ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৫ আগস্ট ২০২৫, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

সাবমেরিন ক্যাবল ।। ইন্টারনেটের একাল-সেকাল

জিহান চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:১২, ২৮ জুন ২০২৪

সাবমেরিন ক্যাবল ।।  ইন্টারনেটের একাল-সেকাল

.

প্রাচীনকালে যোগাযোগ হতো কবুতরের পায়ে চিঠি বেঁধে, তারপর ঘোড়ায় চড়ে বাহকের মাধ্যমে। ধাপে ধাপে আসে পরিবর্তন। ১৮৭৬ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল টেলিফোন আবিষ্কার করেন। যা তারের মাধ্যমে কণ্ঠস্বর আদান-প্রদানের প্রথম ধাপ। তারপর আসে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। পরবর্তীতে বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ। তারপর ১৯৭৩ সালে . মার্টিন কুপার এবং জন ফ্রান্সিস মিচেল  প্রথম মোবাইল ফোন আবিষ্কার করেন। এটি তারবিহীন যোগাযোগের সর্বপ্রথম ধাপ। পাশাপাশি কম্পিউটার, ল্যাপটপের বহুল প্রচলনও রয়েছে। মানুষের জীবনকে সহজ এবং আধুনিক করার জন্য এসব ডিভাইস উপযোগী বহু ওয়েবসাইট এবং এ্যাপস রয়েছে এবং আরও তৈরি হচ্ছে। বিশ্ব আজ প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়েছে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানোয় বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই, যা সম্ভব হয়েছে স্যাটেলাইট কিংবা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গেটওয়ে (সাবমেরিন ক্যাবল) মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ-করণের কারণে।

ইন্টারনেট হচ্ছে সার্ভার থেকে গ্রাহক পর্যটন ফাইবার সংযোগ, যা ক্লিক করলে আমরা ডিভাইসে দেখতে পাই কিংবা ব্যবহার করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ সুইডেনের লুলেওয়েতে ফেসবুকের সার্ভারে অন্য কারও সংরক্ষিত ছবি (ডাটা) কিংবা আমাদের আপলোড করা ছবিগুলো ওই সার্ভারে সংরক্ষিত হয়। এর পিছনে কারণ হচ্ছে সার্ভারের সঙ্গে উক্ত দেশের ইন্টারনেট ফাইবার (তার), তারপর আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (সাবমেরিন ক্যাবেল) কিংবা স্যাটেলাইট হয়ে অতঃপর আমাদের দেশের ফাইবারের মাধ্যমে রাউটার হয়ে আমাদের ডিভাইস পর্যন্ত সংযোগ স্থাপিত হয়। যার ফলে, ফেসবুকে আপলোড করা আমরা মানুষের ছবি দেখি। আমাদের ছবিও মানুষ দেখে।

সাবমেরিন ক্যাবল হচ্ছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগের ক্যাবল। বাংলাদেশের জন্য ১৯৯২ এবং ১৯৯৪ সালে বিনা খরচে সাবমেরিন ক্যাবল সংযুক্তির প্রস্তাব ছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকারপ্রধান তথ্য চুরির অজুহাত দেখিয়ে উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, যা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য অমঙ্গলজনক ছিল। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের শুরুতেই কৃত্রিম উপগ্রহ নির্ভর ভি-স্যাট প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশে প্রথম ইন্টারনেট সেবা প্রদান শুরু হয়। তখন ৬৪ কেবিপিএসের ব্যান্ডউইথ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যার ভাড়া ছিল ১০ হাজার মার্কিন ডলার। যা ছিল খুবই ব্যায়বহুল। এই ইন্টারনেট সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংযোগস্থাপনকারী হিসেবে সাবমেরিন ক্যাবেলের গুরুত্ব অপরিসীম এবং সাশ্রয়ী।

একটা ভুল সিদ্ধান্তের ভুক্তভোগী হওয়ার দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ ২০০৬ সালে সাবমেরিন ক্যাবল সি-মি-ইউ -এর মাধ্যমে কক্সবাজার শহর ঝিলংজা ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়। যার সক্ষমতা ছিল ৩০০ জিবিপিএসের মতো। বর্তমানে ৮০০ জিবিপএস। এই ফাইবারটি ১৮০০০ কিমি লম্বা। যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য পশ্চিম ইউরোপের ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যম। যাতে ১৭টি ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সুদান, মিসর, ইতালি, তিউনিসিয়া, আলজিরিয়া এবং ফ্রান্স।

পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৭ সালে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ার ল্যান্ডিংস্টেশনের মাধ্যমে সি-মি-ইউ - সঙ্গে সংযুক্ত হয়। যা অতীতের তুলনায় গুণ প্রায় ১৮০০ জিবিপএস। যা ছিল বাংলাদেশ জনগণের জন্য কল্যাণকর এবং আশীর্বাদস্বরূপ। উক্ত সাবমেরিন ক্যাবলটি ২০০০০ কিমি লম্বা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ছিল। ১৯টি ল্যান্ডিং পয়েন্টের মাধ্যমে ১৯টি দেশকে সংযুক্ত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গত এপ্রিল মাসে সিঙ্গাপুর থেকে ইন্দোনেশিয়ার অভিমুখে এটি কাটা পড়ে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ ইন্টারনেটে ধীরগতির সমস্যায় সমস্যাগ্রস্ত হচ্ছে।

ইতোমধ্যে সাবমেরিন ক্যাবল সি-মি-ইউ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া সরকারি উদ্যোগের বাইরে বেসরকারিভাবেও সাবমেরিন ক্যাবল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। যার সক্ষমতা হবে ৪৫ হাজার জিবিপিএস, যা বাংলাদেশের জন্য ইন্টারনেট জগতে যুগান্তকারী মাইলফলক। কোনোটি দুর্ঘটনার শিকার হলেও তা গ্রাহক পর্যায়ে ভোগান্তির ছাপ পড়বে না। পাশাপাশি সাধারণ জনগণ হিসাবে আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সকল সিদ্ধান্ত হবে যুগোপযোগী, জনগণ এবং পরিবেশবান্ধব।

একটি দেশ প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত হলে তা অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সমস্ত প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশেও তা চলমান। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়াতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বে উন্নতশীল স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর হবে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের কাছে বাংলাদেশ হবে পথিকৃৎ এবং অনুকরণীয়- সকলের এই প্রত্যাশা।

লেখক : প্রভাষক

[email protected]

×