ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গুজবের জবাব উন্নয়ন

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:৪১, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

গুজবের জবাব উন্নয়ন

উন্নয়নের অদম্য অগ্রযাত্রায় বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের অবয়ব

উন্নয়নের অদম্য অগ্রযাত্রায় বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের অবয়ব। বর্তমান সরকারের আমলে দেশে সংঘটিত হয়েছে আমূল পরিবর্তন। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন থেকে শুরু করে ডিজিটালাইজেশন- সবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নমুখী বহুবিধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বিগত চৌদ্দ বছরে দেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকার নিরলসভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
দারিদ্র্যের হার হ্রাসে সরকারের কার্যক্রম প্রশংসনীয়। দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২০.৫%-এ। বিগত কয়েক বছরে জনগণের গড় আয়ুতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। ২০২২ সালে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩.৬ বছরে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার এখন ১৬.৬ শতাংশ। এর ফলে শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের সাফল্য বিস্ময়কর। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ৩২,৫৬২ মেগাওয়াট।

অসম্ভব মনে হলেও সত্য, বাংলাদেশ আইসিটি খাতে রফতানি শুরু করেছে। ২০২১ সালে আইসিটি খাতে রফতানি থেকে আয় হয়েছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে। দেশের প্রায় শতভাগ জনগণ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করেছে সরকার। এ পর্যন্ত রফতানি আয় হয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। এ বছর দেশের খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ৫ কোটি মেট্রিক টন।

ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ৪র্থ। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ৩য়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সরকারের সাফল্যের আরেক মাইলফলক হচ্ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ। ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ৩৬০ কোটি ডলার। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ। বিগত কয়েক বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার অবিশ্বাস্য। ২০২২ সালে এসে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলারের কাছাকাছি।

জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ৩২তম নিউক্লিয়ার নেশন হিসেবে বিশ্ব পরমাণু ক্লাবে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের মতো এগিয়ে নিতে নেওয়া হয়েছে ১০০ বছরের ‘ডেলটা প্ল্যান’। প্রতিটি বাঙালির স্বপ্নের সেতু ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’ উদ্বোধন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু টানেলেরও কাজ শেষের পথে।

সারাদেশে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে ৩০ রকমের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। বিগত ১০ বছরে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭৮%, যেটি বিশ্বে প্রথম। ২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭.১৫%-এ।
করোনাভাইরাসের কারণে যোগাযোগ, যাতায়াত, আমদানি থেকে শুরু করে সবকিছুই প্রায় বন্ধ ছিল। করোনা যেতে পারেনি, শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। তার পরে আবার স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা।

আর যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্মুক্ত হয় তখন আমদানি করা, পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার জন্য ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থের বাড়তি জোগান ও রিজার্ভ থেকেই দিতে হচ্ছে। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম সারাবিশ্বে বেড়ে গেছে। যে জিনিসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে তা নয়, তার সঙ্গে পরিবহন খরচও বেড়েছে।

ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট সংকটগুলো আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিতে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। এটি কোভিডসৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের প্রচেষ্টা এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের পথে যোগ করেছে নতুন চ্যালেঞ্জ। নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা। বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইনস কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ভুট্টা রফতানিকারক দেশ হতে যাচ্ছে ইউক্রেন। গম রফতানিতে দেশটির অবস্থান চতুর্থ।  সে দেশের পণ্য রপ্তানি হয় মূলত কৃষ্ণসাগরের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে, যা ইতোমধ্যে ইউক্রেনে হামলার দরুন বাধার সম্মুখীন হয়েছে। কৃষ্ণসাগর দিয়ে চলাচলকৃত বাণিজ্যিক জাহাজে বাধার সম্মুখীন হওয়ায় এ পথ দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করা খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেছে।

করোনা মহামারির কারণে এর মধ্যেই বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। নতুন করে খাদ্যের দাম বাড়ায় সংকট আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।  ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৩৫ শতাংশ চাহিদা মেটে রাশিয়া থেকে। চলমান সংঘাতের কারণে রাশিয়ার ওপর আরোপকৃত নিষেধাজ্ঞার ফলে ইউক্রেন ও বেলারুশের মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় গ্যাসের দামও বাড়ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের কারণে বড় সংকটে পড়েছে জ্বালানি তেলের বাজারও।

চলমান সংঘাতের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে নানাভাবে জড়িত থাকা পশ্চিমা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো নানাবিধ সংকটে পড়েছে ইতোমধ্যে। ইউক্রেনে হামলার প্রভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইউরোপের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফার বিশাল অংশ আসে রাশিয়া থেকে। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে রাশিয়ার ঋণ নেওয়ার পরিমাণও কম নয়।

ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার ব্যাংকগুলো থেকে দেশটিতে যথাক্রমে ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ও ১৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যত তড়িঘড়ি করে সংঘটিত হয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব এত দ্রুত উপলব্ধি করা হয়তো যাবে না। এর প্রভাব পড়বে ধীওে, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনগণের সাড়া না পেয়ে জামায়াত-বিএনপি এখন পাগলের প্রলাপ বকছে। দেশবাসী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি আস্থাশীল। অথচ বিএনপি নেতারা বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন ও গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে লাগাতারভাবে চিরাচরিত মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে বিএনপি দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জনমনে ভীতির সঞ্চার এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে।

বিএনপি কখনোই তাদের হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ মুছতে পারেনি। মুক্ত হতে পারেনি রক্তের নেশা থেকে। হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবৈধ ও অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল করে ইতিহাসের নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন, রক্তের স্রোত প্রবাহিত করে দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে চিরতরে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালান। নির্বাচনের ঠিক আগে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে ‘প্রোপাগান্ডা স্কোয়াড’ তৈরি করে গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানোর যুদ্ধে লিপ্ত বিএনপি-জামায়াত সমর্থক গোষ্ঠী।
বর্তমান সরকারের সময় সড়কপথ, নৌপথ, আকাশপথের ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়েছে। মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হচ্ছে। এসবের জন্য বিপুল টাকা ব্যয় হচ্ছে। রিজার্ভের টাকা তো লাগবেই, এটা বাস্তবতা। মানুষের যোগাযোগ যাতে আরও সহজ হয়, পরিবহন চলাচল যাতে আরও সহজ হয় তারই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সড়কপথ, নৌপথ ও আকাশপথে ব্যাপক উন্নয়ন চলছে। বেশিরভাগ উন্নয়ন কাজ হচ্ছে নিজেদের অর্থায়নে।

দেশের কল্যাণে, জনগণ ও দেশের জন্যই রিজার্ভের টাকা ব্যয় হয়েছে। সরকার এক টাকাও অপচয় করেনি। অথচ রিজার্ভের টাকা নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে বিরোধী দল। করোনা শেষে বিনিয়োগ, ইন্ডাস্ট্রি তৈরি, এমনকি চাষাবাদের জন্য যে বিভিন্ন যন্ত্র ক্রয় সেগুলোর জন্য টাকা খরচ করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন কিনতে হয়েছে। যখন মাত্র রিসার্চ হচ্ছে তখনই ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা জমা দিয়েছিল বাংলাদেশ। ভ্যাকসিন আমদানি করতে হয়েছে।
যারা দেশের বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগ করে বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে চায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। বৈশি^ক সংকট মোকাবিলায় শত্রুদের চিহ্নিত করে দেশপ্রেমিক জনগণকে একত্রিত হয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করতে হবে একযোগে।
লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

×