ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

স্বস্তি ও দুর্ভোগে উৎসব উদযাপন

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২১:০৬, ২৪ জুন ২০২৪; আপডেট: ১০:৫২, ২৫ জুন ২০২৪

স্বস্তি ও দুর্ভোগে উৎসব উদযাপন

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে প্রবৃদ্ধির নিত্যনতুন কর্মযোগে

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে প্রবৃদ্ধির নিত্যনতুন কর্মযোগে। উন্নয়নের নানামাত্রিক দর্শনীয় চিত্র প্রতিভাত হতে সময়ও লাগছে না। সম্প্রীতির বন্ধনে অবিচ্ছেদ্য এক জাতিসত্তা আবহমান বাংলা। ধর্ম, সংস্কৃতি, লোকাচার, যাপিত জীবন- সবই যেন প্রীতি সৌহার্দ্যরে এক অকৃত্রিম সাধনযজ্ঞ। ধর্মপ্রাণ জাতি হিসেবে যেমন আমরা সুবিদিত একইভাবে সাংস্কৃতিক বোধসম্পন্ন আধুনিক বাঙালির মর্যাদায়ও সমান অভিষিক্ত। জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে লালন ফকিরের যে মানব সাধনা সেখানে সর্বশক্তিমানের ওপর আস্থা, বিশ্বাস ও চিরায়ত ভাবসম্পদ বরেন্দ্র এই অঞ্চলের।

পলিমাটির উর্বর নরম মৃত্তিকা চিরায়ত বাংলাকে বরাবরই আপন শৌর্যে মহীয়ান করেছে। সম্প্রতি উদ্যাপন করা হলো ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে আর পবিত্রতম উৎসর্গের অপার মহিমায় ঈদুল আজহা। ধর্মীয় বিধি মোতাবেক উৎসব আয়োজন ছাড়াও নিয়মমাফিক উদ্যাপনও আবশ্যকীয় কর্তব্য। কোরবানি ঈদ মানেই পশু জবাই শুধু নয়, হরেক বর্জ্য উপস্থিত পরিস্থিতিকে নাজেহাল করে দেয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টির ধারায় কোরবানির উৎসবে কিছু ভাটা পড়লেও নিয়মমাফিক সুসম্পন্ন হওয়ার চিত্রও স্বস্তিদায়ক।

বিশেষ করে  অবাঞ্ছিত বর্জ্য সরানোর বিষয়টি তাৎক্ষণিক কর্মপ্রক্রিয়ায় সামলানো গেছে সেটাই অনেক বৃহৎ কার্যক্রম। দুই নগর পিতার সচেতন ও আন্তরিক কর্মপ্রবাহে পুরো রাজধানী বর্জ্যমুক্ত হওয়া সত্যিই অনন্য বিষয়। তবে বর্জ্য অপসারণে অনেকটাই এগিয়ে ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন। আর দক্ষিণে হরেক বাগ্বিত-া শুরু করা হলেও নগর পিতা আশ^স্ত করেন এখানে বর্জ্য অপসারণে কোনো গাফিলতি দৃশ্যমান হয়নি। অতি প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নগরী উপহার দিতে তারাও সর্ব কার্যক্রম অবারিত করেন। তবে বৃষ্টির পানিতে হরেক বিপত্তিও মাথাচাড়া দেওয়ার তথ্য গণমাধ্যমের খবর হয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলে ধসের আলামত বিপত্তির চরম বহির্প্রকাশ।

