ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

উষ্ণ দুপুর শীতল সন্ধ্যা

শামীম আহমদে

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

উষ্ণ দুপুর শীতল সন্ধ্যা

তিনদিন আগে সারাদিন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল

তিনদিন আগে সারাদিন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টি আর বরফ মিশিয়ে। আমি যে জায়গায় থাকি অর্থাৎ ডাউনটাউন, সেখানে বৃষ্টি কিংবা বরফ কোনটাই প্রবল না হলে কিছুক্ষণ পর তার প্রভাব মিলিয়ে যায়। সেদিনও তেমনটি হলো। দিনটি ছিল রবিবার। সারাদিন ঘর থেকে বের হওয়া হয়নি। মধ্যরাতে ময়লা ফেলতে নিচে নেমেছিলাম। তিন ব্যাগ ময়লার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আমরা মানুষ মাত্র তিনজন, প্রতিদিন গরম, শীত, বর্ষা যাই হোক না কেন এগারোতলা থেকে নেমে তিন ধরনের আলাদা ডাস্টবিনে এগুলো আমাকে ফেলতে হয়। অত্যন্ত বিরক্তিকর কাজ বেশিরভাগ সময়।

শীতকালে আবার এই বাসা থেকে বের হলেই একগাদা কাপড় পরতে হয়। তবে সেদিন নিচে নামতে চাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়াই হুট করে ঘরের ভেতর দম বন্ধ লাগে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সময় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া ভালো। প্যানিক এটাকের ক্ষেত্রে বিশেষত খোলামেলা জায়গায় থাকা ভালো। ময়লা ফেলে মাইনাস ৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছু মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে। এদের বেশিরভাগই কুকুরকে হাঁটতে বের করেছে। সকালে ও সন্ধ্যায় দুবেলা অন্তত কুকুর নিয়ে বের হয়। এই সময়ই কুকুর তার প্রাকৃতিক ক্রিয়াটি সম্পন্ন করে।

আমার খুব শখ একটা কুকুর পোষার। কিন্তু এপার্টমেন্টে বিড়াল পোষা সম্ভব হলেও কুকুর পোষা সম্ভব না। তার ওপর আবার শীতকালে শূন্যের নিচের তাপমাত্রায় তাকে বের করে হাঁটাতে হবে ভাবলে উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়ে। আর যারা কুকুর-বেড়াল পোষেন তারা জানেন এর পেছনে বিস্তর অর্থ ব্যয় হয়। নিজে কিছু একটা খেয়ে নিলেও পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রে এতটাই মায়া জন্মে যে, তার জন্য সেরাটাই চাই। এমন একাধিকবার হয়েছে যে, আমাদের পোষা বিড়াল মিকির খাবার কেনার বিলাসিতা করতে গিয়ে নিজের শখের কোনো একটা জিনিস পুরো একমাস খাইনি।

কুকুর পোষার খরচ আরও বেশি। ঠাণ্ডার মধ্যে মেনুলাইফ সেন্টার আর ৩৫ চার্লস স্ট্রিটের দুটো ছবি তুলে রাখলাম। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর এসব ছবি নিশ্চয় অমূল্য প্রমাণিত হবে। গতকাল সকালে ঘুম ভেঙেছিল ১০টা বেজে ১৯ মিনিটে। অথচ এলার্ম দেয়া ছিল সকাল ৯টায়। ফাইয়াজের সঙ্গে পুনর্নির্ধারিত আড্ডা ও সকালের নাস্তা সাড়ে ১০টায়। উঠে তাড়াহুড়া করে ওকে মেসেজ দিয়ে বললাম, আমার আসতে আসতে ১১টা বাজবে। রওয়ানা দিয়ে পথে নেমে টের পেলাম সাড়ে ১১টার আগে কিছুতেই পৌঁছানো যাবে না। ওকে বললাম এই ফাঁকে বাজার-সদাই করে রাখতে।

আড্ডা রেস্তোরাঁয় পৌঁছে বরাবরের মতো গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা দেখলাম না। উল্টোদিকের মলের পার্কিংয়ে  গাড়ি রেখে ভিতরে এসে বসে খাবারের আড্ডা দিলাম। এদের লুচি, সব্জি, আলু ভাজি, গিলা-কলিজা ভুনা আর সুজির হালুয়ার তুলনা মেলা ভার। সঙ্গে চা আর ফল থাকে। তবে সব খাবারই তেলে চপচপ করে। মাসে, দুমাসে একদিন তেল বেশি খেলে কিছু হবে না এই বলে মনকে সায় দিই। যদিও ডাক্তার বলেছে কোলেস্টেরলের গতি ঊর্ধ্বমুখী। আগামী এক বছরের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে না আসলে ওষুধ খেতে হবে। ওদিকে এ মাসে দুবার ব্লাড প্রেসার চেক করিয়ে একবার পেয়েছি ১৫০/১১০, আরেকবার ১৪০/৯৫। দুটোই অত্যন্ত বেশি। এক বন্ধু বলল, হাইপারটেনশন হতে পারে।

