
বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রথম কে ঘোষণা করেছেন তা নিয়ে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে একটি মামলা হয়েছিল
(গতকালের পর)
॥ দুই ॥
বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রথম কে ঘোষণা করেছেন তা নিয়ে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে একটি মামলা হয়েছিল। ‘ড. এম এ সালাম বনাম বাংলাদেশ সরকার...’-এর মামলায় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন সেখানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের উল্লেখ ছাড়াও ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে বাঙালি জাতিকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র, সংবাদপত্রে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং ঐতিহাসিকদের রচনাবলীর ওপর ভিত্তি করে।
বিচারপতি খায়রুল হক রায়ে ১৯৬৪ সালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ উল্লেখ করে লিখেছেন-
‘১৯৬৪ সনের ১২ জুলাই তারিখে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। ঐদিন পল্টন ময়দানে শেখ মুজিব একটি অসাধারণ বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তৃতার প্রারম্ভে বলেন-
‘সোনার বাংলার ভাইয়েরা আমার! স্বাধীনতার ১৭ বছর পরে আবার জনগণের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে নামতে হবে- ১৭ বছর পরে আবার ভোটের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হবে- ১৭ বছর পরে আবার রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে হবে- একথা কোনোদিন ভাবিনি। নিজ দেশে নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধেও ব্রিটিশ আমলের মতো জনগণের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে ভাবলে মন আমার শিউরে ওঠে।’
বিচারপতি খায়রুল হকের এই রায়ে বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র, সরকারি দলিলপত্র, এমনকি পাকিস্তানের যাবতীয় প্রকাশ্য ও গোপন নথিপত্রের তথ্য উদ্ধৃত করে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা প্রদান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। ২৬ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক জান্তাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান স্বাধীনতার ঘোষণার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক বলেছিলেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালেকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কখন কিভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
বিএনপি বলছে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছে। পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে বিএনপির দুঁদে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বক্তব্যের জবাব পাওয়া যাবে বিচারপতি খায়রুল হকের উক্ত রায়ে।
এতে ১৯৭৯ সালে মওদুদ আহমেদের লেখা ‘বাংলাদেশ : কন্সটিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু কখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ভালোভাবেই জানতেন পঞ্চদশ সংশোধনী নয়, ১৯৭২ সাল থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি আপিল করেনি। কারণ, বিএনপির আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানেন আপিলে গেলেও তারা এই ঐতিহাসিক সত্য নাকচ করতে পারবেন না।
॥ তিন ॥
২০০৯ সালে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক কর্তৃক প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯-এর ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জারিকৃত সামরিক আইন, ফরমান দ্বারা সংবিধানের সংশোধন অবৈধ, বাতিল ও অস্তিত্বহীন ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে জেনারেল জিয়াউর রহমান কৃত ৫ম সংশোধনী এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল অবৈধ হয়ে গেছে। উচ্চতর আদালতের এই রায়ের ভিত্তিতেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের অবৈধ রাষ্ট্রপতি হলেও সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার কারণে এই অবৈধতা আমাদের মেনে নিতে হয়েছে।
খালেদা জিয়া এবং তার সুযোগ্য পুত্র তারেক রহমান জিয়াউর রহমানকে যখন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলেন তখন তাদের এটুকু হুঁশ থাকে না- যে কেউ নিজেকে রাষ্ট্রপতি দাবি করলেই রাষ্ট্রপতি হওয়া যায় না। রাষ্ট্রপতি হতে গেলে শপথ নেওয়ার একটি বিষয় থাকে, যার বয়ান সংবিধানে লেখা আছে। সংবিধান না থাকলে এমন কোনো দলিল বা আইন থাকতে হবে কিংবা তাকে গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা মনোনীত হতে হবে।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্র্রপতি ঘোষণা করেছেন। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু ১১ জানুয়ারি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের আপৎকালীন সংবিধান আদেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রচলন করেছেন এবং সুপ্রিম কোর্ট গঠন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেছেন, বিচারপতি আবু সাইয়িদের নিকট রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। ’৭২-এর ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি আবু সাইয়িদ চৌধুরীর নিকট বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন।
বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি হিসেবে তারেকের যে আচরণ ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে এই দলের ক্ষমতায় থাকাকালে আমরা লক্ষ্য করেছি, তার যে সব ভয়ংকর অপরাধের বিবরণ সংবাদপত্রে পড়েছি, আদালতের মামলার নথিপত্র থেকে জেনেছি- তাকে মুম্বাই, মেক্সিকো সিটি বা সিসিলির মাফিয়া সর্দার ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মামলার অন্যতম আসামি হরকত-উল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নান আমার সঙ্গে সাক্ষাতকারে তারেকের সঙ্গে তাদের নেতাদের আলোচনার যে বিবরণ দিয়েছেন, তা থেকে তারেককে মাফিয়াদের মতো ঠাণ্ডা মাথার অপরাধী ও খুনি ছাড়া অন্য কিছু ভাবা সম্ভব নয়।
