ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তামাকমুক্ত বাংলাদেশ

ডা. তারেক মেহেদী পারভেজ

প্রকাশিত: ২০:৪১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩

তামাকমুক্ত বাংলাদেশ

তামাকজাত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করে তা কিশোর-কিশোরীদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া জরুরি

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে গেছি আমরা। অর্থনীতি, সামাজিক অনেক সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা চলমান। নানা খাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ। 
উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে হৃদরোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো নানা অসংক্রামক রোগ। কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অবশ্যই জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, সুস্থ মানুষের শ্রমের বিনিময়েই দেশ সমৃদ্ধ হয়। এজন্যই জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) লক্ষ্য ৩-এ সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের জীবনাচরণ ও অভ্যাসজনিত কারণে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব রোগের পেছনে একটি বড় কারণ তামাক ব্যবহার।
জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে তামাকের ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করে সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি। তার মধ্যে একটি হলো বিদ্যমান ব্যবহারকারীদের ধূমপান ত্যাগ করতে সাহায্য করা এবং অন্যটি যুবকদের তামাক গ্রহণ থেকে বিরত রাখা। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণা অনুসারে, এখন থেকে কেউ তামাক গ্রহণ শুরু না করলে এবং প্রতিবছর ১০ লাখ ৮০ হাজার বিদ্যমান ব্যবহারকারী তামাক ত্যাগ করলে ২০৪০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম তামাক ব্যবহারকারী দেশ। এখানে সিগারেট ও বিড়ির পাশাপাশি ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য যেমন গুল, সাদাপাতা ও জর্দা ইত্যাদি ব্যবহার করে তামাক সেবনকারীরা। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট  টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় তিন কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর বা তার বেশি) বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার করে। তামাক ব্যবহারের প্রবণতা শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন করতে হলে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে তামাক ছাড়তে হবে। অতএব, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একটি জাতীয় তামাক নিরোধ পরিষেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ ধূমপায়ী বছরে অন্তত একবার চিকিৎসকের কাছে যায়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ তামাক ছাড়তে তাদের একটি শক্তিশালী প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এমনও দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের মধ্যে দুই থেকে চার শতাংশ চিকিৎসকের পরামর্শ শুনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে কোনো জাতীয় তামাক নিরোধ সেবা কেন্দ্র নেই। গ্যাটসের ২০১৭ সালের তথ্যানুসারে, বর্তমান ধূমপায়ীদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৬.২%) এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীদের অর্ধেক (৫১.৩%) তামাক ছাড়তে চায়। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে রোগীদের জন্য কার্যকর তামাক নিরোধ সেবাকেন্দ্র নেই।
এমতাবস্থায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ২০১০ সাল থেকে রোগীদের জন্য তামাক সেবন ক্লিনিক পরিচালনা করছে। এখানে নার্সদের তামাক ত্যাগের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা রোগীদের ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কাউন্সেলিং এবং ওষুধ তামাক আসক্তির চিকিৎসায় কার্যকর হলেও দেশে তামাকবিরোধী ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় সেটি সহজে পাওয়া যায় না। তাই এ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে উৎপাদন ও বিতরণে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে তামাক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করাও জরুরি। প্রাথমিকভাবে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে এ  সেবা চালু করা গেলেও বিপুলসংখ্যক তামাক ব্যবহারকারী সেবা নিতে পারবে, যা তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সহায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে আমাদের আরেকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সেটি হলো নতুন প্রজন্মকে তামাক ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা। ইতোমধ্যে নতুন প্রজন্মকে তামাকের ভয়াল থাবা থেকে বাঁচাতে ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারির পরে জন্ম নেওয়া সবার কাছে তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ করার আইন পাস করেছে নিউজিল্যান্ড। ট্যোবাকো এটলাসের ২০২০ সালের তথ্যানুসারে, দেশে বছরে প্রায় এক লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং বছরে তামাকজনিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় সরকারের ব্যয় হয়েছে কমপক্ষে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

তারপরও তামাক কোম্পানিগুলো ভোক্তা বাড়াতে তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করে কৌশলী প্রচারণা চালানো অব্যাহত রেখেছে। তাই তামাক কোম্পানির প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে যুবসমাজকে তামাক থেকে নিরাপদ রাখতে সরকারের অনেক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
তামাকজাত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করে তা কিশোর-কিশোরীদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া জরুরি। এজন্য সিঙ্গেল স্টিক সিগারেট বিক্রি বন্ধ করা প্রয়োজন। তাহলে শিশু-কিশোরদের সিগারেট ক্রয়ক্ষমতা নাগালের বাইরে চলে যাবে। এতে তারা তামাকের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত হতে পারবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ও মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তামাকজাত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি কার্যকর ব্যবস্থা হবে। অন্যদিকে যত্রতত্র তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি বন্ধ করা এবং দোকানে তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা দরকার।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে স্কুল ও খেলার মাঠের ১০০ মিটারের মধ্যে ৮১.৮ শতাংশ দোকান তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন করে। তাই শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রণয়ন, তামাকের সহজলভ্যতা হ্রাস এবং এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধ করা গেলে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করা সম্ভব হবে।


লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)

×