ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

রাশেদা খালেক

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ২৮ মার্চ ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

আমাদের মা-বোনেরা তথা নারী মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছেন

আমাদের মা-বোনেরা তথা নারী মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছেন কোনো তকমা বা খেতাবের জন্য নয়। তারা লড়াই করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। বাংলাদেশের শহরে-নগরে, গ্রামেগঞ্জে আরও কত শত নারী রয়েছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে গেছেন দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের গর্ব ও অহংকারের শেষ নেই। মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশের আপামর জনগণের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধু পুরুষরাই করেনি, করেছে নারীরাও। কেউ অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছে, কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রƒষা করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে, মনোবল জুগিয়েছে, কেউ বর্হিবিশ্বে স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্বমত গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত থেকেছে।

এমনিভাবে এ দেশের সকল মানুষ (শুধু কিছু সংখ্যক নরপশু আলবদর, আল শামস্ ও রাজাকার ছাড়া) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তাই এক অর্থে বলা যায়, দেশের প্রতিটি মানুষ ছিলেন এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে বাঙালি নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রেখেছে অসামান্য অবদান।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশব্যাপী যে হত্যা, ধ্বংস, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের মহোৎসব চালিয়েছিল, সেই নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে মমতাময়ী বাঙালি নারী জীবনের সকল ঝুঁকি নিয়ে শুধু বাবা-ভাই,স্বামী-সন্তানকে যুদ্ধে পাঠাননি, নিজেরাও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নারী সংগঠক হিসাবে কাজ করে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা হচ্ছেন- বেগম তাইবুন নাহার রশিদ, বেগম সাজেদা চৌধুরী, বেগম বদরুন্নেসা আহমদ, নূরজাহান মুরশিদ।

বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বেগম মতিয়া চৌধুরী, বেগম সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। সহ-সংগঠক হিসাবে কাজ করেছেন বেগম রাফিয়া আক্তার ডলি, আইভি রহমান, অধ্যাপিকা মমতাজ বেগম, বেগম হোসনে আরা মান্নান, মালেকা বেগম, আয়শা খানম, বেবী মওদুদ, মুশতারি শফি প্রমুখ নারী নেত্রীরা।
মুক্তিযুদ্ধে ’৭১-এর রণাঙ্গনের কয়েকজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধার কথা না বললেই নয়। শিরিন বানু মিতিল ছিলেন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী ও মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর নারী-পুরুষ সবাই মানসিকভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। ২৭ মার্চ পুলিশ লাইনে যুদ্ধ শুরু হলে শিরিন বানু মিতিল পুরুষের বেশে সার্ট-প্যান্ট পরে তার দুই খালাত ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়ে। ২৮ মার্চ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ৩৬জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং শিরিন বানুর দলের ২ জন শহীদ হন। এভাবে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ মার্চ পাবনা শহর স্বাধীন হয়। পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কন্ট্রোল রুমের আওতায় শিরিন বানু বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হন।

নগরবাড়ি ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন হঠাৎ পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে শিরিন বানুরা পিছু হটতে থাকে এবং পরবর্তীতে মেজর জলিল যে ‘নারীবাহিনী’ গড়ে তোলেন, শিরিন বানু মিতিল সেই বাহিনীর সদস্যা হিসাবে কাজ করেন। তার সহযোদ্ধারা ছিলেন রওশন আরা খানম, বিভা সরকার, তুষার কণা, নাজমা, মাজেদা, লায়লা, তৃপ্তি, সন্ধ্যা, গীতা, সালমা, জোবেদা, মীরা, কমলা, জীনাত, যূথিকা, মনিকা ও আরও অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হলেও কয়েকজন সাহসী ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কয়েকটি ব্যক্তিগত বাহিনও শক্তিশালী। এই বাহিনীতে ‘হাজেরা সুলতানা’ নামে এক নারী যোদ্ধা ছিলেন। মোঃ হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে যে ‘হেমায়েত বাহিনী’ গড়ে উঠেছিল, তা ছিল ৮নং ও ৯নং সেক্টরের অধীন। এই বাহিনীতে তার স্ত্রী সোনেকা রাণী রায় এবং দুই বোন আমেনা বেগম ও মোমেনা বেগম অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন।

তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রোকেয়া কবীর, রাশেদা আমিন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন। টাঙ্গাইলের তৎকালীন ছাত্রনেত্রী  রাফিয়া আক্তার ডলি, রহিমা সিদ্দিকী মাঠে মাঠে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন। বগুড়ার মেয়ে ফেরদৌস আরা ডলিসহ লুবনা জামান, লায়লা জামান ১১নং সেক্টরে বন্দুক হাতে যুদ্ধ করেছেন। এমন অনেক নারী যোদ্ধা সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু ইতিহাসে তাদের  স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের সদস্যা ছিলেনÑ হাফিজা আখতার, ইরা কর, গীতা কর, ভক্তি, রমা, শক্তি, ডা. দীপা, লিলি দত্ত, রঞ্জিতা বিশ্বাস, তৃপ্তি, সন্ধ্যা, রোকেয়া, মুকুল মজুমদার, গীতা মজুমদার, বনলতা সরকার এবং অনেকে।
’৭১-এর মহান মুক্তিসংগ্রামে পুরুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সংগ্রামী নারী করুণা বেগম। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে স্বামী শহীদুল হাসান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দেশের অভ্যন্তরেই ট্রেনিং নিয়ে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন এবং জয়ন্তী নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে আর একজন মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

