ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেকেন্ড ক্যাপিটাল থেকে ‘আগারজায়া’

​​​​​​​অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ১৮ মার্চ ২০২৩

সেকেন্ড ক্যাপিটাল থেকে ‘আগারজায়া’

.

এক সময় ঢাকায় বৃহত্তম বস্তি ছিল যে এলাকাটি আজ নানা কারণে আমাদের অনেকেরই সেখানে নিত্য যাতায়াত। কারণটাও খুব স্বাভাবিক। হালের যত নতুন নতুন সরকারি অফিস তার সবই ইদানীংকার ঠিকানা ঢাকার এই আগারগাঁও এলাকাটি। আপনি যদি বাংলাদেশের একজন সম্মানিত নাগরিক হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে এই এলাকায় কোনো না কোনো কারণে যেতেই হবে; তা সে পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে এনআইডি সংক্রান্ত যে  কোনো কাজেই হোক না কেন। এই যেমন দিন আগেই আমাকে সেখানে যেতে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রিসার্চ গ্র্যান্টের অ্যাপলিকেশন পর্যালোচনা সংক্রান্ত কাজে।

আবার গত সপ্তাহে বাংলাদেশ বেতারে স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতেও এই আগারগাঁওয়েই যেতে হয়েছে। আমি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের একজন ফেলো। একাডেমির নানা কাজে প্রায়ই যেতে হয় আগারগাঁওয়ে। যতবারই যাই অবাক হতে হয় একদা ঢাকা শহর ত্রাসের জনপদ, সাবেক এই বিএনপি বস্তিতে এখন এক সে আধুনিক বিল্ডিংয়ের বাহার দেখে। প্রায় প্রতি মাসেই বোধ হয় এখানে যুক্ত হচ্ছে নতুন একেকটি অফিস ভবন, যার সর্বশেষ সংযোজন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অত্যাধুনিক বিল্ডিংটি। একটা দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সক্ষমতা আর বাড়বাড়ন্ত উন্নয়নের অসাধারণ উদাহরণ আগারগাঁওয়ের এই নতুন অফিসপাড়াটি।

নানা কারণে আর প্রয়োজনে বারবারই আগারগাঁওয়ের অঞ্চলটায় যাওয়া পড়ে। এই জায়গার অন্ধিসন্ধি আমার খুব ভালোই চেনা। অঞ্চলটিতে যাতায়াত সাম্প্রতিক সময় বৃদ্ধি পেলেও এলাকাটিতে যে একাধিক আধুনিক সরকারি হাসপাতাল রয়েছে সেসবের কল্যাণেও এলাকাটির সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। এলাকাটি মূলত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। একে তখন বলা হতো সেকেন্ড ক্যাপিটাল। পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সচিবালয়সহ সরকারি অফিসগুলো আর প্রাদেশিক সংসদটি এলাকায় স্থানান্তরের। বিখ্যাত মার্কিন স্থপতি লুই কানের নকশায় পাকিস্তান আমলে সেকেন্ড ক্যাপিটাল নির্মাণের কাজ শুরু হলেও যেমনটি প্রত্যাশিত তা কোনোদিনই শেষ হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সেকেন্ড ক্লাস নাগরিক হিসেবে গণ্য করত, এর একটি বড় উদাহরণ বোধ করি এই সেকেন্ড ক্যাপিটালটির কাজ আধা-খাচরা করে ফেলে রাখা।

পরবর্তীতে এলাকাটি স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়েছিল দেশের বৃহত্তম বস্তিতে, যার নাম ছিল বিএনপি বস্তি। কারা, কোন সময় এই বস্তিটি স্থাপন করে এখান থেকে নগরব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আর মাদক ব্যবসা পরিচালনা করত, তা এই বস্তিটির সে সময়কার নাম অর্থাৎবিএনপি বস্তিথেকেই স্পষ্ট। আর এর পরের গল্পটাও আমাদের সবারই জানা। এক সময় যে বিএনপি বস্তির আশপাশে ঘেঁষতে মানুষের পিলে চমকে উঠত আজ সেই অঞ্চলটির যে প্রশস্ত সড়কে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় ভবন সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বসে দেশের সম্ভবত বৃহত্তম স্ট্রিট ফুড কোর্টটি। প্রতিদিন বিকেল-সন্ধ্যায় হাজার নর-নারীর আগমনে গমগম করে আজকের আগারগাঁও- সেদিনের বিএনপি বস্তি।

