ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

প্রবাসে টিকে থাকার কৌশল

ড. শামীম আহমদে

প্রকাশিত: ২১:০৬, ২৮ মে ২০২৪

প্রবাসে টিকে থাকার কৌশল

ড. শামীম আহমদে

একটা খুব সাদামাটা ছুটির দিনে আশপাশের কোন্ ঘটনাগুলো আপনাকে আনন্দিত করে? খুব ভালো লাগে যখন মেঘলা দুপুরে অথবা ক্লান্ত বিকেলে হাঁটবার সময় সবুজে ঘেরা কোনো ‘ঃৎধরষ’ এ বা ঝিলের পাশে বিপরীত দিক থেকে আসা কেউ আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দেন। একই কাজ আমিও করার চেষ্টা করি। হাঁটার সময়, অলস রাস্তার পাশে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসা আমার কাছে দারুণ একটা বিষয় মনে হয়।

তবে ২০১৭-তে যে পরিমাণ মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসত, সেই পরিমাণ মানুষ এখন আর হাসে না কিংবা হাসির প্রতি-উত্তরও দেয় না। কারণটা কি জানি না, তবে তা বোঝার চেষ্টা করি। মানুষের জীবন কি সাত বছরে অনেক পাল্টে গেছে? অর্থনৈতিক সামাজিক জটিলতার ফেরে মানুষ শ্রান্ত? ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যখন আচরণিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপ করি, তখন বলি একটি সমাজে নতুন মানুষের অন্তর্ভুক্তির সময় তার সাংস্কৃতিক একটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।

ভিন দেশের মানুষ নতুন দেশে তাদের দেশের সংস্কৃতি নিয়ে আসে। আবার নতুন দেশের সংস্কৃতির কিছু অংশ নিজেদের ভেতর আত্মীকরণ করে নেয়। এটি চলমান প্রক্রিয়া এবং যে দেশে যত বেশি নতুন মানুষ আসে, সে দেশে তত দীর্ঘ সময় ধরে এই প্রক্রিয়া চলমান থাকে। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতত্ত্ববিদ মিল্টন বেনেট তার ‘The Development Model of Intercultural Sensitivity’- নামক তত্ত্বে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।

মিল্টন দেখিয়েছেন কিভাবে একজন মানুষ নানা ধাপ পেরিয়ে সমাজের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে পৌঁছতে পারেন। এই পুরো প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নিজেকে চেনা এবং জানা, নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে পারা। একইসঙ্গে সমাজে অন্যদের অবদানকে স্বীকার করে নেওয়ার ঔদার্য দেখানো।

সবশেষে অন্যের ভালো গুণ, তাদের সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য উদ্যাপনে নিজেকে শামিল করে নেওয়া এবং নিজের ও অন্যের সংস্কৃতির মধ্যে আনাগোনা করার মতো যোগ্যতা অর্জন করা। যেমন ধরুন, আপনি আপনার বাসায় পরিবারের সামনে যে পোশাক পরবেন, কর্মক্ষেত্রে তো সে পোশাক পরবেন না।

কিংবা শনিবারে খাবার টেবিলে বাবা-মার সঙ্গে গল্প করতে করতে আপনি বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে যে আলাপ করবেন, সেটি যে আপনার ছাত্র কিংবা সহকর্মীদের সঙ্গে করার জন্য উপযুক্ত বিষয় নাও হতে পারে, এই ধারণাটি আপনার থাকতে হবে। 
কেবল একে অপরকে দেখে স্মিত হাসিই নয়, দীর্ঘসময় ধৈর্য নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলার পরেও কারও যদি গাড়ি ছাড়তে ১০-১২ সেকেন্ড দেরি হয়ে যায়, তবে হর্ন না দিয়ে অপেক্ষা করা। দরজা খুলে কোনো ভবনে ঢোকার বা বের হওয়ার সময় যদি ৫-৭ সেকেন্ড দূরত্বে কেউ দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকেন, তার জন্য দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা- এই বিষয়গুলো কানাডায় এসে যে কোনো নতুন মানুষ চটজলদি শিখে ফেলতে পারেন।

