ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

শিক্ষা ও নৈতিকতা

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:১৮, ৩ জানুয়ারি ২০২৩

শিক্ষা ও নৈতিকতা

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে নিয়ে আসে আলোতে। আর নৈতিকতা মানুষের জীবনকে করে তোলে সুন্দর ও সমৃদ্ধ। এ দুটির সমন্বয় হলে একজন মানুষ সৎ, চরিত্রবান, ঈশ্বর ভীরু, দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। বর্তমান সমাজের জন্য নৈতিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকরা নিজস্ব চিন্তা-চেতনার আলোকে শিক্ষার বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমনÑ দার্শনিক সক্রেটিসের মতে, ‘শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের আবিষ্কার’। দার্শনিক প্লেটোর মতেÑ ‘শিক্ষা হচ্ছে সেই শক্তি, যার দ্বারা সঠিক সময়ে আনন্দ ও বেদনার অনুভূতিবোধ জন্মায়।

এটি শিক্ষার্থীর দেহে ও মনে সকল সুন্দর ও অন্তর্নিহিত শক্তিকে বিকশিত করে তোলে।’ দার্শনিক এরিস্টটলের মতেÑ ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা দেহ-মনের সুষম এবং পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তির জীবনের প্রকৃত মাধুর্য ও পরম সত্য উপলব্ধিতে সহায়তা করে’। শিক্ষাবিদ কমেনিয়াসের মতেÑ ‘শিক্ষা হচ্ছে মানুষের নৈতিক উন্নতির সাহায্যে ইহলোক ও পরলোকের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি। শিক্ষার সাহায্যে মানুষ নিজেকে ও বিশ্বকে জানতে পারে।’  
শিক্ষা ও নৈতিকতা, মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো। মানবিক নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষা কুশিক্ষার নামান্তর। যা মানুষকে পশুর চেয়েও নি¤œস্তরে নামিয়ে ফেলে। আর মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের মযার্দায় অধিষ্ঠিত রাখে। শিল্পের জন্য শিল্প যেমন জীবনের প্রয়োজন মেটায় না, তেমনি শিক্ষার জন্য শিক্ষা মানুষকে মনুষ্যত্ব নিয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করে না। স্তরভিত্তিক জীবনের বিকাশে এ শিক্ষা কোনো কাজে আসে না। 
যে শিক্ষা মানুষকে অন্যের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে না, যে শিক্ষা মানুষকে ভীরুতাকে জয় করতে শেখায় না, যে শিক্ষা জীবনে ও মরণে আলো দিতে পারে না, যে শিক্ষা মানুষকে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে স্বার্থপরতায় অন্ধ করে তোলে, যে শিক্ষা মানুষকে উগ্র ইন্দ্রিয়সুখের জন্য হত্যার কারণ তৈরি করে, যে শিক্ষা সতীর্থকে নির্মমভাবে খুন করতে উদ্বুদ্ধ করে, যে শিক্ষা ভালোবাসার কবর রচনা করে ঘৃণাকে উসকে দিয়ে হিংসা হানাহানির প্রসার ঘটায়, যে শিক্ষা ঐক্যের পরিবর্তে শুধু বিভেদই বাড়ায়, আজ সর্বত্রই যেন সে শিক্ষার প্রচার ও প্রসার। এই হচ্ছে বস্তুবাদী শিক্ষার দৃষ্টান্ত!
মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষাও বাস্তববাদী শিক্ষায় পরিণত হতে পারে, যদি সে নৈতিকতার প্রয়োগকে পাশ কাটিয়ে চলা হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানবিক নৈতিকতাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষাও অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি তা বাস্তবে অনুসৃত না হয়। মানবিক নৈতিকতার শিকড় হচ্ছে ‘কথা ও কাজে মিল’ রাখা। কথা ও কাজে মিল থাকা বিশ্বাস বা ইমানের অন্যতম প্রকাশ। কথা ও কাজে যার মিল নেই, তার ভেতরে সত্যিকার অর্থে কোনো মানবিক নৈতিকতা নেই। শিক্ষা ও নৈতিকতা উভয়টির জন্যই অনিবার্য প্রয়োজন শিক্ষক। 
শিক্ষক ব্যতীত শিক্ষা ও নৈতিকতা উভয়ই অচল। তাই শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রশ্নে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। শিক্ষক, শিক্ষা ও নৈতিকতাÑ এই ত্রিভুজ দিয়েই গড়ে ওঠে কোনো জাতির সভ্যতার শিখর। পৃথিবীর সকল সমাজে এই তিন উপাদানই ছিল সভ্যতা গড়ার মূল হাতিয়ার। শিক্ষক, শিক্ষা ও নৈতিকতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন মত বিকশিত হয়েছে। 
নৈতিকতা শব্দটির ইংরেজি গড়ৎধষরঃু। যার অর্থ হলো ভদ্রতা, চরিত্র, উত্তম আচরণ। এটি মূলত ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক, আসল-নকলের পার্থক্যকারী। নৈতিকতার উদাহরণ হলোÑ ‘আমার উচিত অন্যের সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করা, যেমনটা আমি নিজে আরেকজনের নিকট থেকে আশা করি।’ নৈতিকতাকে ন্যায্যতা কিংবা সঠিকতাও বলা যেতে পারে। ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায়, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলাও নৈতিকতা। অপরদিকে, অনৈতিকতা হলো নৈতিকতার বিপরীত। ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায়, সাদাকে সাদা কিংবা কালোকে কালো বলতে না পারা- যা অজ্ঞতা, অসচেতনতা, অবিশ্বাস, উদাসীনতারই বহির্প্রকাশ।

