ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অ্যাপসভিত্তিক ক্যাশলেস লেনদেন

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩

অ্যাপসভিত্তিক ক্যাশলেস লেনদেন

স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ

স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। শুরু হলো অ্যাপসভিত্তিক ক্যাশলেস লেনদেন কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোড ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। এই কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে চলবে পুরো মতিঝিল এলাকায়। ১২০০ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যেমন ডাব, ঝালমুড়ি, ফল, সবজি, জামা-কাপড়, জুতা বিক্রেতা এই প্রক্রিয়ার আওতায় আসল। রয়েছে ফেরিওয়ালা, মাছওয়ালা, গৃহস্থালি সরঞ্জাম, শুঁটকির দোকান, আনারস বিক্রেতা, চায়ের দোকান ও ফুটপাতের অন্যান্য ক্ষুদ্র দোকানদারও।

শুরুতে বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যোগাযোগ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নামে একাউন্ট খোলা হয়েছে। সেখান থেকে কাউকে এটিএম কার্ড, কারওবা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের একাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। মোবাইলের যে কোনো আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের অ্যাপস খুলে এই কিউআর কোড স্ক্যান করলেই বিক্রেতার নাম, ছবি, অ্যাকাউন্ট নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য ক্রেতার সামনে দৃশ্যমান হবে। এরপর নির্দিষ্ট স্থানে টাকার অংক বসিয়ে সেন্ড করে দিলেই বিক্রেতার হিসাবে টাকা চলে যাবে।

ব্যবসা-বাণিজ্যে নগদ অর্থের পরিবর্তে ক্যাশলেস লেনদেনের এই পদ্ধতি উন্নত বিশ্বে অনেক আগেই চালু আছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন শপিংমলে পণ্য বেচা-কেনায় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ, রকেট, এমক্যাশ, শিওর ক্যাশ ও নগদে কিউআর কোড পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। কিন্তু এতদিন যাবৎ গুটিকয়েক ব্যাংক ও এমএফএসের নিজস্ব কিউআর থাকলেও সর্বজনীন কিউআর ছিল না। ফলে শুধু ওই ব্যাংক/এমএফএস গ্রাহকরা পারস্পরিক লেনদেনেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বজনীন বাংলা কিউআর প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়। 
ক্যাশলেস লেনদেনের নতুন এই উদ্যোগে প্রচলিত তিনটি এমএফএসের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে ১০টি বাণিজ্য ব্যাংক ও তিনটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম। অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলো হলোÑ ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক। আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ের মধ্যে আছে মাস্টারকার্ড, ভিসা ও আমেরিকান এক্সপ্রেস (অ্যামেক্স)। ভবিষ্যতে কিউআর কোডের মাধ্যমে দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা হবে।

আপাতত দৈনিক সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত একজন এই পদ্ধতিতে লেনদেন করতে পারবেন। দেশের বেশিরভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকায় তাদের পক্ষে আর্থিক লেনদেন বেশ কঠিন ছিল এতদিন। কিন্তু এমএফএসের মাধ্যমে ক্যাশলেস আর্থিক লেনদেন এক চমৎকার সুযোগ, যা শুধু টাকা জমা দেওয়া কিংবা উত্তোলন অথবা অর্থ স্থানান্তরই নয়, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধ, ভর্তি ফি প্রদান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি জমাকরণ প্রভৃতি কাজ ব্যাংকে না গিয়ে ঘরে বসেই সম্পন্ন করা যায় সহজে ও সামান্য খরচে।

উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের পরে বিশ্বে কিউআর কোডের প্রথম প্রচলন শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ১১ মার্চ বাংলা কিউআর স্ট্যান্ডার্ড ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই পথ ধরেই নির্দিষ্ট যে কোনো ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে ক্যাশলেস লেনদেনের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হলো ২০২৩ সালের শুরুতেই।
ক্যাশলেস এই লেনদেন আগের চেয়ে অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী  হওয়ায় দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে। নগদ অর্থ বহন ও পরিশোধ ঝুঁকিপূর্ণ, চেক পরিশোধ সময়সাপেক্ষ ও জটিল। এই পদ্ধতিতে সেই ঝামেলা নেই। নেই কোনো ভাংতি ও খুচরা টাকার ঝামেলাও। থাকছে না ছেঁড়া-ফাটা বা জাল নোটের আশঙ্কা। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের জন্য ব্যাংক, এমএফএসগুলোকে ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো বিনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়।