কক্সবাজারের উখিয়াতে পাহাড় ধসে রোহিঙ্গা মৃত্যুর খবর দুঃখজনক। ২৪ ঘণ্টায় অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত সংশ্লিষ্ট এলাকাকে নাজেহাল করে রাখে। তারই নির্মম পরিণতিতে এমন পাহাড় ধসের মতো অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগ। শুধু কি তাই? ঈদ উৎসবের মধ্যে নৈসর্গের লীলাখেলা সব সময়ই অঞ্চলবাসীদের নাজেহাল করতে যেন এগিয়েই থাকে। তার পরেও মুসলমানদের এবারের ঈদ উৎসব তার যথার্থ আবেদন- নিবেদনে সুসম্পন্ন হওয়া যেন ধর্মীয় অনুভূতির অনন্য এক সংযোজন।
তবে আনন্দ আয়োজনের মাত্রায় ঈদ উৎসবের আরেকটি বিরাট পর্ব শিকড়ের টানে গ্রামে ফেরা। সেটাও নির্বিঘেœ নিঃসংশয়ে কখনোই সেভাবে হয়ই না। যাত্রা দুর্ভোগ তো থাকেই সঙ্গে যুক্ত হয় অনাকাক্সিক্ষত হরেক বিপাক বিপত্তি। যানজট তো অতি স্বাভাবিক বিষয়। আর যাত্রাপথের নানামাত্রিক বিড়ম্বনা যুক্ত হয়ে যে দুর্ভোগের শিকার হতে হয় সেটাও নতুন কোনো বিষয় নয়। বরং দেশের বাড়িতে ঈদ করার আনন্দে যারা যাত্রা শুরু করেন তাদের কাছে এমন দুর্ভোগ অযাচিত কিংবা অনাকাক্সিক্ষত কোনোটাই নয়।

প্রতিবার ঘটে যাওয়া সম ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সময়মতো দূর পাল্লার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে পথের মাঝখানে বাধাবিপত্তি সামলাতে যে কত সময় ব্যয় হয় তার কোনো হিসাবই থাকে না। সামনে অপেক্ষমাণ থাকে উন্নয়ন যজ্ঞের নানামাত্রিক কর্মযোগ আর অবধারিতভাবে আবর্জনার স্তূপ। যাত্রাপথের দুর্ভোগের মধ্যে থাকে অপরিকল্পিত সড়ক। তার মধ্যেই হরেক সড়কের দুর্বিষহ দুরবস্থা। খানা-খন্দে ভর্তি পথযাত্রা কোনোভাবেই যাত্রীদের অনুকূলে থাকেই না। সেখানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো পথ দুর্ঘটনা যখন চেপে বসে তার যে খেসারত দিতে হয় তাতে ঈদ আনন্দ মাটি হওয়ার জোগাড়।

অনেক অত্যাধুনিক এলিভেটেড রাস্তাসহ নতুন সড়কের উদ্বোধন হলেও বিভিন্ন জায়গায় অসঙ্গতিও কম থাকে না। নির্মাণাধীন উন্নয়ন প্রবাহের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের যে বিপত্তি সেটাও সামলাতে হয় ঈদ উৎসবের মহাযাত্রায়। আর সড়ক দুর্ঘটনা তো লেগেই থাকে উৎসব যাত্রার সঙ্গী হয়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ সংশয়ে পড়ে মোটরবাইক ও ইজিবাইকের যাত্রী।

মৃত্যুও হয় অর্ধশতাধিক। শুধু ঈদ আনন্দে গ্রামের বাড়ি যাওয়াই নয়, ফিরতেও হয় নিজ আবাস ও কর্মস্থলে। সেটাও কম ঝক্কি ঝামেলার বিষয় নয়। এবার কিন্তু টিকিট বিক্রি নিয়ে তেমন কোনো বিপরীত আলামত উঠে না আসাও স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি বলাই যেতে পারে।
কোরবানি দেওয়ার পরও কত আবশ্যকীয় কর্মযোগ অপেক্ষা করে থাকে তাও এক অনন্য বিষয়। বিশেষ করে পশুর কাঁচা চামড়া বিক্রি করার জন্য ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই এক পরম সময় পার করতে হয়। তবে বিক্রেতা যথাযথ মূল্য না পাওয়ার চিত্র এবারও উঠে আসে। সরকারি দামে খুচরা বিক্রেতারা ন্যায্যমূল্যে কখনো বিক্রি করতে পারে না। প্রতিবারের মতো এবারও সরকারি দামে সারা বাংলাদেশে কোথায়ও চামড়া বিক্রি হয়নি বলে গণমাধ্যমে উঠে আসে।

