ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশ দূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২১:১২, ৫ জুন ২০২৩

পরিবেশ দূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

মানুষের বেঁচে থাকার উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু

মানুষের বেঁচে থাকার উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু। মানবসৃষ্ট বহুবিধ কারণে বাতাস তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বায়ুম-লের মধ্যে অনিষ্টকর পদার্থের সমাবেশ যখন মানুষ ও তার পরিবেশকে ক্ষতি করে, তখন তাকে বায়ুদূষণ বলে। অন্যান্য দূষণের চেয়ে বায়ুদূষণের পরিধি এবং ব্যাপকতা অনেক বেশি। কারণ, বাতাস স্বল্প সময় দূষিত পদার্থকে ছড়িয়ে দিতে পারে। জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক এই বায়ুদূষণ মানুষ এবং অন্যান্য জীবের জন্য এখন হুমকি স্বরূপ। দূষিত বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসই নয়, সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইডগুলোর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় কাশি, দম বন্ধ, দীর্ঘস্থায়ী হাঁপানি, ফুসফুসে পানি জমে রোগীর মৃত্যুও হয়।

এর প্রভাবে পুরুষের শুক্রাণু এবং মেয়েদের ডিম্বাণু তৈরি কল্পনাতীতভাবে কমে যায় কিংবা দুর্বল হয়। ফলে অসম গর্ভপাত ঘটে কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়। বাংলাদেশে যত অকালমৃত্যু হয়, তার ২০ শতাংশ ঘটে বায়ুদূষণের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। পরিবেশ দূষণের এক ভয়াবহ দিক হচ্ছে বায়ুদূষণ, যা মানুষের প্রজনন ক্ষমতাসহ সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। বিশ্বের দূষিত বায়ুর শীর্ষ ১০টি শহরের ৯টি দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত। ঢাকা শহর এর মধ্যে অন্যতম। 
দেশের মাটি, পানি এবং বায়ুদূষণ স্থায়ী পরিবেশগত সমস্যায় পতিত হচ্ছে দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে।

টেক্সটাইল, মাইনিং, ট্যানারি, মেটাল প্যাটিং, সার ও কৃষি শিল্প, ব্যাটারি, কীটনাশক, আকরিক শোধনাগার, পেট্রোকেমিক্যালস, কাগজ উৎপাদন, ইটভাটি, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো বর্জ্য পদার্থ যেখানে সেখানে ফেলানো বায়ু ও পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। পরিবেশ দূষণের আরেকটি ভয়াবহ দিক হচ্ছে ওজোন স্তরের ক্ষয়। এর আল্ট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন বা অতিবেগুনী তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রভাবে ত্বকের ক্যান্সার ও চোখের বড় রকমের ক্ষতি হয়। বায়ুদূষণের ফলে গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া বা সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পড়ে পুরো প্রাণিজগতের ওপর। বায়ুদূষণের কারণে খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে উদ্ভিদ নিজেও বিপদে পড়ে এবং উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীরাও পড়ে বিপদে।

বর্তমানে ঢাকার বাতাসে সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও কার্বন-মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড এবং সীসাও রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত, যা মারাত্মক ক্ষতি করছে মানবদেহের। গবেষণায় দেখা যায় যে, বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। বাতাস আমাদের জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের ফুসফুসের জন্য প্রয়োজন দুই হাজার লিটার নির্মল বাতাস। এক মিনিটও নিশ্বাস বন্ধ করে বেঁচে থাকা দুরূহ। অথচ সেই বাতাস কতইনা দূষিত ও বিষাক্তÑ যা চোখে দেখা যায় না। 
সম্প্রতি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার (ক্ষুদ্র ধূলিকণা পিএম-২.৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে খারাপ। মাত্রার মধ্যে আছে মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’-এর ২০২১ সালের গবেষণায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকার শীর্ষস্থানে আছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে পিএম-২.৫-এর মাত্রা উপস্থিতি বিবেচনায় ৮৩ দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম নিয়ে দূষিত রাজধানীর তালিকায় (২০২০ সালে) ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়, ২০২১ সালে এ মাত্রা ছিল ৭৬ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম এবং ২০২২ সালে অবস্থান পঞ্চম (৬৫ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম)।