ফলে কার্ডে মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা মার্চেন্টদের জন্য ব্যয়বহুল। উল্লেখিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পক্ষে এ ব্যয় বহন করা সম্ভব নয় বিধায় প্রান্তিক পর্যায়ে ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসার কাক্সিক্ষত মাত্রায় অর্জিত হয়নি। এমতাবস্থায় বাংলা কিউআর কোডটি মোবাইল অ্যাপে স্ক্যান করে দ্রুত, সহজ ও সুলভে লেনদেন করার জন্য এটি একটি চমৎকার পদ্ধতি। লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার পরে এবং পেমেন্টের কনফার্মেশন ও ই-রিসিট পায় সংশ্লিষ্ট গ্রাহক। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা এমএফএস ওয়ালেটধারীরাও অ্যাপের মাধ্যমে এই সুবিধা নিতে পারবে। তবে ক্যাশলেস লেনদেনে সুবিধা থাকলেও প্রচলিত নগদ টাকায় বেচা-বিক্রি করতে কোন বাধা থাকছে না।
অন্য মোবাইল সেবার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, এতদিন কোনো একটি ব্যাংক বা মোবাইল আর্থিক সেবার অ্যাপস দিয়ে শুধু সেই প্রতিষ্ঠানের কিউআর কোডে গ্রাহক পেমেন্ট করতে পারতেন। কিন্তু এই উদ্যোগে বিক্রেতার কাছে থাকা কিউআর কোডে উল্লিখিত যে কোনো ব্যাংক বা মোবাইল সেবার অ্যাপ দিয়েই পেমেন্ট করা যাবে। বাংলাদেশে এখন ১৭ কোটির বেশি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের হিসাব রয়েছে। তাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নতুন এই পদ্ধতিতে নগদ অর্থের পরিবর্তে ক্যাশলেস লেনদেনে উৎসাহিত ও আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। এভাবে দেশের সকল ক্ষুদ্র বিক্রেতার বিল গ্রহণ পদ্ধতিকে ডিজিটাল এবং প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলা হবে।

গ্রামবাংলার কম শিক্ষিত লোকজনও যাতে ভবিষ্যতে বাংলা কিউআর ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক/এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী ছোট-বড় সকল মার্চেন্টকে পণ্য বা সেবা মূল্য পরিশোধের আওতায় আনা হচ্ছে। যেহেতু কিউআর কোড কেবল একটি প্রিন্টেড ছবি হওয়ায় মূল্য পরিশোধে খরচ খুব নগণ্য, তাই অ্যাপসভিত্তিক কিউআর কোডের গ্রহণযোগ্যতা প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। তবু প্রক্রিয়াটিতে আরও স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা, আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ, লিফলেট, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার করা প্রয়োজন।

বিগত দিনে অনলাইন ব্যবসা এবং ব্যাংক থেকে টাকা বিদেশে পাচারের মতো ঘটনা যাতে ক্যাশলেস লেনদেনে না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর তা নিশ্চিত হলেই বাংলা কিউআর সিস্টেমে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
আমরা দেখছি কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই বিদেশের মতো দেশেও উবার, পাঠাও এবং সিএনজির ভাড়া মোবাইল ফোন তথা বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাচ্ছে। এমনকি রাজধানীর বাইরে অলিগলির দোকানেও আজকাল বিল দেওয়া যাচ্ছে বিকাশ, রকেট ও নগদের মতো সেবার মাধ্যমে। এতে ডিজিটাল লেনদেনে প্রতিনিয়তই নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। নিম্নশ্রেণি থেকে শুরু করে সব ধরনের মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে এই পদ্ধতিতে।

বর্তমানে দেশে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। মোটা দাগে দেশজুড়ে এখন ২ লাখ ৭০ হাজার ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান ও দোকান বিকাশের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করছে। নগদে আছে প্রায় ৩১ হাজার মার্চেন্ট। রকেটেরও আছে কয়েক হাজার মার্চেন্ট। তবে কিউআর কোড পদ্ধতি পৃথিবীতে এখন ডিজিটাল বা ক্যাশলেস লেনদেনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নির্ঝঞ্ঝাট ও সাশ্রয়ী মাধ্যম। আমাদের দেশে এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বিকাশ। গত ১০ বছরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, হাটে-বাজারে এবং শহরগুলোতে বিকাশের এজেন্ট বিস্তৃত হয়েছে ব্যাপক।

দেশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই বিকাশের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু বিকাশের সমস্যা হলো, এতে খরচ বেশি, হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা। কোথাও টাকা পাঠাতেও ৫ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়। রকেট, নগদ, শিওর ক্যাশ ইত্যাদি মাধ্যমেও খরচ বেশ। সেই বিবেচনায় অ্যাপসভিত্তিক কিউআর কোডের ক্যাশলেস লেনদেন খুব সাশ্রয়ী। হয়ত বিশ্বব্যাপী ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মতো পুরনো প্রাগৈতিহাসিক পেমেন্ট সিস্টেমের জায়গা দ্রুত দখল করে নিচ্ছে কিউআর কোড। বাংলাদেশেও স্বল্প সময়ের মধ্যেই নগদ টাকায় মূল্য পরিশোধের পুরনো প্রক্রিয়া পরিবর্তীত হয়ে ক্যাশলেস লেনদেনে রূপান্তর হবে। ধাবিত হবে স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×