ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মে দিবসের তাৎপর্য এবং বাস্তবতা

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

মে দিবসের তাৎপর্য এবং বাস্তবতা

আজ মহান মে দিবস। দিনটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন

আজ মহান মে দিবস। দিনটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। সকল শ্রমিকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। দিনটি সকল শ্রমজীবী মানুষের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দিন। মে দিবসের রয়েছে একটি বেদনাদায়ক ইতিহাস। এই দিনেই শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। এই বেদনাবহ দিনটির ওপর ভিত্তি করেই শ্রমজীবী মানুষ আদায় করতে পেরেছিল তাদের অধিকার, সামাজিক মর্যাদা ও দৈনিক একটি সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা। এই দিনটির মাধ্যমেই শ্রমিকরা পেয়েছিল তাদের অধিকার আদায়ের ভিত্তি ও পুঁজি।
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে একটি শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ১০ থেকে ১২ জন শ্রমজীবী মানুষ নিহত হন। শ্রমজীবী মানুষের এই আত্মত্যাগ সারাবিশ্বের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে তোলে। দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবির এই যৌক্তিক আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৯০ সালে শিকাগোর শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদ বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে পালনের প্রস্তাব করা হয়। মূলত সেই সময় থেকেই পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের সূচনা হয়। পরবর্তীতে ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের একটি সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি আদায় এবং শ্রমিক-মালিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবছর মে মাসের ১ তারিখ বাধ্যতামূলক কাজ না করা, ওই দিন সকালে মিছিল, শোভাযাত্রার আয়োজন করার জন্য বিশ্বের সকল শ্রমিক সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নকে আহ্বান জানানো হয়।

১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর মে দিবস বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমারোহে পালন শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে সরকারিভাবে মে দিবস পালিত হয়। ৮০টি দেশ ব্যতীত বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মে দিবস বেসরকারিভাবে পালিত হয়। অবশ্য যে শিকাগো শহরে শ্রমিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই মে দিবসের সূচনা সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশ কানাডায় এখনো মে দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয় না।
মে দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই শ্রমিকরা তাদের উপযুক্ত সামাজিক মর্যাদা পেয়েছে। কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টায় নেমে এসেছে। মে দিবসের মাধ্যমেই শ্রমিকদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং কমতে শুরু করেছে সামাজিক বৈষম্য। শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি সম্মান জানাতে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশে যথাযথ মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের এই উন্নয়নশীল দেশে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসেও মে দিবসের চেতনা ও তাৎপর্য শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

মে দিবসের সকালে এখনো দেখা যায় অসংখ্য মানুষকে কাজের সন্ধানে বের হতে। কারণ দৈনিক কাজে না বেরোলে পরিবারের আহার যোগানো সম্ভব হয় না অনেক মানুষের।
এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের বাধ্যবাধকতা মানা হয় না। আমাদের পোশাক খাতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করে। এসব গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষেত্রে আট ঘণ্টার বেশি কাজ হয় প্রতিদিন। এই অতিরিক্ত কাজের মূল্য ঠিকমতো পরিশোধ করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেকেই ওভারটাইম করতে রাজি না থাকলেও বাধ্য হয়ে তা করতে হয়। এই অতিরিক্ত সময়ের টাকা দিতেও মালিকপক্ষের নানারকমের ছলচাতুরী করার প্রবণতা দেখা যায়। এই চিত্র শুধু  পোশাক খাতে নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সত্য।
অতিরিক্ত সময় কাজ করানোর পরও অনেক প্রতিষ্ঠান দেয় না শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক ও ওভারটাইম। প্রতিবছর এখনো দেখা যায় ন্যায্য বেতন ও বোনাসের দাবিতে শ্রমিকরা রাস্তায় আন্দোলন-বিক্ষোভ করছেন। ২০২৪ সালের ২১ এপ্রিল মার্চ মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে ক্রোনী গ্রুপের রপ্তানিমুখী কারখানাটির শ্রমিকরা ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে শিল্প পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৫০ জন শ্রমিক ও ১০ পুলিশ সদস্য আহত হন। সংঘর্ষের ঘটনায় ৮৩০ শ্রমিকের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা হয়।

ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে মামলা খেতে হলো শ্রমিকদের। মালিক কর্তৃপক্ষের উচিত শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার যথাযথ পূরণ করা। শ্রমিকদের স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। শ্রমিকদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাতে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হবে। এতে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব, যা সার্বিক অর্থে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নিত হবে।
রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা আর একটি উদাহরণ। রানা প্লাজা, তাজরীন গার্মেন্টস, রূপগঞ্জসহ কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আমাদের অনেক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে জীবনের অবসান হয়েছে। যেগুলো কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো বিষয় নয়। যখন একটি পরিবার তাদের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে আর জীবিত পায় না তখন সেই পরিবারে কালোমেঘের ছায়া নেমে আসে। আসে নানাবিধ ক্ষত-যন্ত্রণা। তাই সরকারকে কার্যকরী এবং যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে এসব প্রতিরোধে এবং শ্রমিকরা যাতে নিরাপদে কাজ করতে পারেন। 
কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ক্ষতিপূরণ পেতে শ্রমিকদের হয়রানির শিকার হতে হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই ঘটনাগুলো দুঃখজনক। সরকার শ্রমিকদের সমস্ত অধিকার নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যেই ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’ ও ‘বাংলাদেশ শ্রম বিধি ২০১৫’ বলবৎ করেছে। সরকার শ্রমিকদের এই সকল সমস্যা নিরসনে যথেষ্ট উদ্যোগী হলেও যথাযথ তদারকি এবং শ্রমিক-মালিক সমন্বয়হীনতার কারণে সকল উদ্যোগ শতভাগ বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি।

সমস্যা সমাধানে শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক-মালিককে একযোগে কাজ করতে হবে। তবেই মে দিবসের সত্যিকারের চেতনা ও গুরুত্ব বাস্তবায়ন হবে। মে দিবসের চেতনা বাস্তবায়ন হলে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে। শ্রমিকরা তাদের যথাযথ পারিশ্রমিক ও মর্যাদাপ্রাপ্ত হবেন। দেশের অর্থনীতি হবে সমৃদ্ধিশালী।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ

×