মার্চ মাসে মার্চ নিয়ে না লিখে হঠাৎ করে আগারগাঁওয়ের এই অফিসপাড়া নিয়ে লিখতে বসার একটা কারণ অবশ্য আছে। হালে রাস্তার আশপাশে প্রায়ই একটা পোস্টার চোখে পড়ে। চোখে পড়েছে খোদ আগারগাঁয়েও। পোস্টারটি ছাপিয়েছে বিএনপি। তাদের এই পোস্টারটিতে লেখা আছে-টেক ব্যাক বাংলাদেশ কথাটির মর্মটি অবশ্য এখন পর্যন্ত আমার পুরোপুরি বোধগম্য নয়। কার বাংলাদেশ কার হাতেইবা তুলে দিতে চায় বিএনপি? অবশ্য অনুমান করাটাও কঠিন কিছু নয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার সরাসরি সম্পৃক্ততা এখন জলবৎ তরলং পরিষ্কার। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে সরিয়ে এনে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়ার ষোলো আনা কাজই গুছিয়ে এনেছিলেন জেনারেল জিয়া।

জয় বাংলা স্লোগান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ বেতারের নাম রাতারাতি বদলে ফেলা হয়েছিল সবকিছুই। বাহাত্তরের যে সংবিধানটি আমরা অর্জন করেছিলাম ত্রিশ লাখ শহীদ আর তিন লাখ বীরাঙ্গনার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে, তাও ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল আঁস্তাকুড়ে। একাশিতে সকল বাধা আর হুমকিকে উপেক্ষা করে যদি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে না ফিরে আসতেন তাহলে আজ বাংলাদেশকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বিএনপির সম্ভবত এত আয়োজনের প্রয়োজন পড়ত না। বাংলাদেশ অনেক আগেইটেকেন ব্যাকহয়ে যেত।

আগারগাঁওয়ে এই অঞ্চলটির যে ক্রমবিবর্তন তা বোধ করি বাংলাদেশের ঘটমান ইতিহাসের একটি চলমান বৃত্তান্ত বৈ অন্য কিছু নয়। যে পাকিস্তানের কাছে বাঙালিরা ছিল সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন, তারা এখানে সেকেন্ড ক্যাপিটাল তৈরির কাজ শুরু করেও শেষ করেনি। বাঙালিদের প্রতি তাদের উদাসীনতা আর এদেশের সম্পদ লুটে নিয়ে আমাদের উন্নয়নকে অপূর্ণাঙ্গ রেখে ওদেশের উন্নয়নের যে অশুভ ধারাটি পাকিস্তানিরা তৈরি করেছিল সে সময়কার আগারগাঁও তারই সাক্ষ্যবহ। অন্যদিকে বিএনপি বরাবরই দেশটাকে ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করেছে। দেশ আর দেশের মানুষের স্বার্থকে তারা কখনই তাদের নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে বিবেচনায় নেয়নি। বিগত দুটো জাতীয় নির্বাচনকালীন বিএনপির আগুন সন্ত্রাস আর গরু থেকে মানুষ সবকিছু নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারায় তাদের দক্ষতাতেই এর প্রমাণ। তাই পাকিস্তানিদের সেকেন্ড ক্যাপিটালকে তারা বানিয়েছিল দেশের বৃহত্তম বস্তি। সেদিন একটা আড্ডায় একজন উচ্চপদস্থ অবসরপ্রাপ্ত আমলা যখন হালকা রসিকতার ছলে মালয়েশিয়ায় নতুন রাজধানী পুত্রজায়ার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে আজকের আগারাগাঁওকেআগারজায়াবলে উল্লেখ করলেন তখন হঠাৎই এই লেখাটির কনসেপটি হুট করে মাথায় ঢুকে গেল।

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ব বিদ্যালয় সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

 

×