ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

নবীন কিশোর তোমায় দিলাম

ডা. এস এম মোস্তফা জামান

প্রকাশিত: ২১:০৫, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

নবীন কিশোর তোমায় দিলাম

.

ছোটবেলায় একটা শখ ছিল। মানচিত্রে বিভিন্ন দেশ খুঁজে বের করা। ছোটখাটো কোনো মানচিত্রে বাংলাদেশকে খুঁজে পেতে বড় কষ্ট হতো। দেশের মানচিত্রের ভেতরে নামটা জায়গা হতো না। বড় দুঃখ লাগত। মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কেমন নিষ্ঠুর পরিহাস! এত মানুষকে গাদাগাদি করে এই ছোট্ট একটা দেশে রেখে দেওয়া হয়েছে। অথচ কত বড় একটা পৃথিবী। আবার কোটি কোটি মানুষ বলবার মতো কিছু করতও না তখন। প্রতিবছর বাজেট হতো দান খয়রাতের ওপর। একটা সাবান থেকে কোরবানির গরু সবই আনতে হতো বাইরে থেকে। যুবকরা শুধু মিডিল ইস্টে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় করত। কেউ কোনো প্রকারে প্লেনে চেপে বসতে পারলেই তার পরিবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলত। তারা একপ্রকার নিশ্চিত ছিল, দেশে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কিছুদিন পর পর ঝড় বন্যা জলোচ্ছ্বাস। তারা যে বিদেশে গিয়ে খুব একটা সম্মান পেত, তাও না। মিসকিনের দেশ থেকে আসা শ্রমিক। শুধু পেটভরে খাওয়া আর ভদ্রস্থ বাঁচার লোভে সব অপমান মুখ বুঁজে সয়ে যেত তারা। 

মানচিত্রে দেশটা সেই আগের মতোই আছে। এখনো খুঁজে পেতে বড় কষ্ট হয়। কিন্তু যে আফসোস নিয়ে আমরা বড় হয়েছি, সেটা আর নেই। এখন কেউ বলে না দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। মিসকিনের দেশ। অনেক প্রবাসী শ্রমিককে বলতে শুনি, বিদেশে আসার দরকার নেই। দেশেই অনেক ভালো কিছু করার আছে। বাবুবাজার ব্রিজ পার হয়ে যখন ছুটি বাড়ির পথে, বিস্মিত হয়ে যাই। এটাই কী বাংলাদেশ ?

কক্সবাজারেও রেললাইন বসে গেছে। খরস্রোতা কর্ণফুলীর তলদেশে হয়ে গেছে টানেল। ছোটবেলায় শুনতাম চট্টগ্রামে নাকি এক মস্ত সমুদ্রবন্দর আছে। পরে জানলাম নামে যত বড়, কাজে ততটা নয়। এখানে বড় কোনো জাহাজ ভিড়তে পারে না। অন্য কোনো দেশ থেকে পণ্য আনতে হলে সিঙ্গাপুর হয়ে অন্তত বার জাহাজ বদলাতে হয়। কারণ, সিঙ্গাপুরে গভীর সমুদ্রবন্দর আছে। সেই গভীর সমুদ্রবন্দর হয়ে গেছে বাংলাদেশে। শুনতাম, পারমাণবিক শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে খরচ যেমন কম, পরিবেশ দূষণও হয় না। সেই দূরের শোনা গল্পও বাস্তবে রূপ নিচ্ছে দেশে। আমাদের কত সন্ধ্যা যে কেটেছে পাঠহীন কেবল আলোর অভাবে। এখন লোডশেডিং রূপকথার গল্পের মতো অনেক শিশুর কাছে।

