বঙ্গবন্ধু ও মুজিবনগর
বাঙালি জাতির সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামমুখর ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, গৌরবময় এবং অবিস্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই মহান যুদ্ধে বিজয় অর্জন। সর্বস্তরের জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ এবং বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ সেই সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়েই সগৌরবে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
বাঙালির দেশ বাংলাদেশ। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের এই পরিচয়কে এই দেশের কাদামাটিমাখা রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তিভূমিতে দাঁড় করিয়ে গৌরবময় অবস্থান রচনায় সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির বহু বছরের লড়াই সংগ্রামের রক্তখচিত ইতিহাস এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের গৌরবদীপ্ত রাজনীতির গায়ে অনন্য শিল্পসুষমা যুক্ত করে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি এনে দিয়েছেন যে অমর কবি, তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে তো কবি বলে মানতেই হয়। ‘স্বাধীনতা কাব্যে’র মহান কবি তিনি; বিদেশী এক সাংবাদিক সেই কবেই তাঁকে বলেছেন পোয়েট অব পলিটিক্স।
১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর কোটি কোটি বাঙালির অশ্রুজলের মূল্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এই অগ্নিগর্ভ একাত্তরের পিছনে আছে উদ্দাম সত্তর, বাঁধন ছেঁড়া ঊনসত্তর, তরঙ্গমুখর ছেষট্টি, তারও পেছনে আছে বায়ান্নোর রক্তভেজা পথ। এমনি আরও কত লড়াই সংগ্রামে উদ্দীপ্ত দিন পেরিয়ে তবেই আসে একাত্তর।
বাঙালির জাগরণের প্রতিটি ধাপে দৃঢ় প্রত্যয়ে পা রেখেছেন বঙ্গবন্ধু, সামনে তাঁর লক্ষ্য স্থির করেছেন স্বাধীনতা। পরাধীন একটি জাতির মানসজগতে পরিবর্তন এনে কঠোর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নে উচ্চকিত করে তোলার রাজনৈতিক শিল্পকলা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক উদারনৈতিক জীবনাচারের ধারাবাহিকতা থেকে। সে কারণেই এ দেশের শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত মানুষ অকৃত্রিমভাবে ভালোবেসেছে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে।
তাঁর স্বপ্নজয়ী নেতৃত্বের আপোসহীন বলিষ্ঠতায় মুগ্ধ হয়ে তারা অবিচল আস্থা এবং নিঃশর্ত আনুগত্য দেখিয়েছে। তাঁরই আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে। শান্তিকামী মানুষের নেতা শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। বর্বর ও বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানি শাসকচক্র বেছে নিয়েছে বল প্রয়োগের পথ, বাঙালিকে ঠেলে দিয়েছে সশস্ত্র হামলার মুখে, স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা।
বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে ঘুরে দাঁড়িয়েছে গোটা জাতি। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলার মাধ্যমে সাধ্যমতো প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে জাতি। অতঃপর মহান নেতার নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের মাটি থেকে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর শেষ সৈন্যটি উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে গেছে প্রাণপণ। শক্তি-সাহস-মনোবল-ঐক্য সব আছে, নেই শুধু বঙ্গবন্ধুর শারীরিক উপস্থিতি।
তবু তাঁর আদর্শিক উপস্থিতিকে প্রেরণার উৎস বিবেচনা করে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে তাঁরই নামে ও নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম সরকার আত্মপ্রকাশ করে। অদ্যাবধি দেশে-বিদেশে সে সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’ নামেই অনেকের কাছে পরিচিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের যে গভীর এবং সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ছিল, সে কথা আজ সর্বজন স্বীকৃত ।
তবু মুজিবনগরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্পর্কের অন্তর্লীন গভীরতা এবং রাজনৈতিক রসায়ন উপলব্ধিতে ব্যর্থ হয়ে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করতেও পারেন। তাঁদের প্রতি সম্মান রেখে সবাইকে অনুরোধ জানাই, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি কেমন ছিল সেই স্মৃতি স্মরণ করার জন্য।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে পরিচালিত বাঙালি জাতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ সংগ্রাম অনেকাংশে অসংগঠিত, পারস্পরিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলাবিহীন এবং একক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার কারণে যখন বিপর্যস্ত প্রায়, ঠিক তেমন বিপন্ন সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ সমগ্র তৎপরতাকে সেই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে এনে সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে সরকারেরই নেতৃত্বে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে মুজিবনগরে দাঁড়িয়ে ১৭ এপ্রিলের অঙ্গীকার ঘোষণা, বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যম-িত ও গৌরবময় ঘটনা। এই ঘটনাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বড় বাঁক বদল ঘটিয়েছে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের শিকল ভেঙে যখন বেরিয়ে আসছে অসাম্প্রদায়িক নতুন রাষ্ট্র, কৃত্রিম জাতি পরিচয়ের বাঁধন ছিঁড়ে যখন উত্তাল তরঙ্গবিক্ষুব্ধ বাঙালি তার হাজার বছরের শিকড়সম্পৃক্ত জাতি পরিচয় প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর, সোনালি ঊষার সোনারাঙা সেই ১৭ এপ্রিলে (১৯৭১) মেহেরপুরে অখ্যাত গ্রাম বৈদ্যনাথতলা তখন গোটা জাতির প্রাণের স্পন্দনকে আপন বুকে ধারণ করে ইতিহাসের দাবিতেই নতুন নাম গ্রহণ করে মুজিবনগর। ‘মুজিব’ শব্দটি তখন সমগ্র জাতির কাছে সাহস আর শক্তির প্রতীক, সংগ্রাম ও মুক্তির অন্য নাম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপকার ও মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। কিন্তু তাঁর আদর্শিক উপস্থিতি প্রত্যেক বাঙালির অন্তরে অন্তরে। সেই উপলব্ধি থেকেই নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ১৭ এপ্রিল মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের সেই শুভ দিনে বৈদ্যনাথতলার নতুন নাম উচ্চারণ করেন মুজিবনগর। বাঙালির স্বপ্নজয়ী মহান নেতা শেখ মুজিবের নামে চিহ্নিত এই মুজিবনগরের মাথায় পরিয়ে দেয় অস্থায়ী রাজধানীর রাজমুকুট।
মুজিবের শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁরই নামে গঠিত মুজিনবনগর সরকারের নেতৃত্বে সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাহায্য সহযোগিতা ও স্বীকৃতি আদায়ে তৎপর হওয়া, দেশত্যাগী শরণার্থীদের সীমাহীন দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানো- সবই ঘটেছে সুচারুরূপে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনই মুজিবনগর সরকারের প্রধান সাফল্য। মনে রাখতে হবে, বৈদ্যনাথতলার মাটিতে আত্মপ্রকাশ ঘটলেও যুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর কেবল সেই বৈদ্যনাথতলাতেই আটকে থাকেনি, ১৭ এপ্রিল থেকে ‘মুজিবনগর’ হয়ে উঠেছে মুক্তির প্রতীক, স্বাধীনতার স্মারক।
এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বাঙালির মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যখন যেখানে বসে জরুরি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন সেই জায়গাটাই হয়ে উঠেছে মুজিবনগর। শত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য মুজিবনগরকে এমন ভ্রাম্যমাণ চরিত্রও গ্রহণ করতে হয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা সেই মহান নেতার ‘মুজিব’ নামের কল্যাণে। শুধু বৈদ্যনাথতলা নয়, একাত্তরের যুদ্ধদিনে তো বাংলাদেশেরই অন্য নাম হয়ে ওঠে মুজিবনগর।
দেশের মানুষ জানে তাদের নেতা মুজিব আছেন সারাদেশে ঘরে ঘরে, বাঙালির অন্তরে; আর এরই নাম মুজিবনগরে থাকা। শারীরিক উপস্থিতির কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে, কিন্তু আদর্শিক এই উপস্থিতি এতই শক্তিশালী ও প্রেরণাদায়ী যে, তা কোনো সীমানা মানে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ তো বটেই, পৃথিবীর বহু বড় বড় অর্জনের নেপথ্যে নেতৃত্বের আদর্শিক উপস্থিতিই যে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, এতে কোনো সংশয় নেই।
একাত্তরের যুদ্ধদিনের বাস্তবতায় বিবেচনা করলে উপলব্ধি করা সহজ হবে বঙ্গবন্ধু ও মুজিবনগর কোনো পৃথক সত্তা নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রশ্নে এ দুই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে নিবিড়ভাবে। জন্মসূত্রে আমি মুজিবনগর সন্নিহিত এলাকার মানুষ হওয়ায় ১৭ এপ্রিলের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শুধু একাত্তরে নয়, এখনো তারা বঙ্গবন্ধু ও মুজিবনগরকে অভিন্ন এবং অবিভাজ্য সত্তা হিসেবেই জানেন।
সত্যি বটে, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, কৃষি ও অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুতকরণ, আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি ও সমর্থন সংগ্রহসহ অন্যান্য নানা কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে, তাঁরই নামে স্থাপিত বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরে পদার্পণের সুযোগ তাঁর হয়ে ওঠেনি। তাই বলে এই অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে যারা বঙ্গবন্ধু ও মুজিবনগর শব্দযুগলের মধ্যে নিহিত অন্তর্লীন সুতো কেটে দিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য কিছুতেই মহৎ হতে পারে না।
তারা এই কূট অভিমতের দ্বারা একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধুর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, অন্যদিকে তেমনি একাত্তরের সতেরোই এপ্রিল মুজিবনগরে প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সুদূরপ্রসারী অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে অসচেতনভাবে হলেও মূলত ইতিহাস-বিকৃতির মতো জঘন্য অপরাধ করে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বঙ্গবন্ধু এবং মুজিবনগর একই বৃন্তে প্রস্ফুটিত দুটি অগ্নিকুসুম। এই দুটি সত্তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তা করতে গেলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবেÑ সেটা নিশ্চয়ই কারও অভিপ্রায় হতে পারে না।
লেখক : বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত