ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

টরেন্টোর চিঠি

এ বিজয় যেন হয় খেটে খাওয়া মানুষের

ডা. শাহীন আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ৭ আগস্ট ২০২৪

এ বিজয় যেন হয় খেটে খাওয়া মানুষের

৫ আগস্ট দিবাগত ভোরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো

৫ আগস্ট দিবাগত ভোরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করলেন। এই ঘটনা গত কয়েক সপ্তাহের ধারাবাহিকতায় খুব অপ্রত্যাশিত ছিল বলা যায় না। আমার এক বন্ধু ফেসবুকে লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক র‌্যাংকিংয়ে অনেক পিছিয়ে থাকলেও আন্দোলনের র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বে ১ নম্বর, সেটি আবার প্রমাণিত হলো।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগত মানুষের দাবি-দাওয়া অগ্রাহ্য করে একের পর এক এমন সব হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা দেশের মানুষকে ক্ষুদ্র করেছে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী স্কুলে পড়ত, আজ তারা কলেজে পড়ে। তখন যারা কলেজে পড়ত, এখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আপনি যদি আপনার ইগো এত বছর ধরে লালন করতে পারেন, ততদিন ধরে ওরা করবে না?

জাস্ট একটা প্রেস কনফারেন্স আর একটা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে এভাবে ক্ষমতায় থেকে প্রায় ছিটকে পড়ার ইতিহাস বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি আছে কি-না জানি না। এত বাজে পাবলিক কমিউনিকেশনস, হিংসা, ঘৃণা, অগ্রহণযোগ্য কথাবার্তা কীভাবে বাকি সব উন্নয়ন, সাফল্যকে ধুলোয় লুটিয়ে দেয়, তা অবাক হয়ে দেখলাম আমরা। দেশের অন্তত অর্ধেক মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে।

কিন্তু সেই অর্ধেকেরও ৭০ ভাগ মানুষ এখন সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। বিশ্বাস করেন অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, সবাই চিন্তিত আওয়ামী লীগ কি কংগ্রেসের মতো হারিয়ে যাবে? এই মানুষগুলো আওয়ামী লীগের সমর্থক, কিন্তু এই সরকারের সমর্থক না। তারা ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে পারে না, আসাদুজ্জামানকে পছন্দ করে না, আরাফাতের বক্তব্যে ধিক্কার জানায়, পলককে অপদার্থ মনে করে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা রাখতে পারছিল না। আদতে তাকেই এককভাবে দায়ী করছিল আজকের এই অবস্থার জন্য। 
আমার চাচা ও সাবেক সচিব- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মহিউদ্দিন আহমদ ১৯৭১ সালে লন্ডনে পাকিস্তানি দূতাবাসের আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন ট্রাফেলগার স্কয়ারে। তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিথ্রো বিমানবন্দরে রিসিভ করেছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার পক্ষে বক্তব্য দেওয়ায় বিএনপির সময় চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। সেই চাচার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষের দিকে খুব একটা ভালো ছিল না।

আমি প্রায় আমার আব্বাকে বলতাম, তিনি সব পত্রিকায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে লেখেন কেন? ২০১৪ থেকে তিনি শেখ হাসিনার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন আরও অনেক বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকের মতো। মনে হয় চাচা বেঁচে থাকলে এখন তার সঙ্গে আলাপটা আরেকবার ঝালিয়ে নিতে পারতাম। বিশ্বাস করবেন কি-না জানি না, খুব অসহায় বোধ করছি।

আমার কলেজের এক প্রিয় বন্ধু, যার সঙ্গে শাহবাগের আন্দোলনে ছিলাম, জীবনের নানা মোড়ে খুব কাছাকাছি থেকেছি, সে সম্প্রতি তার এক পোস্টে লিখেছেÑ বাসে আগুন লাগলে মানুষ আগে সে বাস থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে জীবন বাঁচায়। তারপর ঠিক করে সে বাসায় ফিরবে কীভাবে। কয়েকদিন আগে ওর সঙ্গে আলাপ করার সময় একই কথা উঠে আসছিল বারবার।

দেশের মানুষ আগুন ধরা বাস থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে জীবন বাঁচাচ্ছে। বাসায় ফিরবে কীভাবেÑ সেই চিন্তা তাদের মাথায় এখন আর নেই। আমরা সেই জেনারেশন যাদের এরশাদ, খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে দিত না, বঙ্গবন্ধুর কথা জানতে দিত না, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে যাতে ঘৃণা করতে না পারি, তাই পাঠ্যপুস্তকে তাদের নাম লুকিয়ে হানাদার বাহিনী লিখে রাখত।

আমরা সেই জেনারেশন, যারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মানবতাবিরোধীদের, ১৯৭৫ এ জাতির জনক ও চারনেতার হত্যাকারীদের বিচার দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ ছিলাম। আমরা সেই জাতি যারা শরীরে একফোঁটা রক্ত থাকতে কখনো দেশবিরোধী কোনো শক্তিকে সমর্থন করতাম না। কিন্তু আমরা আবার সেই একই জাতি, যারা দেশের শত শত শিক্ষার্থীর বুকে গুলি করাও কখনো মেনে নিতে পারিনি।

আমরা স্বাধীন দেশে শাসকের খোলসে কোনো শোষককেও মেনে নিতে পারি না। আমাদের দেশের রক্ষকরা ভক্ষক হয়ে আমাদের ভাই, ছেলে-মেয়ে-বোনদের গুলি করে মেরে ফেলবে, এটাও আমরা মেনে নেই না।

শেখ হাসিনা ভারতে গিয়েছেন। তার যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা বাতিল হয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের, বঙ্গবন্ধুর যে সোনার বাংলার সূত্রপাত হচ্ছিল গত কিছুদিন ধরে, সেটি তার হাত ধরেই ভূলণ্ঠিত হলো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ধানম-ি ৩২ এ আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সারাদেশে সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের খবর আসছে। দেশের সম্পদ পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হচ্ছে।

আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিজয়ে আনন্দিত, কিন্তু দেশের সংবিধানের মূল ধারাগুলো যদি ব্যাহত হয়, এদেশের একটি মানুষও যদি আক্রান্ত হয়, সেটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমরা সেই জেনারেশন, যারা আজ হতাশ, ক্লান্ত, পরাজিত। আমরা সেই জাতি, যারা আজ নিজেদের ঘরে নিজেরাই প্রতারিত অনুভব করছি।

আমাদের দুঃখ, আজ আমাদের সন্তানদের বুক থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরেছে। কিন্তু আমরা আশাবাদী, নতুন প্রজন্ম যাতে দেশে সকল বিভেদ ভেঙে দিয়ে, অন্যায় অত্যাচার মুছে দিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারে। এ বিজয় যেন হয় খেটে খাওয়া মানুষের, এ বিজয় যেন হয় সার্বভৌম বাংলাদেশের। 

শরহফষবলরঃঁ@মসধরষ.পড়স
৫ আগস্ট ২০২৪

×