ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রসঙ্গ পাতাল রেল

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:২৭, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩

প্রসঙ্গ পাতাল রেল

স্বপ্নের মেট্রোরেলের পর এবার পাতাল রেলের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ

স্বপ্নের মেট্রোরেলের পর এবার পাতাল রেলের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট পরিবহন। যোগাযোগ ব্যবস্থায় গোটা পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে এটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। ২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম পাতাল রেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করবেন। এই প্রকল্প থেকে দুটো রেললাইন নির্মাণ করা হবে। একটি লাইন বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার অংশ।

এটি মাটির নিচ দিয়ে যাবে। আর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার রেললাইন উড়ালপথে যাবে। ২১ স্টেশনবিশিষ্ট ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেলের জন্য পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশে প্রায় বিশ কোটি মানুষের বাস। সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এ জনগোষ্ঠী আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পরিণত হয়েছে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে।

যাতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে বিস্তৃৃত যোগাযোগ ব্যবস্থা। সড়ক পথ তো বটেই উড়াল সড়ক হয়ে এখন পাতাল সড়কও নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন এক নতুন বিপ্লবের উদাহরণ। আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। মূলত আশির দশকে দেশের যোগাযোগ খাতে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের ধারা শুরু হয়। গত এক যুগে মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে বাংলাদেশে। অর্থনীতিতে গতি আনতে দেশের যোগাযোগ ও পরিবহন খাতের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বড় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে যাচ্ছে।
‘বাঁচবে সময়, বাঁচবে পরিবেশ, যানজট কমাবে মেট্রোরেল’- এই ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেল প্রকল্পের ভৌত কাজ আগামী ডিসেম্বরে শুরু এবং ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে। এমআরটি লাইন-১ চালু হলে এই রুটে প্রতিদিন ৮ লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারবেন। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর যেতে সময় লাগবে ২৪ দশমিক ৩০ মিনিট। আর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল যেতে সময় লাগবে ২০ দশমিক ৩৫ মিনিট। এমআরটি লাইন-১ এর প্রতিটি পাতাল স্টেশন হবে তিনতলা। টিকিট কাউন্টার ও অন্যান্য সুবিধা থাকবে প্রথম বেজমেন্টে।

যাত্রীদের চলাচলের জন্য উড়াল ও পাতাল- দুই পথের স্টেশনেই থাকবে লিফট, সিঁড়ি ও এস্কেলেটর সুবিধা। সরকারের প্রতিটি মেগাপ্রজেক্টেরই মুনাফা অর্জনের বাণিজ্যিক দিক রয়েছে। তবে অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রকল্পের মতো কেবল মুনাফা অর্জনই সরকার-প্রবর্তিত প্রকল্পের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, সরকার ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং সাধারণত একটি বিশাল ভর্তুকি প্রদান করে, যাতে জনগণ সাশ্রয়ী মূল্যের পরিষেবা থেকে উপকৃত হতে পারে। এ উদ্যোগের ফলে আর্থিক ক্ষতি হলেও দেশের অর্থনীতি অন্যান্য ক্ষেত্রে উপকৃত হয়। একই রুটে বাসে যাতায়াতের সময়ের চেয়ে মেট্রোরেলে যাতায়াতের সময় তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত একটি বাসে যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা এবং ভিড়ের সময়ে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। মেট্রোরেলে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। মেট্রোরেল পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর লোকবলের প্রয়োজন হবে, যা বাংলাদেশে অনেক কাজের সুযোগ তৈরি করবে। ইউএনবির মতে, প্রতিটি মেট্রো রেলস্টেশনে একটি অপারেটিং রুম, টিকিট কাউন্টার, লাউঞ্জ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট, প্রার্থনার স্থান, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা, এস্কেলেটর, লিফট এবং আরও অনেক কিছু থাকবে। 

যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশ এর বেশি। ২০২০ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে যানজট এবং এর প্রভাবে বার্ষিক প্রায় ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বর্তমান রেটে প্রায় ৩৩ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে বাংলাদেশ ২.৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে।

এ ছাড়া ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, মেট্রোরেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে যা জাতীয় জিডিপির ১.৫ শতাংশ এর সমান। তা ছাড়া মেট্রোরেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে গতিশীল করবে, যা অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।
পাতাল রেল চালু হলে ঢাকা শহর থেকে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো যাবে। মানুষ বাসা ভাড়া অনেক কম খরচ করে শহরের বাইরে থাকতে পারে এবং অফিস ও অন্যান্য কাজে সহজে ঢাকায় আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জ এলাকায় বসবাসকারী লোকেরা সব রুট সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে মূল শহরে যেতে পারে। প্রতিটি মেট্রোরেল রুটে ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। সুতরাং, পুরো ট্রানজিট সিস্টেমটি কাছাকাছি শহরে প্রসারিত করা যেতে পারে। বর্তমানে এসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজনও সেখানে বসবাস না করে মূল শহরের কর্মী বাহিনীতে যোগ দিতে পারেন।