তারেকের বিরুদ্ধে বর্তমানে যে সব মামলা রয়েছে সেগুলো হত্যা, রাহাজানি, চোরাচালান ও চৌর্যবৃত্তি সংক্রান্ত। কখনো রাজনীতি করবেন না- এই মুচলেকা দিয়ে তারেক লন্ডনে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। লন্ডনে বসে রাজনীতি করে তারেক মুচলেকার শর্ত ভঙ্গ করে তার অপরাধের মুকুটে আরেকটি অপরাধের পালক যুক্ত করেছেন।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর দায়িত্ব গ্রহণ আইনসিদ্ধ ছিল না এই অভিযোগে ১৯৭৩ সালে দালাল আইনে গ্রেফতারকৃত দুই রাজাকার সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। ’৭৩-এর ২২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এই মামলার শুনানির পর প্রধান বিচারপতি এ এম সায়েম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয় উল্লেখ করে অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা সব সময় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অস্বীকার করেছে। কারণ, এটা মানতে গেলে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও সামরিক বাহিনী অবৈধ ও দখলদার সরকার এবং হানাদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হবে। ১৯৭২-এর ৪ জুন পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামীর দলীয় মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক এশিয়া’য় জামায়াত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য তাদের সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিল, স্বীকৃতি দেওয়া হলে ১৯৭১-এর যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল এটা মেনে নেওয়া হবে, পাকিস্তানি সৈন্যরা দখলদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হবে, বাংলাদেশ তাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের সুযোগ পাবে এবং এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির জন্য বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে।
তারেক রহমান সব সময় বিএনপির চেয়ে জামায়াতের স্বার্থ দেখেছেন। ছাত্র-শিবির যখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলকে পিটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করছিল তখন তারেক শিবিরের সম্মেলনে গিয়ে বলেছিলেন ছাত্র শিবির ও ছাত্রদল একই মায়ের সন্তান অর্থাৎ সহোদর ভ্রাতা। এতকাল আমরা বলেছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলে জামায়াত বাংলাদেশকে পাকিস্তানে রূপান্তরিত করতে চায়। ‘রতœগর্ভা’ খালেদা জিয়া এবং তার ‘সুপুত্র’ তারেক সংবিধানের মতো ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রমাণ করেছেন বিএনপি কিভাবে জামায়াতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
‘জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি’, বঙ্গবন্ধু ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’- এসব বলার কারণে গণমাধ্যমে তখন তারেককে নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। সংসদে না গিয়েও বিএনপির এই নেতা তার বক্তব্যের কারণে জাতীয় সংসদের ধারাবিবরণীতে স্থান করে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন মন্ত্রী তারেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করার কথা বলেছেন। তারেক এটাই চেয়েছিলেন। খুন, চুরি, রাহাজানির মামলার আসামি হয়ে দেশের বাইরে থাকা যে সম্মানজনক নয়, এ কথা লন্ডনে থেকে তারেক হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অস্বীকার এবং জাতির পিতা সম্পর্কে কদর্য বাক্য উচ্চারণ করে তারেক রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছেন বটে, তবে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হলে ইংল্যান্ডে বা কানাডায় তার জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অপরাধী হিসেবে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য, সাধারণ নিকৃষ্ট অপরাধীর তিলক মুছে রাজনৈতিক অপরাধের মুকুট পরার জন্য তারেক মরিয়া হয়ে উঠেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করলেও তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা কোনোক্রমেই উচিত হবে না। উচিত হবে মুচলেকার শর্ত ভঙ্গের জন্য বিচার করা এবং বিচারাধীন মামলায় হাজিরার জন্য তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা।
॥ চার ॥
বিএনপির জাঁদরেল আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা ‘স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে’র তাৎপর্য ও গুরুত্ব বোঝেন না-এমনটি ভাববার কোনো কারণ নেই। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক, প্রথম রাষ্ট্রপতি, ’৭১-এ গণহত্যা হয়নি- এসব বলার অর্থ হচ্ছে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অস্বীকার করা। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকার করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রূপান্তরিত হবে পাকিস্তানের দুই অংশের ‘ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধে’, যা পাকিস্তানি ঐতিহাসিক, রাজনীতিবিদ ও সমরনায়করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সবসময় বোঝাতে চাইছেন। এটি আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এখতিয়ার বা বৈধতা শুধু চ্যালেঞ্জ করবে না, বাংলাদেশকে ‘আইনিভাবে’ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করবে।
‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গত পনেরো বছর ধরে ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’র বার্ষিকী পালন করছে। ১৭ এপ্রিল ‘মুজিবনগর দিবস’ পালনের চেয়ে ঐতিহাসিকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস’ পালন। ১৭ এপ্রিল আমরা নিশ্চয় কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে গিয়ে সাড়ম্বরে ‘মুজিবনগর দিবস’ পালন করব। তার অর্থ এই নয় যে, আমরা ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের দিনটি ভুলে যাব, যে ঘোষণাপত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক আইনে মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ কারণে আমাদের দাবি হচ্ছে ১০ এপ্রিলকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করা।
