সর্বজনীন পেনশন চালু
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব শ্রেণিকে উদ্দেশ করে সর্বজনীন পেনশন চালু করা হয়েছে, তাদের মনে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও সততা নিয়ে নানা কারণেই অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল সুশৃঙ্খল ও সরাসরি সুবিধাভোগী শ্রেণির কিছু অংশকে এই পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে মানুষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা। চীন ও ভারতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের শুরুতে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা পরে সর্বস্তরে বিস্তৃত হয়। মানুষ এতে সাড়াও দেয়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অকাল তিরোধানে স্বাধীন বাংলাদেশ যা কিছু হারিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের মানুষ সমতা ভুলে গেছে, বিবেকশূন্য মন নিয়ে সর্বস্তরে বৈষম্যের বাড়বাড়ন্ত রূপকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই সুযোগে সামরিক, স্বৈরাচারী ও ছদ্ম গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্র ব্যবস্থা তার মৌলিক নীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। দীর্ঘ পরাধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রক্ষতায় আসীন হয়েই অতিঅল্প সময়েই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করে তার পরতে পরতে সমতা ও বৈষম্য বিলোপের জয়গান গেয়েছিলেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই এখন স্বপ্রণোদিত হয়ে বৈষম্যের বিস্তার ঘটাচ্ছে, যা খুব নীরবে সমাজ ও অর্থনীতি ব্যবস্থায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই উত্তরোত্তর অধিক হারে বহুমাত্রিক বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করছে। সর্বব্যাপ্ত এই বৈষম্য ও তার বিস্তার নিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা যে একেবারেই নির্বিকার তা নয়।
তবে সময়ে সময়ে তাদের কিছু নীতি-সিদ্ধান্ত বৈষম্যের সঙ্গে রাষ্ট্রের গভীর সম্পর্ককেই নির্দেশ করে, যার নতুনতম উদাহরণ হতে পারে সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের মহৎ উদ্যোগ ‘সর্বজনীন পেনশন’ ব্যবস্থায় দেশের চার শতাধিক স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ ও সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের ‘প্রত্যয়’ শীর্ষক এক একটি কর্মসূচির মাধ্যমে সরাসরি বৈষম্যের শিকার হতে বাধ্য করা।
এতে করে ভাগ্যের ফেরে দিনকয়েকের ব্যবধানে নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশীরা দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র তথা জনগণের সেবা করেও ভবিষ্যতের উন্নত বাংলাদেশে ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হলে সমগোত্রীয়দের তুলনায় ভিন্ন আঙ্গিকে কম পেনশন ও অবসরোত্তর সুযোগ-সুবিধা পাবেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈষম্যপূর্ণ এই নীতি বাস্তবায়ন হলে রাষ্ট্র নিজেই নিজের মধ্যে পৃথক এক রাষ্ট্র সৃষ্টি করে দ্বিচারিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে, যেখানে একদিকে সংখ্যাস্বল্প সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আনুষ্ঠানিকভাবে এলিট শ্রেণিতে পরিণত হবেন; অন্যদিকে বিশালসংখ্যক মেধাবী ও বিশেষায়িত জ্ঞানের বাংলাদেশীরা সরকারি উদ্যোগে জনগণের সেবায় যোগ দিতে নিরুৎসাহিত হবেন, যা পুরোপুরি সংবিধানবিরুদ্ধ।
ঘটনায় প্রকাশ, সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়েছে যে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ ও সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানে যারা যোগদান করবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিমের আওতাভুক্ত হতে হবে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন স্কিম ভিন্ন আঙ্গিকের, যেখানে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যৌথ কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে মাসিক ভিত্তিতে যে টাকা জমা হবে, তার মূল ও মুনাফার ওপর অবসরে গেলে মাসিক ভিত্তিতে পেনশন দেওয়া হবে।
এর সুবিধাভোগীরা বহুগুণ বেশি টাকা পাবেন। যেমন বর্তমানে বেশিরভাগ স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী কন্ট্রিবিউটরি পেনশন ফান্ড (সিপিএফ) বা প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলের মাধ্যমে অবসরকালীন সুবিধা পেয়ে থাকেন। এই ব্যবস্থায় মূল বেতন থেকে টাকা জমা রাখতে হয় তহবিলে। কর্মীরা জমা দেয় বেতনের ১০ শতাংশ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। মোট তহবিলের বিপরীতে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে থাকে, যা পেনশনে যাওয়ার পর অবসরভোগীরা এককালীন অর্থ হিসেবে পেয়ে থাকেন।