তা ছাড়া, অনেক বাণিজ্যিক উন্নয়ন ঘটবে এবং রুটের চারপাশে সুবিধাগুলোর ভাড়া এবং মূল্য বাড়বে। দ্বিতীয়ত, আবাসিক ভবন বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য পুনর্নির্মাণ করা হবে। ফলস্বরূপ, ওইসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজন কম ভাড়ার জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হবে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ কেন্দ্রীয় শহর থেকে বিকেন্দ্রীভূত হবে। মেট্রোরেল আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি নতুন যুগে আবদ্ধ করবে। উন্নত দেশগুলোয় মেট্রোরেল এবং অন্যান্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন মাধ্যমগুলোকে একত্রিত করে একটি উন্নত রুট সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে, যাতে মানুষ শুধু একটি পেমেন্ট কার্ডের মাধ্যমে তাদের গন্তব্যে ভ্রমণ করতে পারে।

বাংলাদেশে এরই মধ্যে মেট্রোরেলে ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে। সিস্টেমটি ধীরে ধীরে সব ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রসারিত করা যেতে পারে। এটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন আনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
পাতাল রেল আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি নতুন যুগে আবদ্ধ করবে। উন্নত দেশগুলোয় মেট্রোরেল এবং অন্যান্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন মাধ্যমগুলোকে একত্রিত করে একটি উন্নত রুট সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে যাতে মানুষ শুধু একটি পেমেন্ট কার্ডের মাধ্যমে তাদের গন্তব্যে ভ্রমণ করতে পারে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে মেট্রোরেলে ব্যবস্থা  তৈরি করা হচ্ছে। সিস্টেমটি ধীরে ধীরে সব ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রসারিত করা যেতে পারে।

এটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন আনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। ঢাকাবাসীর যাতায়াতের একটি সুবিধাজনক মাধ্যম হবে মেট্রোরেল। কারণ এটি প্রচুর যাত্রী বহন ক্ষমতাসহ একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন সুবিধা প্রদান করবে, এটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করবে এবং প্রতি ৪ মিনিটে প্রতিটি স্টেশনে একটি ট্রেন যাতায়াত করবে।
পাতাল রেল চালু হলে ঢাকা শহর থেকে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো যাবে। মানুষ বাসা ভাড়া অনেক কম খরচ করে শহরের বাইরে থাকতে পারে এবং অফিস ও অন্যান্য কাজে সহজে ঢাকায় আসতে পারে। তা ছাড়া, অনেক বাণিজ্যিক উন্নয়ন ঘটবে এবং রুটের চারপাশে সুবিধাগুলোর ভাড়া এবং মূল্য বাড়বে। দ্বিতীয়ত, আবাসিক ভবন বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য পুনর্নির্মাণ করা হবে। ফলস্বরূপ, ওইসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজন কম ভাড়ার জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হবে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ কেন্দ্রীয় শহর থেকে বিকেন্দ্রীভূত হবে।
পাতাল রেল রাজধানীর পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঢাকার বায়ুদূষণ অন্যান্য মেগাসিটির তুলনায় অনেক বেশি তীব্র। যেহেতু মেট্রোরেল ‘বিদ্যুৎচালিত’ এবং প্রতি ঘণ্টায় বেশি যাত্রী বহন করতে পারে, তাই ঢাকায় বাস ও অন্যান্য পরিবহনের মাধ্যমে যাতায়াতের প্রবণতা কমে যাবে। এতে সড়কে যানবাহনের সংখ্যা কমবে, যা পরিবেশের জন্য উপকারী হবে। কাজেই, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, মেট্রোরেল সেই স্বপ্নের প্রকল্প যে প্রকল্প ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিক কসমোপলিটনে রূপান্তর করবে। 
কাজেই, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, মেট্রোরেল সেই স্বপ্নের প্রকল্প যে প্রকল্প ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিক কসমোপলিটনে রূপান্তর করবে। বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বে পদার্পণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে সে সময় বেশি দূরেও নয়। সেই সোনালি ভবিষ্যতের উন্নত মহানগর ঢাকার অপরিহার্য অনুষঙ্গ মেট্রোরেল আজ বাস্তব। পাতাল মেট্রোরেল স্মার্ট বাংলাদেশের নতুন সংযোজন।

মেট্রোরেল আমাদের অহংকার, এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের নেত্রী উপহার দিয়েছেন। কাজ শেষ হলে যোগাযোগব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে। সরকারের যোগাযোগবান্ধব নীতির ফলে এ খাতে ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দেশের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বিকাশ এবং যানবাহন সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় টেকসই সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহের পাশাপাশি বাস্তবায়নাধীন ও পরিকল্পনাধীন কার্যক্রম শেষ হলে দৃশ্যমান হবে যোগাযোগ খাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন। 

লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

×