নৈতিকতার অভাবে দেশ ও জাতির উন্নতি ব্যাহত হয়। যোগ্য ব্যক্তিরা যোগ্য স্থানে পৌঁছাতে পারে না। অযোগ্যদের আস্ফালন বৃদ্ধি পায়। যোগ্য ব্যক্তিরা হীনম্মন্যতায় ভোগে। সমাজ তথা দেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। নৈতিক শিক্ষা হতে হবে পরিবার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত। শিশুদের ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। নৈতিক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে সৌজন্যবোধ, গুণাবলির বিকাশ, ন¤্রতা, শৃঙ্খলতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহানুভূতি, দয়া-মায়া, সাহসিকতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও অন্যান্য। নৈতিক শিক্ষাই মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের গভীর অনুভূতি তৈরি করতে পারে। দেশের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তুলতে গেলে প্রত্যেকের মধ্যে ব্যক্তিগত মূল্যবোধ গড়ে তোলাও জরুরি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং একটি অলিখিত বিষয়। র‌্যাগিংয়ের বিধান কোথাও নেই। তথাপি নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এই টার্মের সঙ্গে পরিচিত। ভর্তি পরীক্ষার সময় থেকে শুরু হয়ে ক্লাস শুরুর পরেও অর্থাৎ ১ম সেমিস্টার পর্যন্ত র‌্যাগিং নামক অপসংস্কৃতির চর্চা দেখা যায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। উল্লেখ্য, গ্রামের সহজ সরল ছেলেমেয়েরা বেশি পরিমাণে র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে থাকে। র‌্যাগিং কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়, কিভাবে এ অপসংস্কৃতির মোড়ক থেকে নতুন ছেলেমেয়েদের দূরে রাখা যায়, সে বিষয়ে প্রত্যেককেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন ও মানবিক গুণসম্পন্ন হতে হবে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষাকে এমনভাবে যোগ করতে হবে, যাতে নৈতিক মূল্যবোধের বার্তা শিক্ষার্থীদের নিকট আরও সহজ, সরল ও আকর্ষণীয় উপায়ে পৌঁছানো যেতে পারে। এর জন্য ভালো বই, নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, ও অন্যান্য মাধ্যমও ব্যবহার করা যেতে পারে। মানুষের জীবনে নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, ও মর্যাদা প্রদানের জ্ঞান থাকলে তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমাজ এমনকি দেশেও শান্তি বিরাজমান থাকবে।
বর্তমান সমাজে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা তাদের মনে মূল্যবোধ স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে অন্যের সঙ্গে আচরণ করতে হয়, তাও শেখাতে সাহায্য করতে পারে। তাদের নৈতিক শিক্ষার মানে জানা ও বুঝতে পারাটাও কিন্তু ততটাই জরুরি। ভোগবাদী বিশ্বে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে প্রতিনিয়ত। অথচ অনাগত ভবিষ্যৎকে সফল ও সুন্দর করে তুলতে নৈতিকতার চর্চা ছাড়া বিকল্প নেই। কেবল শিক্ষাই পারে যথার্থ নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে।

লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়

×