ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ঝুঁকি কম

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:৩১, ৩০ মার্চ ২০২৩

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ঝুঁকি কম

কোভিড-১৯-এর অভিঘাতে ২০১৯ সালের শেষ সময় হতেই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা

কোভিড-১৯-এর অভিঘাতে ২০১৯ সালের শেষ সময় হতেই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করেছিল। বৈশ্বিক মহামারির এ ধাক্কা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। মহামারি কারণে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হওয়া  দেশের বড় উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কা। মহামারিতে শ্রীলঙ্কার পর্যটন নির্ভর অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দেশটি  দেউলিয়া হয়ে গেছে।  কোভিড-১৯ এর প্রকোপ হ্রাস পাবার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল।

কিন্তু আশার সুবাতাস বয়ে যাবার শুরুতে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন সমস্যা দেখা দেয়Ñ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে। দেশে দেশে তৈরি হয়েছে রিজার্ভ সংকট। এখন  পুরো বিশ্বব্যাপী মাত্রাতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি একটি বাস্তবতা। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে প্রান্তিক মানুষকে তাই যথেষ্ট ভুগতে হচ্ছে। যাইহোক,  বৈশ্বিক সার্বিক এই টালমাটাল অর্থনৈতিক সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং খাতের ব্যর্থতা।

বিভিন্ন দেশে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে কিংবা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আর এসব ঘটনার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো খুব সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়াত্বের শিকার হওয়া। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক, সিগনেচার ব্যাংক ও সিলভার গেট ব্যাংক দেউলিয়া হয়েছে আর অন্যদিকে ফাস্ট রিপাবলিক ব্যাংক  বড় রকমের পতনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে করে মার্কিন জনগণের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় দুই শত মার্কিন ব্যাংক পতনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ব্যাপারটি এতোটাই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যাতে করে মার্কিন সরকারের আর্থিক ব্যাপারগুলোর ব্যবস্থাপনায় যে এজেন্সিগুলো রয়েছে তারা হস্তক্ষেপ করছে। এ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও কথা বলতে দেখা গেছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাতে যে একটা বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা সহজেই অনুধাবনযোগ্য। এ অস্থিরতা ইউরোপের ব্যাংকগুলোয়ও ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু মার্কিন ব্যাংকগুলোর এ সংকট কেন তৈরি হলো? আসুন আমরা কারণগুলো একে একে দেখার চেষ্টা করি।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং দেউলিয়া হওয়ার প্রধান যে কারণগুলোর একটি হলো নীতি সুদহার বা রেপো রেট বৃদ্ধি। নীতি সুদহারের হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেপরোয়াভাবে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো বড় রকমের তহবিল সংকটে পড়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (বিটকয়েনসহ ডিজিটাল মুদ্রা) যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে।

ক্রিপটোকারেন্সি হলো এক ধরনের ডিজিটাল মুদ্রা যার বিপরীতে কোনো অ্যাসেট থাকে না। ফলে এ ধরনের মুদ্রায় বিনিয়োগ অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ একটি নির্দিষ্ট খাতে পুঞ্জীভূত। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো  স্টার্টআপের মতো ছোট উদ্যোগ ও গৃহায়ণ খাতে  বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছিল। বিনিয়োগে বৈচিত্র্য না থাকাটা অবশ্যই বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর  যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ঋণ বিতরণ তো আছেই। অনেকে বলছেন, ২০০৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতে এটি একটি বড় ঘটনা। এসভিবি ব্যাংকটির এক দিনেই শেয়ারপতন ঘটে ৬০ শতাংশ। এতে আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। আমানতকারীরা এক দিনেই ব্যাংক থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলার তুলে নেয়।
এখন প্রশ্ন হলো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর মতো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোও কি পতনের ঝুঁকিতে আছে কি না। ২০২২ সালের হিসাব মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ছিল প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা আমাদের জিডিপির প্রায় ৬০ গুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন অর্থনীতির যেকোনো বিপর্যয়ে বিশ্ব অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুতরাং বর্তমান এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়েও ভাবনাচিন্তা করাটা অমূলক নয়। তবে আমরা একটু বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো যে কারণে পতনের সম্মুখীন হলো সেই সংকট আমাদের ব্যাংকিং খাতে আছে কিনা।
আমরা আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি টেনে ধরতে গিয়ে বেপরোয়াভাবে নীতি সুদহার বাড়িয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এভাবে নীতি সুদহার বাড়ায়নি। সুতরাং এটি বাংলাদেশের মুদ্রানীতির একটি ইতিবাচক দিক।  বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তাই বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের সুযোগও নেই। ক্রিপ্টোকারেন্সির বিপরীতে অ্যাসেট না থাকায় এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ যা থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত মুক্ত।

আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের বিনিয়োগ কোনো নির্দিষ্ট খাতে পুঞ্জীভূত নয়। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ একতরফা না হওয়ায় বড় ক্ষতি থেকে মুক্ত। আবার বাংলাদেশের ইনফর্মাল ইকোনমি যথেষ্ট শক্তিশালী। বাংলাদেশের ইনফর্মাল ইকোনোমি  জিডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যা ব্যাংকির খাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং বৈশ্বিক ব্যাংক পতনের প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব একটা প্রভাব নয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ ব্যাংকগুলো শক্তিশালী ও স্থিতিশীল থাকায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির লেনদেনে কোনো ঝুঁকি তৈরি হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র তথা বৈশ্বিক ব্যাংকগুলোর যে সংকট তৈরি হয়েছে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও দেশের ব্যাংকিং নীতি বিবেচনায় সে রকমের কোনো সংকট বাংলাদেশের ৬১টি শিডিউল ব্যাংকের জন্য নেই। আমাদের ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্বক্ষণিক নজরদারি বজায় রাখছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক ব্যাংক পতনের প্রভাব নিয়ে জনসাধারণের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

তবে মনে রাখতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র তথা বৈশ্বিক ব্যাংক পতনে গুজবেরও একটা বড় প্রভাব ছিল। গুজব আর্থিক খাত ধ্বংসের অন্যতম হাতিয়ার।  গ্রাহকদের আস্থা একবার চলে গেলে বৃহৎ ব্যাংক হলেও তার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাড়ায়। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক সময়ে। গত বছরের শেষ সময়ে দেশের ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংকে ভয়াবহ অর্থ লোপাটের তথ্য প্রকাশ পায় দেশের কয়েকটি গণমাধ্যম। গুজবের ডালপালাও সেই সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ে।

ফলে  গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক  সৃষ্টি হয় এবং গ্রাহকরা তাদের আমানত তুলে নেয়া শুরু করে। ফলে দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা দেখা দেয়। যাইহোক, পরে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়েছে। তাই জনগণের উচিত স্বার্থান্বেষী মহলের গুজবে কর্ণপাত না করে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রতি আস্থা রাখা।
বাংলাদেশ শেখ হাসিনার গত এক যুগের শাসনামলে এগিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে। বেশকিছু সামাজিক সূচকের পাশাপাশি অর্থনীতির সূচকেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। এমডিজি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে, এসডিজি বাস্তবায়নের পথে। মাত্র এক যুগ আগেও যে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় দ্বিগুণ ছিল, তারাও পেছনে পড়ে যাচ্ছে। একসময়ের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আজ বিশ্ব দরবারে উদীয়মান অর্থনীতির রোল মডেল যার নেতৃত্বে, কৃতিত্ব তো সেই ‘ক্যারিশমাটিক’ নেত্রী শেখ হাসিনাকে দিতে হবেই।

বাংলাদেশের জনগণ তার ওপরে আস্থা রেখে তাকে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। আগামী ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  বাংলাদেশের জনগণ একই রকমভাবে তার উপরে বিশ্বাস রাখবে কারণ এই মুহূর্তে আমাদের সকলের মাথায় যে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত সেটি হচ্ছে- বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার বিকল্প এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ যেমন সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঠিক তেমনিভাবে শেখ হাসিনা বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নের আরেক নাম হয়ে উঠেছেন। ফলে, তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি এবং উন্নয়ন ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছেন। 

সরকারের নানামুখী ইতিবাচক উদ্যোগের ফলে দেশে রপ্তানি আয় বেড়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রবাসী আয়ও। পাশাপাশি বিলাসী-পণ্য আমদানি বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে ডলার সংকট। মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। দেশের অর্থনীতি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে আছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য আমাদের মনোযোগ দিতে হবে বেশি মাত্রায় অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব ফিরিয়ে আনতে। এজন্য দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রপ্তানি ও রেমিটেন্সে আরও ভালো করার সুযোগ রয়েছে।

রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে তৈরি পোশাকের মতো সম্ভাবনাময় খাতে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার পরামর্শ তাদের। গতিশীলতা ধরে রেখেছে দেশের রপ্তানি খাত। অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থা সামাল দিতে রেমিটেন্স প্রবাহ আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।


লেখক :  অধ্যাপক, ট্রেজারার
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

×