ফাইয়াজের সঙ্গে লুচি ভাজা আর কলিজা ভুনায় আড্ডা জমে যায় মূলত রাজনীতি ও সমাজনীতির আলোচনায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম ‘ছোট মানসিকতার মানুষ অন্য মানুষ নিয়ে আলাপ করে, সাধারণ মানুষ আলাপ করে আশপাশের নানা ঘটনা নিয়ে আর বড় মনের মানুষরা আলাপ করে বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা নিয়ে।’ ফাইয়াজের সঙ্গেও বিষয়টা তাই হয়। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে ব্যক্তি আর ঘটনা নিয়ে আলাপ করলেও ওর উপস্থিতিতে সেটা বেশিদূর আগায় না। আমরা এবার বেশিক্ষণ সময় আলাপ করেছি বাংলাদেশের রাজনীতি, কে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন তা নিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে শ্রীলঙ্কা হওয়া থেকে বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছেন এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে কী হতে পারে সেই বিষয়ে। আড্ডায় সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ফাইয়াজ ছোটে পিকারিং-এ। আমি যাই ভিক্টোরিয়া বাংলাবাজারে। শনিবার বেজায় শীত ছিল। যতবারই গাড়ি থেকে বেরিয়েছি ঠা-ায় জমে গিয়েছি। বাসায় ফিরে রাতে রান্না করলাম দুই পদের মুরগি, দুই পদের গরু আর একটা আলু চিংড়ির তরকারি। পাঁচ ধরনের খাবার রেঁধে, ঘর পরিষ্কার করে, ময়লা ফেলে এসে শরীরে আর কোনো জোর থাকে না। তারপর আবার গেলাম ফ্রেশকো সুপারস্টোরে।

ওখান থেকে লাউ, মিষ্টি কুমড়া আর ঢেঁড়স এনে মুনমুনকে বললাম, রবিবার সকালে রেঁধে ফেলতে। তাহলে আমাদের এক সপ্তাহের রান্নার কাজ শেষ। অহনার এই সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা শুরু। কিসের পরীক্ষা ঠিক জানি না। তবে ক্লাস টেনে ওঠার পর দেখছি ওর মধ্যে পড়ালেখাজনিত উদ্বেগের জন্ম হয়েছে। কিছুদিন আগে ওকে বললাম, আমি সারাজীবন পড়ালেখা নিয়ে টেনশন করেছি। এই মাসেও কি রাতের শুরুতেই দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙা ছাড়া কোনো রাত পার করতে পেরেছি! তাই অত চিন্তা করে লাভ নেই। কানাডায় এসেও যদি পড়ালেখা নিয়ে এত চিন্তা করতে হয় তাহলে বাংলাদেশে থাকলেই হতো। ও মুচকি হাসলেও আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে হয়নি।    
যাই হোক এবার একটু বিশ্বের দিকে চোখ ফেরানো যাক। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এতে উল্লাস প্রকাশ করে বাংলাদেশের দিকে ইঙ্গিত করে নানা কথা বলেছেন। আমি কানাডার বাংলাভাষী সাংবাদিক শওগত আলী সাগরকে বললাম, আমি ঠিক নিশ্চিত নই, দায়িত্ব ছেড়ে দেয়াকে আমরা অতিরিক্ত প্রশংসা করি কিনা। হয়ত দীর্ঘদিন ব্রিটিশ, পাকিস্তান কিংবা অন্যান্য স্বৈরশাসকের অধীনে থাকার কারণে আমাদের মধ্যে এই ধারণা দানা বেঁধেছে যে, বর্তমান শাসকের হাত থেকে মুক্তিই সবচেয়ে বড় অর্জন।

জেসিন্ডার পদত্যাগ নিউজিল্যান্ডের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আমার ধারণা, তিনি কোনো একটি মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিতে ’status quo’ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সব সময় নতুন নতুন ধারণা বের করতে হবে এটি জরুরি নয়। সারা পৃথিবীর শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিউজিল্যান্ড কিছুটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জেসিন্ডা পদত্যাগ না করে ’status quo’ ধরে রাখলেই সেটা হয়ত দেশের জন্য ভালো হতো। তিনি চলে যেতেই পারেন। এটা তার স্বাধীনতা।

