ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

সদাচার ইসলামের সৌন্দর্য

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:২৯, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

সদাচার ইসলামের সৌন্দর্য

প্রসঙ্গ ইসলাম

সদাচার মানুষের একটি মহৎ গুণ। এটি মানুষের অন্তর জয়ে সাহায্য করে থাকে। সদাচরণ ইসলামের সৌন্দর্য। মানুষের সদাচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বড় পাওনাদার হলেন আপন পিতা-মাতা। এরপর স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসহ নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজন, এমনকি আল্লাহ তায়ালার সব সৃষ্টিই সদাচরণ পাওয়ার দাবিদার। পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের আচরণ এবং সন্তানের সঙ্গে পিতা-মাতার আচরণ, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আচরণ, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, অধীন চাকর-চাকরানী, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে আচার-আচরণের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত ইতিবাচক। ইসলাম মানুষের সঙ্গে ব্যবহার কেমন হবে তা সুস্পষ্ট করে দিয়েছে।

মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণের তাগিদ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, তাদের একজন অথবা উভয়ে বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের প্রতি বিরক্তিসূচক উহ্ শব্দটিও বলো না।’ সুরা বনি ইসরাইল : ২৩। সদাচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বড় হকদার হলেন আপন বাবা-মা, এরপর স্বামী-স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়রা। এ ছাড়া আল্লাহতায়ালার সব সৃষ্টিই সদাচরণ পাওয়ার দাবিদার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং কাউকে তার সঙ্গে শরিক করো না। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদাচরণ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক-অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ সুরা নিসা : ৩৬।
সন্তানের জন্য তার পিতা-মাতার খেদমতের সুযোগ পাওয়া বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। সহজে জান্নাত প্রাপ্তির উপায়। পিতা-মাতার জন্য দোয়া করার ভাষাও আল্লাহ তায়ালা শিখিয়ে দিয়েছেন এবং সেখানে শৈশবে পিতা-মাতা সন্তানকে যে স্নেহ-যতœ ও আদর দিয়ে লালন-পালন করেছেন, সেটা স্মরণ করেই আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করতে বলেছেন। পরওয়ারদিগার বলেন : ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানী সাগিরা।’
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়।’ বলতে কষ্ট হলেও সত্য যে, চলমান সমাজে প্রবীণরা বড় অসহায় ও অবহেলার পাত্র। যার প্রেক্ষিতে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা সমাজে চালু হয়েছে। একজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তার আত্মীয়-পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাবে এটাই স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রম আচরণ যে কতটা কষ্টের তা বলে বুঝানো মুশকিল। আমাদের সবার উচিত- যারা প্রবীণ, আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ তারা যেন যথাযথ সম্মান পান। আমাদের বুঝতে হবে- যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না। সেই সঙ্গে যারা কনিষ্ঠ তারাও যেন অভিভাবকদের স্নেহ, মায়া-মমতা ও আদর-যতœ থেকে বঞ্চিত না হয়। 
পিতা-মাতা ছাড়াও সব মানুষের সঙ্গে সদাচরণের বিষয়ে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। মনে রাখতে হবে, ইসলাম মনে করে, শুধু মানুষ নয়- সব সৃষ্টিই ভালো আচরণ পাওয়ার দাবি রাখে। অপ্রয়োজনে গাছের একটি পাতা ছেঁড়াও পছন্দনীয় নয় ইসলামে। মহানবী (সা.) বলেছেন, তুমি খেলা করে যে পাতা ছিড়ছো, জানো- সে পাতা আল্লাহর জিকির করে...।’ ইসলাম ভারবাহী পশুকে অতিরিক্ত বোঝা দেওয়া অপরাধ বলে গণ্য করেছে। কোনো পশু-পাখিকে আটকে রেখে ক্ষুধায় কষ্ট দেওয়া মারাত্মক গোনাহের কাজ।

দেখুন, পশু-পাখির সঙ্গে আচরণ যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে সৃষ্টির সেরা ও আল্লাহর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কেমন আচরণ ইসলাম দাবি করতে পারে- তা সহজেই অনুমেয়। মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার স্বয়ং আল্লাহর সঙ্গেই দুর্ব্যবহার। এ বিষয়ে আল্লাহর নবী (সা.) বলেন, ‘ইরহাম মান ফিল আরদ ইরহামকুম মানফিস সামা- ভূপৃষ্ঠে যারা রয়েছে তাদের সঙ্গে সদাচরণ কর তাহলে আসমানে যিনি রয়েছেন তিনিও তোমাদের সঙ্গে সদাচরণ করবেন।’

সামাজিক জীবনে মানুষ পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাই সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় সহানুভূতি এবং সদাচারের গুরুত্ব অপরিসীম। সদাচরণের মাধ্যমে শত্রুকেও বন্ধু বানানো যায়। এটি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মহৎ গুণ। এই মহৎ গুণের মাধ্যমে জাহেলি যুগের অন্ধকার সমাজকে তিনি আলোকিত করেছেন। যার চরিত্রের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ সুরা কালাম : ৪। সদাচারের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হলো মানুষের হিংসা-বিদ্বেষ ও গর্ব-অহংকারের মনোভাব। মানব চরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ মারাত্মক ক্ষতিকর।

ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে অত্যন্ত বিষাদময় করে তোলে। এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের স্থলে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে বলেছেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সেজন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?’ সুরা আন নিসা : ৫৪। 
একটি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনে বহু মানুষ একত্রে কাজ করেন। কেউ থাকেন প্রধান আর কেউ থাকেন অধীন। কেউ মালিক, কেউ কর্মচারী। উভয় প্রকার মানুষের সঙ্গে সুন্দর ও সম্মানজনক ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায়, অধীনস্থ লোকদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকেন অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক। অফিসের কর্মচারী কিংবা বাসার কাজের লোক- প্রায় সবার প্রতিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে করা হয় দুর্ব্যবহার। বিশেষ করে শিশু শ্রমিকদের প্রতি ।
অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর হাতে উত্তপ্ত খুন্তি দিয়ে শরীরে সেঁকা দেওয়ার ঘটনাও প্রকাশিত হয় পত্রিকার পাতায়। এমনকি নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মেরে ফেলার মতো রেকর্ডও শোনা যায় কোথাও কোথাও। অথচ রাসুল (সা.)-এর আদর্শ হলো, কাজের লোকদের সঙ্গে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ ও মানবিক আচরণ করা। তারা বড় ধরনের কোনো ভুল করে বসলে মমতার সঙ্গে সতর্ক করে শুধরে দিতে হবে আর ছোট ভুল প্রকাশ পেলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে।

বিখ্যাত সাহাবি হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) দীর্ঘ ১০ বছর রাসুল (সা.)-এর ঘরের ও বাইরের নানা কাজ করেছেন। তার সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর আচরণ কেমন ছিল সে বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মদিনায় ১০ বছর রাসুল (সা.)-এর খেদমত করেছি। আমি ছিলাম অল্পবয়স্ক বালক। আমার সব কাজ রাসুলের মর্জিমাফিক হতো না। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় তিনি কখনো আমাকে ধমক দেননি এবং বলেননি যে, এটা কেন করেছ বা এটা কেন করোনি?’-  (আবু দাউদ : ৪৭৭৪)।
আসুন, আমরা মানুষের প্রতি, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়াদ্র হই। তাহলে আল্লাহর গোটা সৃষ্টিই আমার প্রতি দয়াদ্র হবে আর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুসংবাদ মতো আল্লাহ তায়ালা আমাদের ভালো বাসবেন। 
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব

×