স্বামীর শহীদ হওয়ার একমাস পর ৩ বছরের শিশুসন্তান রেখে করুণা বেগম মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন গেরিলা বাহিনীর একজন সক্রিয় সদস্য। বরিশালের মূলাদী থানার কুতুব বাহিনীতে করুণা বেগম অন্য নারীযোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র শিক্ষা নিতে থাকেন। এই বাহিনীর অধীনে ৫০ নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। করুণা বেগম এই দলের কমান্ডার ছিলেন। তিনি গ্রেনেড, স্টেনগান ও রাইফেল চালানো শেখেন এবং যে কোনো ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেন।

গেরিলা যোদ্ধা করুণা বেগম কখনও ভিখারির বেশে, কখনও গ্রাম্য কুলবধূর বেশে শত্রুশিবিরে নির্ধারিত অপারেশন চালিয়েছেন। করুণা বরিশাল জেলার কসবা, কাশিমাবাদ, বাটাজোর, নঙ্গিবাজার ও টরকীর শত্রুর  যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। একদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের দায়িত্ব পড়ে করুণা বেগমের ওপর। চার ঘণ্টা ধরে প্রচণ্ড লড়াই হয়। এই যুদ্ধে ১০ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে আহত হন করুণা বেগম নিজেই। একটি গুলি এসে তার ডান পায়ে বিদ্ধ হয়। কয়েকবার শল্য চিকিৎসা হয়েছে। কিন্তু তার পা আর ভালো হয়নি। ক্র্যাচে ভর করে তিনি চলাফেরা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ সব দিনরাত্রির ভিড়ে কত মহিলা মুক্তিযোদ্ধা যে অজানা থেকে গেছেন, তার হিসেব আজও মেলেনি। স্বাধীনতার পাদপ্রদীপের নিচে যারা আজও অন্ধকারে রয়ে গেলেন, তাদেরই একজন- মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি। বড়ভাই হুমায়ুন কবির, সেজোভাই ফিরোজ কবির এবং হবু বর সেলিম শাহ্ নেওয়াজ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিন্ধান্ত নিলে ছবিও তাদের সহযাত্রী হন।

ঝালকাঠির কেওতা গ্রামের হাবিবুর রহমানের কন্যা আলমতাজ বেগম ছবি তখন দশমশ্রেণির ছাত্রী। মুক্তিযুদ্ধ শিবিরে যোদ্ধাদের রান্নাবান্নার পাশাপাশি অস্ত্রচালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন ছবি। এরপর প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিয়ে চার মাস ছিলেন পেয়ারা বাগান, গরংগল, আঠগর, কুরিয়ানা প্রভৃতি রণাঙ্গনে। যুদ্ধ চলাকালেই তরুণী ছবির নিরাপত্তার কথা ভেবে অতি সাধারণভাবে ছবির সঙ্গে সেলিমের বিয়ে হয়ে যায়। অল্পদিনের মধ্যে  মুক্তিযোদ্ধা ২ ভাই ও স্বামীকে হারিয়ে  জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত ছবি যুদ্ধের মাঠ থেকে সরে আসেননি। তার জীবনে চাওয়ার আর কিছু নেই, তিনি শুধু চান একজন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। 
এবার বলছি কালিগঞ্জের মেয়ে রোকেয়া বেগমের কথা। প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহের কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি তিনি অসীম সাহসের সঙ্গে করেছেন। বাবার বাড়িতে ভাইপোদের কাছে বহু অস্ত্র আছে খবর পেয়ে নিজ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র আনতে রওনা হয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল ভাতিজা বৌ আর কুরআন শরীফ। সারা পথ কুরআন শরীফ পড়তে পড়তে গিয়েছেন।

বাবার বাড়ির বাঁশ ঝাড় থেকে প্রচুর বাঁশ কেটে নৌকার ওপরে নিচে রেখে মাঝখানে অস্ত্রভরে রওনা দিয়েছেন। পথে বার তিনেক নৌকা থামিয়েছে মিলিটারিরা, কিন্তু কুরআন শরীফ পড়া অবস্থায় দেখে তেমন কিছু বলেনি। মুড়ি মুড়কি, কেরোসিন তেল, ম্যাচ, পয়সাকড়ি দিতে হয়েছে। এভাবে বারকয়েক গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন।

এ ছাড়াও ছেলেমেয়েদের একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন করা, তাদের লাঠি চালানো, গ্রেনেড ছোড়ার ট্রেনিং দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার জোগান দেওয়া ও খবর সংগ্রহ করা, আশ্রয় দেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো বীরত্বের সঙ্গে পালন করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাজার হাজার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা দেশে ফিরে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসারত রয়েছে খবর পেয়ে এই মমতাময়ী নারী ছুটে যান ঢাকা মেডিকেলে এবং সেবার হাত বাড়িয়ে দেন।
আমাদের মা-বোনেরা তথা নারী  মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছেন কোনো তকমা বা খেতাবের জন্য নয়। তারা লড়াই করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। বাংলাদেশের শহরে-নগরে, গ্রামেগঞ্জে আরও কত শত নারী রয়েছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য। তাদের হিসাব আজও নির্ণয় করা হয়নি। নির্ণয় হয়নি সম্ভ্রমহারা নির্যাতিত মা-বোনদের  সঠিক সংখ্যাও।

নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হোক- এ সম্পর্কে দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন, লেখালেখি ও রিট আবেদনের ফলে বর্তমান নারীবান্ধব সরকার বীরাঙ্গনা নারীদের মুত্তিযোদ্ধার সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। তাঁদের অবদানের কথা আজও গুরুত্বের সঙ্গে লেখা হয়নি। তবে একদিন নিশ্চয় লেখা হবে এবং তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ততই মঙ্গল। 
 
লেখক : শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক, চেয়ারম্যান- ট্রাস্টিবোর্ড, নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল 
ইউনিভার্সিটি রাজশাহী

×