আরেকটি বিষয় আমরা প্রায়শ মনে করি, কেবল ভুল করলে ’sorry’ বলতে হয়, বিষয়টি কোনো কোনো সংস্কৃতিতে এমন নয়। যেমন কানাডায় দুজন মানুষ ধাক্কা খেল, পরিষ্কারভাবেই দোষ একজনের, কিন্তু দুজনেই খুব বিনীতভাবে ক্ষমা চাইতে থাকে। এই যে সাধারণ সৌজন্য, এগুলো শেখার এবং পালন করার মধ্যে কোনো গ্লানি নেই। তবে এর ব্যতিক্রমও যে নেই তা তো না, অনেক আচরণের জন্য আপনি মানুষের রুষ্ট আচরণেরও স্বীকার হতে পারেন।

আপনি পরিচিত বেশ ক’জনের কাছে শুনেছি ডধষসধৎঃ কিংবা ঈড়ংঃপড় শপিংমলে লাইনে সামনের মানুষের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তাদের কটূক্তির স্বীকার হয়েছেন কিছু বাঙালি। এই বিষয়টি নিয়েও সমাজবিজ্ঞানীদের বিস্তর কাজ আছে। আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী Edward T. Hall Zvi ’Context Continuum’ থিওরিতে দেখিয়েছেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষ থেকে কতটা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবেন, সেটিরও পরিমাপ আছে।

হল বলেছেন, দুজন মানুষ যারা খুবই ঘনিষ্ঠ, যেমন স্বামী-স্ত্রী কিংবা বাবা ও শিশু সন্তান, তবে তারা একজন আরেকজনের ৫০ সেন্টিমিটার দূরত্বের মধ্যে থেকে আলাপচারিতা চালাতে পারেন, যেখানে ব্যক্তিগত অন্যান্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন বাবা-মা ও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের ক্ষেত্রে সে দূরত্ব ১ মিটার পর্যন্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে সামাজিক সম্পর্কের দাঁড়িপাল্লায় দুজন ব্যক্তির মধ্যে সে দূরত্ব হওয়া উচিত ন্যূনতম ১ মিটার থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত।

সামাজিক সম্পর্ক মানে বাবা-মা-ভাই-বোন-সন্তান ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্য, অফিসের সহকর্মী, একই ভবনে থাকা প্রতিবেশী, বিয়ে বাড়িতে দেখা হওয়া পরিচিত মানুষজন ইত্যাদি। এর বাইরে যত সম্পর্ক যাদের সাধারণ ভাষায় আমরা বলি ‘পাবলিক’- তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় ৪ মিটারের বেশি দূরত্ব বজায় রাখা উচিত।

তাই কানাডায় আসলে আমরা যদি দেশের মতো কারও ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে তার মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি, অথবা কাঁধের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে লাইনে দাঁড়াই, তবে রুষ্ট আচরণের স্বীকার হলে অন্যের দিকে আঙুল তোলার আগে আমাদের নিজেদের ভাবতে হবে, আমি কি নতুন দেশের সংস্কৃতি ও আচারের সঙ্গে নিজেকে অভ্যস্ত করতে পেরেছি?

একটি নতুন দেশে আগত অভিবাসীরা যেমন সেই দেশের সংস্কৃতিকে উন্নত করতে অবদান রাখেন, তেমনি নতুন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়টিকেও একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে ভাবতে পারেন। নতুন দেশের ভাষা, চাকরি পাওয়ার জন্য কোর্স ইত্যাদি শেখার জন্য আমরা যে পরিমাণ আগ্রহ দেখাই, ঠিক সেই পরিমাণ আগ্রহ আমাদের দেখানো উচিত তাদের নিজস্ব শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক আচার-আচরণ বোঝার ক্ষেত্রেও।

আমরা কোনো বিদেশীকে বাংলাদেশে এসে শাড়ি-পাঞ্জাবি পরতে দেখলে কিংবা হাত দিয়ে ভাত-তরকারি খেতে দেখলে যেমন উদ্বেলিত হই; তেমনি অন্যের দেশকে নিজের দেশ বানানোর প্রক্রিয়ায় তাদের প্রতিও একই সহমর্মিতা ও আনুগত্য দেখানো দরকার খানিকটা আছে বৈকি। নতুন দেশে টিকে থাকার জন্য কেবল উচ্চশিক্ষা আর কারিগরি কৌশল জানা থাকলেই চলে না, অভিযোজনের আগ্রহ এবং ইচ্ছা থাকাও সমান জরুরি। 

[email protected]
২৬ মে ২০২৪

×