অন্যদিকে সরাসরি সরকারি রাজস্ব খাতভুক্ত কর্মীরা জেনারেল পেনশন ফান্ড (জিপিএফ) বা সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের মাধ্যমে অবসরোত্তর সুবিধা পেয়ে থাকেন। তারা এককালীন অর্থের পাশাপাশি মাসিক ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাও পেয়ে থাকেন। কিছুদিন পর প্রত্যয় স্কিমের অন্তর্ভুক্তরা অবসরের পর পুরোপুরি সরকারি সুবিধার বাইরে চলে যাবেন। অর্থাৎ বৈষম্যে থাকলেও এখনকার সিপিএফধারীরা যে কিছু সরকারি নিশ্চয়তা ও সহায়তা পেতেন, সামনে সেটুকুও হারাবেন।
আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও সংস্থা, যাদের মধ্যে রয়েছে দেশের সকল সাধারণ, প্রকৌশল, মেডিক্যাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ কিছু বিশেষ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইনস্টিটিউট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বজনীন পেনশন বলা হলেও প্রকৃত অর্থে তা সর্বজনীন রূপরেখা পায়নি। অনেক জিজ্ঞাসার সমাধান হয়নি। ফলে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায়নি। তাদের মতে, বিশাল এক উদ্যোগের ভুল-ভ্রান্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উদীষ্ট জনগোষ্ঠী আকর্ষিত করতে কর্মসূচির শুরুতেই যে সর্বজনীন অবয়বের প্রয়োজন হয়, তা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নেই।
কারণ বাংলাদেশে ২০ শতাংশ শিক্ষিত তরুণ বেকার, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৪০ শতাংশ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ৭৬ শতাংশ পুরুষ মনে করে ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে তারা নারীর তুলনায় বেশি যোগ্য এবং দেশের ৮০ শতাংশ কর্মজীবী অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মী, যাদের আর্থিক উপার্জন অতিস্বল্প, বৈষম্যপূর্ণ, নিশ্চয়তাহীন এবং রাষ্ট্রীয় আইন-বিধিও তাদের বিরোধী, সংখ্যাস্বল্প পুঁজিপতি মালিক শ্রেণির উপযোগী।
পক্ষান্তরে সরকারের রাজস্ব খাত এবং স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ ও সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের জিপিএফ-সিপিএফ নীতিমালা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথমত একজন জিপিএফ পেনশনধারী মূল বেতনের ১০-৩০ শতাংশ ভবিষ্য তহবিলে জমা করতে পারেন, এখানে ব্যাংক কোনো অনুদান দেয় না, বরং সরকার চাকরি শেষে তাকে সমুদয় অর্থ মুনাফাসহ এককালীন ও মাসিক ভিত্তিতে প্রদান করে।
অন্যদিকে একজন সিপিএফ গ্র্যাচুইটিধারী ভবিষ্য তহবিলে তার মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমা রাখতে পারেন; এক্ষেত্রে জমা টাকার বিপরীতে ৮-১০ শতাংশ অর্থ অনুদান/সুদ হিসেবে প্রদান করে (ব্যাংক প্রদত্ত সুদ মাঝে-মধ্যেই কমানো হয়)। দ্বিতীয়ত ২৫ বছর নিয়মিত চাকরি শেষে একজন জিপিএফধারী আনুতোষিক বাবদ ৮০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পান।
অন্যদিকে একজন সিপিএফধারী চাকরি জীবনের দ্বিগুণ (২৫ বছর চাকরি হলে ৫০, ৩০ বছর চাকরি হলে ৬০) মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ আনুতোষিক হিসেবে পান। অর্থাৎ এখানে একজন সিপিএফধারী ২০-৩০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ কম পান। তৃতীয়ত একজন জিপিএফধারী তার প্রাপ্ত মাসিক পেনশন, যা এককালীন জমা করলে ৪০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পান। অন্যদিকে একজন সিপিএফধারীর পেনশনের কোনো সুবিধাই নেই।
অর্থাৎ এখানেও একজন সিপিএফ ৪০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ কম পান। চতুর্থত একজন জিপিএফ পেনশনধারীর সুপার অ্যানুয়েশন তহবিলে ৩০ শতাংশ সঞ্চিতি রাখা হয়। অন্যদিকে একজন সিপিএফধারীর গ্র্যাচুইটি তহবিলে ১৫ শতাংশ সঞ্চিতি রাখা হয়। এক্ষেত্রে ১০ শতাংশ অনুদানসহ হিসাব করলে মোট ৫ শতাংশ সঞ্চিতি কম রাখা হয়। সবদিক বিবেচনায় একজন সিপিএফধারী কর্মী জিপিএফধারীর তুলনায় ২৫-৩০ বছর চাকরি শেষে অন্তত দেড়গুণ কম আর্থিক সুবিধা পান। সাদা চোখে সরাসরি প্রত্যক্ষ বৈষম্য।
আগামী ১ জুলাইয়ের পর স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোয় যোগদানকারীরা বৈষম্যপূর্ণ সিপিএফ সুবিধাটুকুও পাবেন না। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে তহবিলে সংস্থার প্রদানকৃত অর্থ ছিল কর্মচারীর কন্ট্রিবিউশনের চেয়ে কম, এখন প্রত্যয় স্কিমে প্রতিষ্ঠানকে কর্মীর সমপরিমাণ টাকা জমা দিতে হবে। ফলে পেনশনার অধিক লাভবান হবেন, বহুগুণ টাকা বেশি পাবেন। আর সরকার বলছে, এই ব্যবস্থায় সরকারের ভর্তুকি চাপ কমবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ব্যবস্থায় পেনশনের সময় হলে মুদ্রার মান বিবেচনায় প্রাপ্ত টাকা পেনশনভোগীর প্রত্যাশিত ব্যয় নির্বাহে অপ্রতুল হবে এবং এতে করে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা-বৈষম্য ও ক্ষতির শিকার হবেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষা ও জ্ঞান কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যতের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