বিদেশের কোনো বিমানবন্দরে গেলে ঢাকার বিমানবন্দরটি নিয়ে বড় আফসোস হতো। এত ঘিঞ্জি। এত সেকেলে। থার্ড টার্মিনালের সামনে দিয়ে গাড়ি দিয়ে যাই আর মনে মনে বলি, আর কোনো দুঃখ রইল না। বিদেশে মেট্রোরেলে চড়ে এসে পরিবারের লোকজনের কাছে কত গল্প করেছি। এখন সেটা প্রতিদিনের বাহন। মাত্র ১৫ বছরে একটা দেশের এত উন্নতি পৃথিবীর আর কোথাও হয়েছে কিনা, জানি না। আমরা নিশ্চিত আরও কয়েক বছর এই ঝড়ো গতির উন্নয়ন হবে এই দেশে। কেন? ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময় যাচ্ছে। এই জিনিসটা কী? একটা জাতির ৬০ শতাংশ মানুষ (যাদের বয়স ১৫-৬৪) কর্মক্ষম থাকলে সে জাতি এর একটা সুবিধা পায়। একেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫% মানুষ এই এজ রেঞ্জের ভেতরে। ২০৩৯ সাল পর্যন্ত এই অবস্থা থাকবে। তবে কর্মক্ষম মানুষ বেশি থাকা যে সবসময় সম্ভাবনা, তাও নয়। কারণ, যত বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী থাকবে, ততই চাকরির চাহিদা বেশি হবে। ততই অস্থিরতা সৃষ্টির ঝুঁকি। কারণ, এই টগবগে তরুণরা পান থেকে চুন খসলেই রাস্তায় নামবে আন্দোলনে। 

পৃথিবীর যে দেশে যত বেশি সম্পদ তত বেশি জ্বালা। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সম্পদ নিয়ে সবচেয়ে দরিদ্র দেশ কঙ্গো। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তেলের মজুত নিয়ে ভেনিজুয়েলা পথের ভিখারি। তাই সম্পদ থাকলেই হবে না, এর ব্যবস্থাপনা জানতে হবে রাষ্ট্রকে। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময় যদি একটা জাতি সঠিক নেতৃত্ব না পায়, তার ভবিষ্যৎ কিন্তু অন্ধকার। বহুজাতি উন্নয়নের রাস্তায় উঠেও শেষমেশ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি কেবল ভুল সিদ্ধান্তের জন্য। বিদেশী প্রভুদের প্রপাগান্ডায় জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে বেছে নিয়েছে ভুল নেতৃত্ব। অনেক সম্ভাবনার আলো নিভে গেছে এক তুড়িতে।

সামনে জাতীয় নির্বাচন। তাদের প্রতি আহ্বান, তাদের সামনে একটা লম্বা সময় পড়ে আছে। যারা আরও কয়েক দশক এই দেশে থাকবেন। যাদের সামনে ঘর-সংসার হবে। বউ-বাচ্চা হবে। আজকের একটা সিদ্ধান্ত আপনার ভবিষ্যতের গন্তব্য ঠিক করে দেবে। স্থির হবে আপনি আপনার উত্তরাধিকাররা কেমন কাটাবে সামনের দিনগুলোয়। আপনি কী দেশটিকে টিআইবির শীর্ষ দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্র হিসেবে ফিরে পেতে চান? ফিরে পেতে চান জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অভয়াশ্রম হিসেবে? না চান, শেষ হোক বঙ্গবন্ধু স্পেশাল ইকনোমিক জোন। যেখানে ২০ লাখ তরুণ-তরুণীর মধ্যে আপনিও একজন হবেন। শেষ হোক ১২টি এক্সপ্রেসওয়ের কাজ। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে লাগবে একবেলা। নিরবচ্ছিন্ন হোক উন্নয়নের গতি।

এবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আপনার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা দিয়ে শেষ করি- তোমাকে দিলাম, নবীন কিশোর, ইচ্ছে হয় তো অঙ্গে জড়াও/অথবা ঘৃণায় দূরে ফেলে দাও, যা খুশি তোমার

লেখক : অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

×