কম দামে অনেকেই চামড়া বিক্রি না করার চিত্র হতাশ হওয়ার মতোই। সেখানে মালিক পক্ষ চামড়া ফেলে রেখে চলে যায় বলে জানা গেছে। ঈদ উৎসবের এমন অরাজক পরিস্থিতি আনন্দ আয়োজনের বিপরীত আবহ। উৎসবের বহুমাত্রিক খুশির আমেজ এমন সব বিপাকে সংশ্লিষ্টদের নাজেহাল করে দেয়। তবে ব্যবসায়ীরা তাদের কারসাজি সফল করে অত্যধিক মুনাফা অর্জনে কোনোভাবেই পিছিয়ে থাকেন না। 
এখন আষাঢ় মাসের বৃষ্টিপাতে জনজীবন প্রায় স্থবির। তার মধ্যে ঋতুকালীন মৌসুমি বায়ুর অনুপ্রবেশ পরিস্থিতির চরম বিপন্নতা। রৌদ্রদাহ নেই। ঝিরঝির বৃষ্টিপাতে যে মাত্রায় ভ্যাপসা গরম হানা দেয় তাও বর্ষাকালের এক দুর্বিপাক। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সারা বাংলাদেশ এখন বৃষ্টিস্নাত। ভারি বৃষ্টিপাতের অবিমিশ্র ধারায় সিলেট ও চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের মতো আরও এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ  হানা দেওয়া নির্মম পরিস্থিতির অসহনীয় দুর্গতি।

শুধু কি ভারি বর্ষণ, গগনবিদারী বজ্রপাতের দাপটে জনজীবনও ব্যাকুল। বজ্রপাতে সারাদেশে কিছুদিনের মধ্যে সাতজনের মৃত্যুর খবর উঠে আসে। সমুদ্র ও নদী তরীবর্তী সব অঞ্চলই এখন অঝোর ধারায় বরিষণে সিক্ত হলেও বিপদ আর রোগবালাই যেন অনুষঙ্গ হয়ে হানা দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠে আসাও প্রবল বারিধারার নির্মম প্রতিশোধ। বাংলাদেশ যে মাত্রায় সমুদ্র আর নদ-নদীর দ্বারা পরিবেষ্টিত সেখানে দুর্যোগ হানা দেয় বারবার। তেমন প্রাকৃতিক বৈরিতাকে সামাল দিয়ে চলতে হয় সংশ্লিষ্ট মানুষদের।

তারা বানভাসি হোক কিংবা উপকূলীয় অঞ্চলের উপদ্রুত অধিবাসীই হোক সবাই নিরাপদ, নির্বিঘেœœ জীবনযাপন করতে সবসময় বিরূপ আবহকে মোকাবিলা করে। যাপিত জীবনের এমন ঝড় ঝাপটায় নাকাল হলেও অভ্যস্ত হতে সময় নেয় না। এমন লড়াকু জীবনের সৈনিক আমাদের প্রকৃতি বিপন্নতায় আক্রান্ত এই শাশ্বত বঙ্গভূমি। যুদ্ধ, সংগ্রাম এ দেশের মানুষের রক্তে মাংসে মিশে থাকা এক অভাবনীয় মহাশক্তি। তার চেয়েও বেশি দুঃসাহসিক বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠী।

ষড়ঋতুর বিচিত্র দেশ আমাদের সৌন্দর্যম-িত চিরায়ত বঙ্গভূমি। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আবহমান বাংলা বরাবরই এক নান্দনিক সৃজনযজ্ঞের অবারিত উপহারÑ যা নিজ দেশের সৃজন বোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা ও সৃষ্টির অনুষঙ্গ হয়েছে। আবার  ভিনদেশী পর্যটকদেরও নজর কেড়েছে। তেমন অনিন্দ্য সুন্দর বাংলা যখন ভাঙনের খেলায় মেতে ওঠে হরেক নৈসর্গিক দুর্বিপাকে সেটাও এই অঞ্চলের এক অবধারিত শান্ত প্রকৃতির বিরূপ প্রতিবেশ। তেমন উন্নয়ন আর অযাচিত প্রাকৃতিক দুর্ভোগে এগিয়ে চলা আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ।

সমুদ্র আর নদী পরিবেষ্টিত বাংলা ধনধান্যে পুষ্পে আবৃত এক অনিন্দ্য সুন্দর পলিমাটির নান্দনিক চারণ ভূমি। লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আবহমান বাঙালির মনন আর সৃজনযজ্ঞে যে সুর ও বাণীর ঝঙ্কার তোলেন তাও এই বাঙালির অনন্য ভাব সম্পদ। সৃষ্টিযজ্ঞের উল্লাস আর উন্মাদনায় অতি সাধারণ বঙ্গবাসীও হয়েছে উদ্বেলিত। আর অতি আবশ্যিকভাবে সমর্পিতও বটে। সঙ্গত কারণে নান্দনিকতার মহাসমারোহের মধ্যে উত্থানের যেমন জয়ধ্বনি একইভাবে চরম বিরূপ প্রতিবেশে ভাঙনের খেলায় মেতে ওঠাও এই অঞ্চলের পরিবেশ, পরিস্থিতির ন্যায্যতা।

তাই একদিকে যেমন বৃষ্টির ধারায় প্লাবনের আশঙ্কিত আখ্যান, অন্যদিকে সৃষ্টির পর আনন্দে মুখর হওয়াও বাঙালিয়ানার নিতান্ত আনন্দ সরোবর। বিপদ-বিপত্তি সামলিয়ে নতুন করে গড়ার যে অবিমিশ্র সাধনা সেটাই এই বৃহৎ ব-দ্বীপের  অসাধারণ সক্ষমতা। সেটা শুধু পলিমাটির উর্বরতা দিয়েই নয় বরং সার্বিক জনগোষ্ঠীর অনন্য শক্তিময়তাও প্রতারকের ভূমিকায় কাজ করে। ধর্মীয় উৎসব-আনন্দও তারই অনন্য ধারা। যেখানে আস্থা আর বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয় ত্যাগ তিতিক্ষার অনমনীয় বোধ।

তেমন সমর্পণ যেমন ধর্মীয় আত্মিক অনুভবে, সমানভাবে দৃশ্যমান সাংস্কৃতিক মিলন দ্যোতনার অভাবনীয় ঝঙ্কারেও। তাই লালন, রবীন্দ্র, নজরুল এক ও অভিন্ন ধারায় যেভাবে ঈশ্বর বন্দনায় নিমগ্ন, পাশাপাশি স্বদেশ ভূমির প্রতিও নিতান্ত দায়বদ্ধতায় যথার্থ বাঙালি যোগকে ধারণ-লালন করেই তাদের সৃষ্টি ও মনন বিকাশকে উদ্দীপ্ত আর উজ্জীবিত করেন। ধর্ম আর সংস্কৃতি যখন মিলে মিশে এক ও অভিন্ন ধারায় বহমান থাকে সেখানে মানুষের জয়গান ধ্বনিত হওয়া নির্মল পরিস্থিতির বরমাল্য।

জাতিসত্তা হিসেবেও আমরা এক সমৃদ্ধ অস্ট্রিক গোষ্ঠীর বংশ পরম্পরা। সঙ্গত কারণে মধ্যযুগের পাহাড়ি বর্বর জাতি আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মের ওপর আঘাত হানার পরিবর্তে নিজেরাই সমর্পিত হয়েছে এদেশের আদি সভ্যতার পরম উৎকর্ষের প্রতি।  মধ্যযুগেও পাহাড়ি বাবর যখন এদেশে নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে তারাই পরবর্তীতে প্রজাদের উন্নত সভ্যতা নিজেদের আচার অনুষ্ঠানে সর্বোতভাবে গ্রহণও করেন।

মধ্যযুগের বাঙালির ইতিহাস তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। প্রাচীনকাল থেকে ব্রিটিশরা আসার আগ পর্যন্ত এদেশের অস্ট্রিক জাতিসত্তা যে বাঙালি আদি বৈভবে পরিমার্জিত, পরিশীলিত ছিল সেখানে নাকি কোনো বর্বর জাতি আঁচ পর্যন্ত লাগাতে পারেনি। দিল্লির শাসকবর্গও নির্দিষ্ট খাজনার বিনিময়ে অবিভক্ত বাংলাকে কোনোভাবেই অস্থির করে তুলতে যথাসম্ভব দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করেন। সুচতুর ব্রিটিশরাই প্রথম জাতি যারা সবার আগে বাংলাকেই অধিকার করার সংকল্পে এগিয়ে আসে। 
লেখক : সাংবাদিক

×