তাদের মতে, এমনিতেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত কর্মক্ষেত্রে মেধাবী ও যোগ্যকর্মীর প্রচ- ঘাটতি রয়েছে, তার ওপর এখন প্রত্যয় স্কিমের মাধ্যমে যোগ্য ও মেধাবীদের রাষ্ট্রের ডাকে জনগণের সেবায় ব্রতী হতে সরাসরি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর আগে ২০২৩ সালে নতুন আয়কর আইনে বেসরকারি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করে এবং করছাড় তুলে দিয়ে কল্যাণ তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) থেকে অর্জিত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে দৃষ্টিকটু রকম বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন প্রত্যয় নামে নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
গণমাধ্যম খবর বলছে, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ ও সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় নিয়মের সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিশ্লেষণে ব্যস্ত রয়েছেন। অনেকে আবার অল্পের জন্য ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তিতে আনন্দ ও স্বস্তি প্রকাশ করছেন। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধিতা করে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছেন এবং শিক্ষাঙ্গনের ক্ষেত্রে এই নিয়ম বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
কারণ তাদের দৃষ্টিতে এতে করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এক সময় মেধাশূন্য হয়ে পড়বে, যা মানসম্পন্ন ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের চেষ্টাকে গুরুতর বাধার মুখে ফেলবে। তাদের মতে, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে কর আরোপ এবং স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ ও সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের পেনশন নিয়মে পরিবর্তন স্পষ্টতই বাংলাদেশের মহান সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুচ্ছেদ ৭ (সংবিধানের প্রাধান্য ও প্রজাতন্ত্রের মালিকানা), অনুচ্ছেদ ১০ (সমাজতন্ত্র ও শোষণ মুক্তি), অনুচ্ছেদ ১১ (গণতন্ত্র ও মানবাধিকার), অনুচ্ছেদ ১৫ (মৌলিক প্রয়োজন- অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থাকরণ), অনুচ্ছেদ ২৬ (মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল), অনুচ্ছেদ ২৭ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), অনুচ্ছেদ ২৮ (ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, লিঙ্গ, জন্মস্থান ভেদে বৈষম্য বাতিল) এবং অনুচ্ছেদ ২৯ (প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সমতা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দান) ও অনুচ্ছেদ ৪০ (পেশা বা বৃত্তি লাভের অধিকার)-এর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক। আর সংবিধানে তো বলাই আছে, ‘অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তা হলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হবে’ [গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদ ৭ (১) ও ৭ (২)]।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার মানসে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়, যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। বিপুল উৎসাহ ও আশা নিয়ে সরকারি চাকরি ও পেনশন ব্যবস্থায় যারা নেই অর্থাৎ বেসরকারি চাকরিজীবী, প্রবাসী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত কর্মী এবং অসচ্ছল ব্যক্তিদের ৬,১০০ জন ঘোষণার প্রথম দিন বিকেল ৫টার মধ্যেই নিবন্ধন করেন এবং অনেকে প্রথম কিস্তির চাঁদাও জমা দেন। তবে অস্পষ্টতা, প্রচার-প্রচারণার অভাব, অপপ্রচারণা ও সন্দেহের দোলাচলে পড়ে অল্প কিছুদিন পরেই এই কর্মসূচিতে ভাটা পড়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব শ্রেণিকে উদ্দেশ করে সর্বজনীন পেনশন চালু করা হয়েছে, তাদের মনে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও সততা নিয়ে নানা কারণেই অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল সুশৃঙ্খল ও সরাসরি সুবিধাভোগী শ্রেণির কিছু অংশকে এই পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে মানুষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা।
চীন ও ভারতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের শুরুতে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা পরে সর্বস্তরে বিস্তৃত হয়। মানুষ এতে সাড়াও দেয়। অথচ বাংলাদেশে প্রথমে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী, প্রবাসী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী এবং অসচ্ছল ব্যক্তিদের নিয়ে এই ব্যবস্থা শুরু হয়, যাদের জীবন বহুমাত্রিক বৈষম্যে ভারাক্রান্ত।
এ অবস্থার মধ্যেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষায়িত অংশের মানুষকে বাধ্যবাধকতায় ফেলে সর্বজনীন পেনশনের বিরোধী পক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। এতে করে বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু লালিত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি