ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

দ্বারপ্রান্তে মোবারক মাস রমজান

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ১৬ মার্চ ২০২৩

দ্বারপ্রান্তে মোবারক মাস রমজান

পরম কাক্সিক্ষত মাস রমজানুল মোবারক এখন আমাদের দ্বারপ্রান্তে

পরম কাক্সিক্ষত মাস রমজানুল মোবারক এখন আমাদের দ্বারপ্রান্তে। ১২ মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস রমজানুল মোবারক। এ মাসেই অন্তর্নিহিত বছরের শ্রেষ্ঠ রজনী, লাইলাতুন খয়রুম মিন আলফি শাহর। খোদ প্রিয় নবী (স.) নিজেই ফরিয়াদ করতেনÑ পরওয়ারদিগার মহামহিম! রজব এবং শাবানে আমাদের জীবনে বরকত দান কর আর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের প্রতিশ্রুত মাস রমজানে পৌঁছার তৌফিক দান কর। 
ইতিহাসে আমরা দেখি সোনালি যুগের মুসলমানরা এ মাসকে যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে অতিবাহিত করার জন্য রজব মাস থেকে প্রস্তুতি নিতেন এবং খোদা তায়ালার কাছে ফরিয়াদ করতেন। তারা শাবান মাস থেকে অধিক পরিমাণে কুরআন চর্চায় আত্মনিয়োগ করতেন। ধনীরা যাকাতের হিস্যা বের করে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করতেন। যাতে মাহে রমজানে সমাজে প্রত্যেকের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকে এবং সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারে।

বস্তুত, শুধু ব্যক্তি মুসলমানের জীবনে নয়, গোটা সমাজ সংশোধনে, কৃচ্ছ্রতার মাস, সংযমের মাস রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কিন্তু আজ আমরা অতীত যুগের সোনার মানুষদের অনুসরণ করছি না বলেই সিয়ামের বরকত, রমজানের ফজিলত থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। 
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেছেনÑ ‘রমজান মাস হলো সেই মাস- যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।

কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসে রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্যদিনে গণনা পূর্ণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না- যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হিদায়াত দান করার দরুন আল্লাহতায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা কর (আর) যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।’

এর পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে- আর আমার বান্দারা যখন তোমার কছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে; বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে তাদের প্রার্থনা কবুল করে নিয়ে থাকি, যখন (তারা) আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে। (সূরা বাকারা- ১৮৫, ১৮৬)।
উপরোক্ত আয়াত দুটোর প্রথমটিতে রমজান মাসকে অন্য এগারোটি মাস থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে তুলে ধরা হয়েছে এবং এ মাসকে কুরআনের মাস হিসেবে আখ্যায়িত করে এর মধ্যে সুনির্দিষ্ট করণীয় বিবৃত হয়েছে। এ মাসকে প্রকৃত হিদায়াত ও পথপ্রাপ্তির মোক্ষম মৌসুম বলেও এখানে ইশারা করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহতায়ালার দরবারে আলীশানে ইবাদত, বন্দেগি ও প্রার্থনার গুরুত্ব এবং এসব ব্যাপারে খুলুসিয়াত বা আন্তরিক বিশ্বাসের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আয়াতের মর্মার্থ দ্বারা বোঝা যায়, রমজান মুসলিম জিন্দেগিতে একটি ট্রেনিং পিরিয়ড এবং এ থেকে ফায়দামন্দ হওয়ার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিবেশ। 
হাদিস শরীফে বারবার এ মাসকে প্রথম থেকেই অনুধাবন ও সদ্ব্যবহার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হযরত সালমান ফারেসী (রা.) একটি দীর্ঘ হাদিস আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তিনি বলেনÑ একদিন আঁ-হযরত (স.) শাবান মাসের শেষ তারিখ আমাদের উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এতে তিনি ইরশাদ করেছেনÑ হে লোক সকল! একটি মহান ও বরকতময় মাস তোমাদের সামনে উপস্থিত। এ মাসের রাতগুলোর মধ্যে এমন এক রাত বিদ্যমান যার মর্যাদা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ মাসের রোজাকে ফরজ করেছেন এবং এ মাসের রাত্রি জাগরণকে করেছেন অতিরিক্ত ইবাদতের শামিল। তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি এ মাসে একটি সাধারণ ভালো কাজ করবে অন্য মাসের তুলনায় তাকে একটি ফরজ ইবাদতের সাওয়াব প্রদান করা হবে। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ ইবাদত পালন করবে তাকে সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সমপরিমাণ সাওয়াব প্রদান করা হবে। এ মোবারক মাস ধৈর্য ও সংযমের মাস। ধৈর্যের বিনিময় অবশ্যই জান্নাত। এ মাস পরোপকারের। এ মাসে বিশেষভাবে মুমিন বান্দাদের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়।

কেউ যদি একজন রোজাদারের ইফতারের ব্যবস্থা করে আল্লাহতায়ালা তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেন, তাকে দোজখ থেকে মুক্তি দেন এবং (রোজাদারের) রোজার সমান তাকে পুণ্য দান করেন। এ সময় সাহাবাগণ জানতে চাইলেনÑ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের অনেকেই একজন রোজাদারকে ইফতারের ব্যবস্থা গ্রহণের মতো সক্ষম নই। হযরত জানালেন- এর জন্য বিশেষ কোনো আয়োজনের প্রয়োজন নেই। সামান্য দুধ, একটি খেজুর কিংবা অপারগতায় পানি দিয়ে ইফতারের ব্যবস্থা করলেও পরওয়ারদিগারে আলম উল্লিখিত পুণ্য দান করবেন।

আর যে ব্যক্তি রোজাদারকে পেটভরে তৃপ্তিসহকারে খাবারের ব্যবস্থা করবে আল্লাহ তাকে পবিত্র হাউসে কাউসারের পানি পার করাবেনÑ যার পরে বেহেস্তে প্রবেশ পর্যন্ত তার কোনো পানির পিপাসা হবে না। এ মহান পবিত্র মাস তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমাংশে আল্লাহর বিশেষ রহমত অবতীর্ণ হয়। দ্বিতীয়াংশ ক্ষমা ও মার্জনার এবং শেষ অংশ দোজখ থেকে মুক্তিদানের। যে ব্যক্তি এ মাসে তার কর্মচারীর কাজের বোঝা কমিয়ে দেয় আল্লাহ তার গুনাহর বোঝা কমিয়ে দেন এবং দোজখের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করেন।
বর্ণিত হাদিসটির মাধ্যমে আমরা দেখি, পবিত্র রমজান মাস আত্মগঠনের, সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার, পরস্পর সহানুভূতি ও সহমর্মিতার। এ মাস আধাত্ম্য সাধনা, কৃচ্ছ্র সাধন, রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের। কিন্তু একশ্রেণির মানুষ আছে যারা এ মাসে কারসাজি করে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়। ফলে শুধু রোজাদার নয় অন্যদেরও এ মৌসুমে নাভিশ্বাস ওঠে। সিয়াম পালনের এসব প্রতিবন্ধকতা, আইনশৃঙ্খলা জোরদার এবং সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে রোধ করতে হবে। আমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ নই। আসন্ন রমজান হোক মুমিন-মুত্তাকীগণের দীনতা, হীনতা দূরীকরণের সাক্ষী, সকলের আত্মোপলব্ধির। খোশ আমদেদ মাহে রমজান আহলান ওয়া সাহলান। 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×