ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

কিংবদন্তী অভিনেত্রী রওশন জামিলের জীবন ও কর্ম

শরিফুল রোমান, মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৪:০৫, ৯ মে ২০২৫

কিংবদন্তী অভিনেত্রী রওশন জামিলের জীবন ও কর্ম

ছবি: সংগৃহীত

রওশন জামিল ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর অভিনয় এতটাই শক্তিশালী ছিল যে শৈশবে আমি তাকে খারাপ মানুষ হিসেবে ভাবতাম, কারণ তিনি পর্দায় এতটাই নিখুঁতভাবে নেতিবাচক চরিত্র ফুটিয়ে তুলতেন যে কোমল মনেও দাগ কেটে যেত। নৃত্যশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও, পরবর্তীতে তিনি অভিনয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় স্থান অধিকার করে নেন।

১৯৩১ সালের ৮ মে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা জেলায় তাঁর জন্ম। রওশন জামিলের পিতার নাম আব্দুল করিম। ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুল এবং পরবর্তীতে ইডেন মহিলা কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পর ওয়ারির শিল্পকলা ভবনে নৃত্য শিখতে ভর্তি হন। সেখানেই নৃত্য প্রশিক্ষক গণেশ নাথের (পরবর্তীতে গওহর জামিল) সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। ১৯৫২ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতি ১৯৫৯ সালে ‘জাগো আর্ট সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮০ সালে গওহর জামিলের মৃত্যুর পর রওশন জামিল একাই এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।

পঞ্চাশের দশকে মঞ্চনাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে রওশন জামিলের কর্মজীবন শুরু হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ নাটকে তিনি নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যখন পুরুষরাই সাধারণত মেয়েদের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। ১৯৬৫ সালে টেলিভিশনে ‘রক্ত দিয়ে লেখা’ নাটকের মাধ্যমে তার পেশাদার অভিনয় জীবন শুরু হয়। দুই বছর পর ১৯৬৭ সালে ‘আলী বাবা চল্লিশ চোর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন।

নৃত্যশিল্পী হিসেবেও রওশন জামিলের অবদান অনস্বীকার্য। তবে সময়ের সাথে সাথে তিনি নৃত্যের চেয়ে অভিনয়ে বেশি মনোযোগ দেন এবং একজন শক্তিশালী চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

রওশন জামিল প্রায় ২'শ টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো: জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), সূর্য সংগ্রাম, ওরা ১১ জন (১৯৭২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), নয়নমনি (১৯৭৬)

গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), সূর্য দীঘল বাড়ী (১৯৭৯), বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯), চিত্রা নদীর পাড়ে (১৯৯৯), শ্রাবণ মেঘের দিন (২০০০), লালসালু (২০০১), ‘জীবন থেকে নেয়া’ এবং ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।

রওশন জামিল তাঁর দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে (নয়নমনি-১৯৭৬), চিত্রা নদীর পাড়ে-১৯৯৯) বাংলাদেশ ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড, তারকালোক পুরস্কার, একুশে পদক (নৃত্যকলায় ১৯৯৫)।

রওশন জামিলের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল। স্বামী গওহর জামিলের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল এবং তাঁদের হাত ধরেই ‘জাগো আর্ট সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠা হয়, যা আজও শিল্পচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

১৪ মে, ২০০২ সালে ৭১ বছর বয়সে ঢাকায় এই কিংবদন্তী অভিনেত্রীর প্রয়াণ ঘটে। তবে তাঁর অনবদ্য অভিনয় এবং শিল্পকলার প্রতি dedication তাঁকে আজও দর্শকদের হৃদয়ে অমর করে রেখেছে। রওশন জামিল কেবল একজন অভিনেত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক অনুপ্রেরণা।

মিরাজ খান

×