগ্রহণের অধিকার।
এর মধ্যে ধারা ক-এ সংরক্ষণ আরোপ করেছিল। ধারা ষোলো- এক. গণ্ড বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদকালে নারী ও পুরুষের একই অধিকার ও দায়-দায়িত্ব নিশ্চিত করা।
ধারা ষোলো : এক. চ. অভিভাবকত্ব প্রতিপালন, ট্রাস্টিশিপ ও পোষ্য সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
১৯৯৭ সালে সরকার তেরো ক এবং ষোলো- এক চ. থেকে সংরক্ষণ তুলে নেয়। ধারা দুই ও ষোলো- এক. গ. এখনো সংরক্ষিত আছে। ওই বছরই জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করা হয়, যা তাতে নারী-পুরুষে বৈষম্য কমানোর জন্য বেশকিছু স্পষ্ট উচ্চারণ রয়েছে।
নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক। জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন রিপোর্ট বছরতিনেক আগে এ তথ্য দিয়ে বলেছে, এ সফলতার পেছনে মূল কারণ নারী শিক্ষার প্রসার, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্যভাবে অংশ নেওয়া, কর্মোদ্যম ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার মনোবল ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি অর্জন নারী-পুরুষে বৈষম্য কমাতে। আগের বছরের তুলনায় অগ্রগতি বেড়েছে শতকরা পঁচিশ ভাগ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান পিছিয়ে রয়েছে। এতে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে এক ভাগ ওপরে রয়েছে। বলা হয়েছে, নারী-পুরুষের বৈষম্যের ক্ষেত্রে এক শ’ ছেচল্লিশটি জাতিসত্তার মধ্যে সমীক্ষায় ভারতের অবস্থান এক শ’ ঊনত্রিশতম। বাংলাদেশের এক শ’ বারোতম এবং পাকিস্তানের এক শ’ ষোলোতম।
দেশে এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের শিক্ষার হার বেশি। শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ শিশু প্রাইমারি স্কুলে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঊননব্বই দশমিক নয় ভাগ মেয়ে এবং বিরাশি দশমিক নয় ভাগ ছেলে। গড় আয়ুর হিসাবেও বাংলাদেশ এগিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর গড় আয়ু ছেষট্টি বছর। বাংলাদেশে এ হার আটষট্টি দশমিক নয় বছর। জাতিসংঘ সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খান এক লেখায় বলেছেন, ‘শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির সুফল হিসেবে নারীর প্রজনন হার ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
এসব উপাদান বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন হার বৃদ্ধিতে স্পষ্ট অবদান রাখছে। যার ফলে জাতিসংঘ প্রকাশিত মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান আগের চেয়ে দুই ধাপ ওপরে উঠেছে। মানব উন্নয়নে নারীর প্রত্যক্ষ ভূমিকার কারণে জেন্ডার গ্যাপ বা লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রেও আগের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ইতিবাচক যার প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদনে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে নারীর ব্যাপক অবদান, বিশেষত মানব উন্নয়ন সূচক বৃদ্ধি মূল চালিকাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার চার দশক পরও দারিদ্র্যপীড়িত ও অধিকার বঞ্চিত জনগণের সিংহভাগ কেন নারী এ প্রশ্ন যুক্তিসঙ্গত।’
এর উত্তর রয়েছে সম্ভবত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির ’৯৭-এর প্রস্তাবনায়। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের শতকরা ছেচল্লিশ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশই নারী। চাকরি ও আত্মকর্মসংস্থান দু’ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় নারী পিছিয়ে আছে। ১৯৯০-৯১ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির একান্ন দশমিক দুই মিলিয়ন। এর মধ্যে পুরুষ একত্রিশ দশমিক এক, নারী বিশ দশমিক এক মিলিয়ন। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত নারীর অনেক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হয়নি।
সংসারের পরিসরে নারীর শ্রম বিনিয়োগের কোন মাপকাঠি এখনো উদ্ভাবন করা যায়নি এবং কৃষি অর্থনীতিতে নারীর অবদানের সঠিক মূল্যায়ন নিরূপিত হয়নি বলেই নারী শ্রমশক্তি হিসেবে অনেক সময় চিহ্নিত হয়নি। বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে ১৯৮০ সালে শ্রমবাজারে নারীর অন্তর্ভুক্তির হার ছিল শতকরা পঁয়ষট্টি দশমিক পাঁচ ভাগ ২০০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা মাত্র আটান্ন দশমিক সাত ভাগ, অথচ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মূল অবদান এ দেশের পোশাক শিল্পের নারীদের। বিশ্বব্যাংকই বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডারভিত্তিক মজুরি বৈষম্যে সবচেয়ে নিচে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের তুলনায় কম হলেও অন্যান্য দেশেও এ বৈষম্য রয়েছে।
সিডও দলিলে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে এটি উদ্বেগজনক যে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও নারীর প্রতি ব্যাপক বৈষম্য অব্যাহত রয়েছে। নারীর প্রতি বৈষম্য, অধিকারের সমতা ও মানব মর্যাদার প্রতি সম্মানের নীতি ঠিকভাবে প্রতিফলিত না হওয়ায় সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো নিজেদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পুরুষের মতো সমান শর্তে নারীর অংশ নেওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এতে সমাজ ও পরিবারের সমৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হয় এবং নিজ দেশ ও মানবতার সেবায় নারীর সম্ভাবনার পূর্ণ বকাশ আরও কঠিন করে তোলে।
অভাবের পরিস্থিতিতে খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং চাকরির সুযোগ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়ার সম্ভাবনা নারীর সবচেয়ে কম থাকে। পরিবারের কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়নে নারীর বিরাট অবদান রয়েছে যার পুরো স্বীকৃতি এখন আসেনি। সিডও সনদের কনসেপ্ট হচ্ছে মাতৃত্বের সামাজিক গুরুত্ব এবং পরিবারে ও সন্তান পরিচর্যায় মা-বাবা দু’জনার ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া সন্তান জন্ম দেওয়ায় নারীর ভূমিকা বৈষ্যম্যের ভিত্তি হবে না বরং সন্তান পালনে মা-বাবার মধ্যে এবং সার্বিকভাবে সমাজের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা যোগ্য। পুরুষ ও নারীর মধ্যে পূর্ণ সমতা অর্জনের জন্য সমাজে ও পরিবারে পুরুষ ও নারীর প্রচলিত ভূমিকায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
জাতিসংঘ সিডও সনদের কার্যকরী কমিটির সভা হয় বছরে একবার। প্রতি চার বছর পর দেশে নারীর বর্তমান অবস্থা, নারী উন্নয়নে বাধা এবং সনদের নীতিমালা অনুসরণের জন্য নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রিপোর্ট পাঠাতে হয়, সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের নির্বাচিত বিশেষজ্ঞদের তেইশ সদস্যের কার্যকরী কমিটি এসব রিপোর্ট পরীক্ষা করে এবং সিডও নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করে।