এক্ষেত্রে শীর্ষে থাকা নয়াদিল্লির স্কোর ৯৮ দশমিক ৩। বিশ্বের সবচেয়ে পরিষ্কার বায়ু ক্যানবেরায়-২ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম। ক্ষুদ্র ধূলিকণা বলতে আকারে চুলের প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগের সমান, যা সহজেই মানুষের চোখ-নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে রক্তের সঙ্গে মিশে যায় এবং ফুসফুস, হার্ট, কিডনি লিভার আক্রান্ত করে ফেলে। এই প্রবন্ধ লেখার সময় (৩ জুন ৮:০০ রাত্র) ঢাকার রিয়েল-টাইম এয়ার কোয়ালিটি (অরৎ ছঁধষরঃু ওহফবী- অছও) ১৮৩, যা খুবই খারাপ বা আনহেলদি বোঝায়।
একিউআই সারাবিশ্বের বায়ুর গুণাগুণ পরিমাপের মানদণ্ড। মূলত বায়ুতে বিদ্যমান বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা বিবেচনা করে এর মান নির্ণয় করা হয়। মানগুলো হলোÑ ১) ০-৫০ হলে স্বাস্থের জন্য ভালো, এর সাংকেতিক রং সবুজ, ২) ৫১ -১০০ হলে সহনীয় মাত্রা, সাঙ্কেতিক রং হলুদ, ৩) ১০১ - ১৫০ হলে কিছু শ্রেণির লোকের জন্য অস্বাস্থ্যকর, সাঙ্কেতিক রং কমলা, ৪) ১৫১-২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, সাঙ্কেতিক রং লাল,  ৫) ২০১-৩০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, সাংকেতিক রং বেগনী, ৬) ৩০১-৫০০ বিপদজনক/ঝুঁকিপূর্ণ, সাঙ্কেতিক রং গাঢ় লাল। ক্যাপসের অনুসন্ধানে শিল্পাঞ্চল গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি ২৬৩.৫১ মাইক্রোগ্রাম, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে যথাক্রমে ২৫২.৯৩ এবং ২২২.৪৫ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে।

ভয়াবহ এই দূষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা, নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন ও কাজের সময় ঢেকে রাখা, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা, অবৈধ ইটভাটি বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা, প্রচুর গাছ লাগানো, ছাদ বাগানে উৎসাহিত করা,জলাধার সংরক্ষণ ইত্যাদি ব্যাপক হারে বাড়ানো দরকার। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বায়ুর গুণগত মান সঠিক রাখার জন্য প্রযুক্তিবিদরাও কাজ করে যাচ্ছেন দিনরাত। এগুলো সবুজ প্রযুক্তি বা গ্রিনটেক, এনভায়রনমেন্টাল বায়োটেকনোলজি ইত্যাদি নামে পরিচিত। এসব জৈবপ্রযুক্তি দূষিত পরিবেশের (বায়ু, পানি, ভূমি) প্রতিকারে অসম্ভব ভূমিকা রাখছে। 
পরিবেশ দূষণকারী অদৃশ্য এই সূক্ষ্ম কণার উৎস শনাক্তকরণ এবং সমাধানের জন্য জৈব মডেলিং তৈরি হচ্ছে কম্পিউটার সিমুলেশন, জিআইএস, ডাটা মাইনিং ইত্যাদি পদ্ধতিতে। এসব মডেল ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’-এর রিয়েল-টাইম ডেটার/তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে বিশাল ডেটাবেজ তৈরি করছে বিভিন্ন আবহাওয়া স্টেশন থেকে আসা প্রতি মুহূর্তের ডেটা দিয়ে। কেন্দ্রীয় সার্ভারে থাকা এই ডেটাবেজ পরবর্তীতে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী গ্রাফ ও সংখ্যা আকারে দৃশ্যমান করা হয় বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে। সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক এমন গুরুত্বপূর্ণ ফল আপলোড করা হয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। অডিও-ভিডিও ও এনিমেশন করে দেখানো হয় নানা অ্যাপস, ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায়।

গ্রাহকরা এই গ্রাফ, সংখ্যা ও ফল দেখে বুঝতে পারে যে, বাতাস কতটা সুদ্ধ কিংবা দূষিত এবং প্রতিকারের জন্য কি করণীয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের তৈরি নিজস্ব সফটওয়্যার দিয়ে এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং করে থাকে। এসব সফটওয়্যারগুলো হলো- ব্রিজো-মিটার (ইসরাইল), পালম-ল্যাব (ফ্রান্স), আইকিউএআইআর (সুইজারল্যান্ড), আকলিমা (ইউএস), এয়ার-ভিজুয়াল (চীন) ইত্যাদি। গুগল ম্যাপে সারাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গার এয়ার কোয়ালিটি দেখার সুযোগ আছে সবার জন্য। গত এক দশকে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতিতে সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর আন্তর্জাতিক কোয়ালিটি সমৃদ্ধ এ ধরনের সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, যা খুব শীঘ্রই আলোর মুখ দেখবে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি ও সিইসি’র ছাত্ররা ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত নানারকম স্মার্ট ডিজিটাল ডিভাইস তৈরি করছে। যার মাধ্যমে বাতাস, পানি ও মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, দূষণের মাত্রা ইত্যাদি তাৎক্ষণিক বোঝা যায়। এসব ডিভাইস ব্যাপক হারে উৎপাদন করতে পারলে কৃষক সমাজের উপকার হবে অবশ্যই।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×