কিন্তু ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া মানেই মহৎ ও বিরাট কিছু এমনটা সব সময় নাও হতে পারে। এদিকে বাংলাদেশ উত্তাল সপ্তম শ্রেণির জীব বিজ্ঞানের (অনুসন্ধানী পাঠ) বিষয়ক একটি বই নিয়ে। মূল সমালোচনাটি হচ্ছে জীববিজ্ঞানের এই বইটির অনেক ধারণা ইংরেজি উৎস থেকে সরাসরি গুগল ট্রান্সলেটে অনুবাদ করে বইটিতে ছাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সেখানে মূল উৎস বা লেখকের কোনো রেফারেন্স দেয়া হয়নি। জীববৈচিত্র্য কি এই বিষয়টির সংজ্ঞা তো প্রতিষ্ঠিত। সেটি যখন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বইতে উল্লেখ করা হবে তখন সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞাটিই তুলে ধরা হবে। আমাদের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে কখনই কোনো রেফারেন্স দেয়া হয় না।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসাইনমেন্ট লেখার আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের রেফারেন্স লেখা শেখানোর প্রচলন পৃথিবীর কোথাও আছে এমনটা শুনিনি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে গুণগত পরিবর্তন আশা করেছিলাম গত ১৪ বছরে তার সবটুকু বাস্তবায়ন হয়নি। সৃজনশীলতার নামে এমন সব প্রশ্ন করা হয় যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের উন্মেষে কোনো ভূমিকা রাখে না। আশা করেছিলাম আওয়ামী লীগের ১৪ বছরে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা মাধ্যম ইত্যাদিতে আরও সমন্বয় আসবে। ততটা এখনও আসেনি। কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুখস্থ বিদ্যার প্রকোপ কমেছে।

বিবর্তনবাদ, নারীর অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা নানা বিষয়ের সংশ্লেষ ঘটছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। সপ্তম শ্রেণির বইটি নিয়ে এই অতি উৎসাহীদের কর্মকা-ের মূল কারণ আমার মনে হয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সংশ্লিষ্টতা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে একত্রিত করে দীর্ঘদিন পরে ক্ষমতায় আসা, মুক্তিযুদ্ধের ধারণাকে প্রাধান্য দেয়া এসব বিষয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। শাহবাগ আন্দোলনে বাংলাদেশের মিষ্টি কথা বলা ওপরের তলার সুশীলদের আমরা কখনই যেতে দেখিনি, যেখানে স্যার দিনের পর দিন উপস্থিত থেকেছেন।

নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে সপ্তাহ ধরে বৃষ্টিতে ভিজেছেন। আজকের বাংলাদেশকে ১৯৭১-এর ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের ভূমিকা অনন্য এবং জীববৈচিত্র্য বিষয়ক আলোচনায় যারা তাকে ‘ভিকটিম’ বানানোর চেষ্টা করছেন তাদের মূল আপত্তির জায়গা মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের সংশ্লিষ্টতা। তাদের রাগের কারণ দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের বই পড়ে কথা শুনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া নিয়ে।

এখানে সপ্তম শ্রেণির বইয়ের বিষয়টি মুখ্য নয়। এটি যে একটি অমূলক অভিযোগ সেটি বোঝার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছাও এদের অধিকাংশেরই নেই। তবে দেশের স্বনামধন্য একটি পত্রিকার এই ভিত্তিহীন বিষয়টিকে ‘লাইমলাইটে’ আনা আমার কাছে উদ্দেশ্যমূলক ও বিরক্তিকর মনে হয়েছে।
অবশেষে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেলে’ মুক্তির ঘোষণা দিয়েছে আপিল বোর্ড। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর। একটা চলচ্চিত্র কোনো সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া চার বছর সেন্সর বোর্ডে আটকে ছিল, বিষয়টা অবিশ্বাস্য লাগে। হলি আর্টিজানের ঘটনা আমার জন্য নানাভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ওই ঘটনার সন্ধ্যায় আমি টুইটারে খুব সরব ছিলাম।

আমার মনে পড়ে, টুইটারে পোস্ট দেখে পশ্চিমা বিশ্বের নানা গুরুত্বপূর্ণ টিভি চ্যানেল আমার সাক্ষাৎকার নিতে থাকে লাইভ ঘটনা চলাকালীন। এক পর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে বিদেশী চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে অনুৎসাহিত করেন। দ্বিতীয়ত, এই ঘৃণ্য হত্যাকা-ের সঙ্গে কানাডায় ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোয় পড়ুয়া এক বাংলাদেশী ছাত্রের সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গ আসে। ওই সময় আমারসহ অনেক ভিসাপ্রার্থীর আবেদন আটকে দেয় কানাডা। ভিসা পেতে দেরি হওয়ার কারণে এক পর্যায়ে আমার কানাডিয়ান প্রাদেশিক সরকার থেকে প্রাপ্ত পিএইচডির পূর্ণ স্কলারশিপটিও বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

পরে ভিসা পেলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রায় ৪ মাসের স্কলারশিপ জলাঞ্জলি দিয়ে পরবর্তী সেমিস্টারে আমি পিএইচডি শুরু করি। জানুয়ারি পিএইচডি শুরু করার জন্য খুব খারাপ সময়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। তৃতীয়ত, কানাডায় আসার পর পিএইচডির প্রথম প্রস্তাবনা হিসেবে আমি বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইসলামী উগ্রবাদে আগ্রহী হওয়ার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে পিএইচডি করার আগ্রহ প্রকাশ করি।

কিন্তু আমার কানাডিয়ান সুপারভাইজার ও আরেক কানাডিয়ান কমিটি মেম্বার এই বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বিধায় নিরুৎসাহিত করেন। সুতরাং নানা কারণে হলি আর্টিজান এবং তার ধারাবাহিকতায় ‘শনিবার বিকেলে’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে আমার আগ্রহ জন্মায়। ওই সময়ের সব পত্রিকা পড়ে, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা জানলেও এই ঘটনায় ফারাজ নায়কোচিত ভূমিকা রেখেছে এমন কিছু তখন শুনিনি। বরঞ্চ উল্টোটা দুয়েক সূত্র থেকে শুনেছি, কিন্তু গুরুত্ব দিইনি। কারণ, নিহত সবাই দুর্ভাগ্যের শিকার, আমরা তাদের সবার প্রতি সহানুভূতিশীল।

কয়েকদিন আগে ফারাজের বন্ধু অবন্তিকার মায়ের প্রেস কনফারেন্স শুনে মনে হয়েছে, যারা ফারাজকে চেনে তারা কেউ তার নায়কোচিত চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত নয়। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, ওই ঘটনায় অনেকে বেঁচে থাকলেও এই বিষয়ে চলচ্চিত্র বানানোর ক্ষেত্রে কাল্পনিক নায়কের আশ্রয় নেয়া যায় স্রেফ অর্থ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে। 
ফারাজকে নায়ক বানিয়ে ভারতের চিত্র পরিচালক এই বিষয়ে ঘটনার প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর কেন চলচ্চিত্র বানিয়ে মুক্তি দিতে চাইছেন এটি একটু অবাকই লেগেছে। এমন না স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে চলচ্চিত্র বানানোর মতো আর কোনো বিষয়ের অবতারণা হয়নি। তবে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিকমানের হত্যাকা-ের সন্ত্রাসীরা ইসলামি আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল এটি ভারত ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশবিরোধী শিবিরের জন্য একটা জুতসই প্রোপাগান্ডা ইস্যু এতে কোন সন্দেহ নেই।

অন্যদিকে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী মাত্র পনেরো দিনের মহড়া শেষে সাতদিনে চলচ্চিত্রটি ধারণের কাজ শেষ করেন। ফারুকীর চলচ্চিত্রেও ভারত ও জার্মানির বিনিয়োগ আছে বলে শুনেছি। এত বছর পর যখন ভারতের চলচ্চিত্রটি মুক্তির ঘোষণা এলো তখনই আপিল বোর্ড কেবল চলচ্চিত্রের শুরুতে এই চলচ্চিত্র হলি আর্টিজানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়নিÑ এই সতর্কবাণী লিখে দেওয়ার শর্তে মুক্তির ঘোষণা দেওয়ার বিষয়টা নাটকীয় লেগেছে। ফারাজ ও শনিবার বিকেলের শুরুতে ও শেষে যাই লিখে দেয়া হোক না কেন এ দুটি চলচ্চিত্রই যে হলি আর্টিজানকে কেন্দ্র করে সেটি দুধের শিশুরও বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

এখন শনিবার বিকেলে চার বছর ধরে সেন্সর বোর্ড ভারতীয় সরকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বাংলাদেশবিরোধী শিবিরের স্বার্থরক্ষার জন্য আটকে রেখেছিল- এই আশঙ্কা যদি কারও মনে আসে তাহলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। এই যে এসব কন্সপিরেসি থিওরির প্রচারণা তার দায় যারা চার বছর বিনা কারণে ‘শনিবার বিকেলে’ আটকে রাখল তাদের। মাঝে সেন্সর বোর্ড তুলে দেওয়ার একটা আলাপ শুনেছিলাম। বিষয়টা ভালো হলেও বাংলাদেশ এখনো প্রস্তুত নয়। তবে সেন্সর বোর্ডের আরও কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করছি। যাই হোক, এখন দুটি চলচ্চিত্রই দেখে আরেকটা লেখা লিখতে হবে ফেব্রুয়ারি মাসে। 
টরন্টো
২৩ জানুয়ারি ২০২৩

[email protected]

×