বিএনপি-জামায়াতের বাংলাদেশবিরোধী ও রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ড দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ দিবস অথবা ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ পালন করতে হবে। একই সঙ্গে বলতে হবে যারা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অস্বীকার করবে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের অযোগ্য। সময় হয়েছে ইউরোপের মতো আইন প্রণয়নের। হলোকাস্ট অস্বীকার করা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
’৭১-এর গণহত্যা অস্বীকার কিংবা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকার শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করে নতুন আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে গয়েশ্বর রায়রা কখনো ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আইসিটিতে আমাদের বিচার করবে, যেমনটি এর আগে ঘোষণা করেছে বিএনপির সহোদর ভ্রাতা জামায়াতে ইসলামী।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর খালেদা জিয়া যখন ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে ঠাট্টা করলেন, এর তিন দিন পরই (২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫) আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলাম-
‘মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস ও গণহত্যা অস্বীকার করে বিএনপির চেয়ারপারসন ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি যে বক্তব্য প্রদান করেছেন, এটিকে হাল্কাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আল-কায়েদা ও আইএস দাবি করেছে বাংলাদেশে তাদের সমর্থক রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্যে নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের আইএসআই এবং আল-কায়েদা ও আইএসের মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সন্ত্রাসী সংগঠন অনুপ্রাণিত হবে।
‘পাকিস্তান কিভাবে বাংলাদেশে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাস রফতানি করছে, কিভাবে তারা বাংলাদেশী জঙ্গি সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছে, এ বিষয়ে আমরা গত দুই দশকেরও অধিককাল ধারাবাহিকভাবে বলছি। বাংলাদেশের প্রধান জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠন হরকাত-উল জিহাদের জন্ম হয়েছে ১৯৯২-এর এপ্রিলে বেগম খালেদা জিয়ার শাসনকালে, পাকিস্তানের আইএসআই ও জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতের জমানায় আমরা শতাধিক জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকা- শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করেছি।
বাংলাদেশের অস্তিত্ববিনাশী এসব তৎপরতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকরণের যাবতীয় উদ্যোগ প্রতিহত করার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন এবং অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিকল্প কোনো পথ নেই। সংবাদ সম্মেলনে আমরা নির্দিষ্টভাবে দাবি করেছি-
১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যে দেশপ্রেম থেকে সংবিধানে রাষ্ট্রের ৪ মূলনীতি পুনঃস্থাপন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছে, এর ধারাবাহিকতায় অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার অপরাধ আইন প্রণয়ন করতে হবে।
২. ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অবিলম্বে দল ও বাহিনী হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুজাহিদ বাহিনীসহ যেসব পাকিস্তানি সামরিক-অসামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এসব অপরাধের প্রমাণ রয়েছে, তাদের বিচার দ্রুত করতে হবে।
৩. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ-িত গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও ভুক্তভোগীদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে।
৪. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি যেভাবে হলোকাস্ট ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সেভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য পাকিস্তানের ওপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
৫. বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা বৃদ্ধি করে আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ করেছে। এর ধারাবাহিকতায় বিদেশে অবস্থানরত ’৭১-এর যে সব যুদ্ধশিশু বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণে আগ্রহী, তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
৬. বঙ্গবন্ধুর সরকার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবারের সদস্যদের বাসস্থান ও ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ’৭১-এর গণহত্যাকারী এবং তাদের সহযোগীরা ক্ষমতায় এসে বহু শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বাড়ি থেকে উৎখাত করেছে। যারা শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছিত করেছে, তাদের বিচার ও শাস্তির আওতায় এনে গণহত্যার ভিকটিমদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৭. ’৭১-এর গণহত্যার ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং গণহত্যার ভিকটিমদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাবার উদ্দেশ্যে ‘২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার জন্য আমরা সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছি।
এরপর আমরা আইনমন্ত্রী ও আইন কমিশনকে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন প্রণয়নের জন্য স্মারকপত্র প্রদান করেছি। আমাদের অনুরোধে আইন কমিশন ছ’মাসের ভেতর প্রস্তাবিত আইনের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে। আমরা জানি না এই খসড়াটি কী কারণে হিমঘরে পড়ে আছে।
তবে এটুকু নিশ্চিতভাবেই জানি, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃতকারীদের শাস্তি প্রদানে রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয় ভবিষ্যতে জামায়াত-বিএনপির মিথ্যাচারই নতুন প্রজন্ম সত্য হিসেবে জানবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা সংরক্ষণ করতে হলে অবিলম্বে আইন কমিশন কর্তৃক প্রণীত এতদসংক্রান্ত আইন দ্রুত অনুমোদন ও কার্যকর করতে হবে। (সমাপ্ত)