
ছবি: সংগৃহীত
সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো শিক্ষাকেন্দ্র নয়। তারা উঠে এসেছে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানের তালিকায়। সাশ্রয়ী টিউশন ফি, ইংরেজি ভাষাভিত্তিক শিক্ষা, একাডেমিক কাঠামো এবং নিরাপদ ক্যাম্পাস—এসব গুণেই বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করছে এই ছোট্ট দেশটি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বা এমআইটির মতো অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ?
২০২২ সালে যখন চেক প্রজাতন্ত্রের শিক্ষার্থী মার্টিন রুজিচকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করেন, তখন তাঁর রাডারে এশিয়া ছিলই না। তিনি ভর্তি হয়েছিলেন লন্ডনের বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে (UCL)। কিন্তু সেখানে অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা—রাস্তায় মাদক বিক্রেতাদের হয়রানি, স্কুল হোস্টেলের কাছেই অনিরাপত্তা তাকে বাধ্য করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তন করতে। তিনি পাড়ি জমান সিঙ্গাপুরের Nanyang Technological University (NTU)-তে, যেখানে তিনি এখন ব্যবসায় প্রশাসনের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন।
তিনি বলেন, “লন্ডনের তুলনায় সিঙ্গাপুর অনেক বেশি পরিষ্কার, প্রযুক্তিনির্ভর ও নিরাপদ। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে মাদক কিংবা নিষিদ্ধ দ্রব্য নেই, যা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
মার্টিনের মতই অনেক শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে র্যাঙ্কিং একটি বড় বিষয়। ২০২৬ সালের QS World University Rankings অনুযায়ী, NUS রয়েছে বিশ্বের ৮ম স্থানে এবং NTU রয়েছে ১২তম। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয় হারিয়ে দিয়েছে এমনকি UPenn, Cornell, এমনকি Peking University-কেও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ের মূল সূচকগুলো যেমন—শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত, বৈশ্বিক একাডেমিক খ্যাতি, নিয়োগদাতাদের দৃষ্টিকোণ এবং গবেষণা কার্যক্রম—এসব ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানগুলো।
ভিয়েতনামের শিক্ষার্থী এনগুয়েন কি মিন, যিনি এখন NUS-এ গ্লোবাল স্টাডিজ ও কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ছেন, বলেন, “আমাদের দেশে সবাই NUS-কে চেনে। এখানকার ডিগ্রি মানেই চাকরিতে সুবিধা।”
ইন্দোনেশিয়ার ইয়ানাতা সুলায়মান, যিনি Singapore University of Social Sciences (SUSS) থেকে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন, বলেন, “আমি দুইটি বিষয়ের উপর বিশেষায়িত হতে পেরেছি মাত্র এক বছরে। এখানকার আন্তর্জাতিক পরিবেশ এবং সাংস্কৃতিক মিল আমাকে অনেক স্বস্তি দিয়েছে।”
পশ্চিমা দেশগুলোতে অভিবাসন কঠোর হওয়া, অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী এখন বিকল্প খুঁজছেন। অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য কোটা চালুর পরিকল্পনা, যুক্তরাজ্যে বাজেট সংকট এবং যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা ও অভিবাসন জটিলতা অনেক শিক্ষার্থীকে নিরুৎসাহিত করেছে।
১৮ বছর বয়সী সিঙ্গাপুরিয়ান শিক্ষার্থী অঞ্জনেয় শর্মা বলেন, “হার্ভার্ড বা MIT-এ আবেদন করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু এখন আমি এগুলো বাদ দিচ্ছি। পরিস্থিতি খুবই অরাজক।”
তবে সবকিছুতেই সিঙ্গাপুর এগিয়ে গেছে, তা নয়। হার্ভার্ডে পড়া একজন সিঙ্গাপুরীয় ছাত্র (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “যারা গবেষণা করছে বা কোনো নির্দিষ্ট ল্যাবের সাথে যুক্ত, তাদের জন্য স্থানান্তর সহজ নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে NUS বা NTU ভালো বিকল্প হতে পারে।”
১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গো চোক টং ঘোষণা দেন সিঙ্গাপুর হবে "Boston of the East"। ২০০০ সালের পর সরকার "Global Schoolhouse" নীতিমালা চালু করে, যার ফলে সিঙ্গাপুর হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক শিক্ষার কেন্দ্র। আজ সেই স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নই দেখা যাচ্ছে র্যাঙ্কিংয়ে।
বর্তমানে QS-এর তথ্য মতে:
- NUS – বিশ্বে ৮ম
- NTU – ১২তম
- SMU – ৫১১তম (উন্নতি: আগে ছিল ৫৮৫তম)
- SUTD – ৫১৯তম (পিছিয়েছে: আগে ছিল ৪৪০তম)
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, র্যাঙ্কিং অনেক সময় বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত করে না। NIE-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর জেসন টান বলেন, “Shanghai র্যাঙ্কিংয়ে শিক্ষার মান নির্ধারণ হয় Nobel জয়ী শিক্ষক দিয়ে, কিন্তু তা কি সত্যিই শ্রেণিকক্ষে শেখার মান বুঝিয়ে দেয়?”
তার মতে, র্যাঙ্কিং সূচকগুলো মূলত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উপযোগী, যাদের গবেষণা ও পিআর শক্তিশালী।
QS-এর সিইও জেসিকা টার্নার জানান, “সিঙ্গাপুর তার সীমিত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক গুণমানের প্রতীক বানাতে পেরেছে। বিশ্বের আর কোনো দেশ বলতে পারে না যে তাদের অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ ২০-এ।”
QS এখন শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং পরিবেশ-সচেতনতা মূল্যায়নের মতো বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ র্যাঙ্কিংয়ের গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়তো শতাব্দী প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের মতো নয়, কিন্তু বর্তমানে তারা যা প্রস্তাব করছে—তা আধুনিক, সাশ্রয়ী এবং ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রিক। তারা এখন আর “বিকল্প” নয়, বরং অনেকের কাছে প্রথম পছন্দ।
মুমু ২