ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

পুনর্বাসিতদের প্রশিক্ষণ

এ এইচ এম নোমান

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ৪ ডিসেম্বর ২০২২

পুনর্বাসিতদের প্রশিক্ষণ

.

অবকাঠামো নির্মাণ উন্নয়নে রড, সিমেন্ট, বালু সমেত ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইঞ্জিনিয়ারিং যেমন প্রয়োজন, তেমনি মানবসম্পদ উন্নয়নে মা-মাটি মানুষের মালিকানার টেকসই উন্নয়নে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, কর্মসংস্থান, পরিবেশ গড়তে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সমভাবে আবশ্যক। এ দুটোর সমীকরণ করে একত্রে হাঁটাই হলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, পায়রাবন্দর, দোহাজারী-রামু, রূপগঞ্জের ওয়াসা প্রকল্পসহ দেশে রেল ও অবকাঠামো উন্নয়নে মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কর্মযজ্ঞের বাস্তব কিছু কথামালা নিয়ে এই লেখা। এসব প্রকল্পের সিংহভাগ সময়ই দেশ-বৈশি^ক করোনা সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে। সব সতর্কতা মেনে সংশ্লিষ্টরা পুরোদমে কাজ চালু রেখেছেন। এ যেন গেরিলা কায়দায় যুদ্ধের মধ্যেও আরেক যুদ্ধ জয়। পায়রাবন্দর প্রকল্পের একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আয় ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নির্দেশনা দিয়ে তাঁর উদ্যোগেই ৪২০০ নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২৩টি ট্রেডে ৩ সপ্তাহ থেকে ৬ মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। স্কুল, পুকুর, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পানি সরবরাহসহ ৩৪২৩টি পাকা ঘর করে দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। মানবসম্পদ রচনায় টেকসই উন্নয়নে ‘যে মা পদ্মা সেতু করতে পারেন সে মা স্বপ্ন মাও গড়তে পারেন।’ সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যেন স্বপ্ন মা রানি। বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অজেয়কে জয় করতে জানে, পরাজয় জানে না। আমাদের স্বপ্নকন্যা শেখ হাসিনা ‘পদ্মা সেতু নিজ টাকায় করব’ ঘোষণায়, রেল সেতু সংযোগ রচনায়, ষড়যন্ত্রকারীদের দুর্নীতির দুর্নাম রটনার বেড়াজাল ভেঙ্গে দিলেন। অর্থ ও প্রভাব লগ্নীকারী বিশ^ব্যাংকের ঋণ চুক্তি বাতিলকে আশীর্বাদ হিসেবে চ্যালেঞ্জ নিলেন। স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে যাওয়ার এক অনন্য সমুজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।
বৈষম্য সৃষ্টিকারী পাবলিক প্রাইভেটের সঙ্গে ‘পুওর’ (ক্ষতিগ্রস্তদের) যোগ করে পার্টনারশিপ (পিপিপিপি) করা যায় কি? বৈষম্য গ্যাপ পূরণে সুষম বণ্টন, সাম্য সৃষ্টির পথ-ঘাট সন্ধানে সরকার কাজ করছে। এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জাইকার পুনর্বাসন প্রকল্পে ভিন্ন ভিন্ন সেফগার্ড পলিসি যে পর্যায় আছে তা থেকে আরও অবনতির পর্যায়ে যাতে না যায়। ভালনারেবল/ঝুঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা মতামত, বক্তব্যে সরকারের কাছে তা অন্তর্ভুক্তির জন্য আবদেন জানান। স্থানান্তরের মানসিক যাতনা মা-বাবা, দাদা-দাদির কবর, শ্মশান, মসজিদ, পরিবেশ, বাজার, হাট, ঘাট, মাঠ, খাল, পুকুর হারানোর বেদনার মূল্য প্রদানের কথা পলিসিতে নেই। এরকম বিষয়সমূহ বিবেচনায় এনে তা বাস্তবায়নের জন্য দেশজ উপযোগী পিপিপিপি জাতীয় পুনর্বাসন নীতিমালা প্রণয়ন করলেই বৈষম্য নিরসনের পথ রচনা হবে। যেমনটি টুঙ্গিপাড়ার বটম লাইনিং স্বপ্ন মা নন্দিতা ম-ল, চাটখিলের সাবিনা ও মুজিবনগরের স্বপ্ন মা সালমারা প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

রেলের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, রেলে যাতায়াতে আমরা যদি ফ্রি পাস পাই তাহলে তারা পাবে না কেন? আমাদের দেশ তো আমাদেরই সাজাতে হবে।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পটি দুই ফেজে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১০ জেলার ওপর দিয়ে মোট ১৭২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পুরুষ ৩০৮ জন ও মহিলা ২৪১ জন এবং ১ জন তৃতীয় লিঙ্গসহ মোট ৫৫০ ক্ষতিগ্রস্তকে প্রশিক্ষণ ও সিড মানি প্রদান করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বর্তমান অবস্থানে মোট টাইটেলড ইপি ২১,৮৫২ জন ও ১,৮৩৩ একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। বহুবিধ স্টেকহোল্ডার যেমন রেল ও ভূমি মন্ত্রণালয়, ল্যান্ড একুইজিশন জেলা অফিস, স্থানীয় সরকার, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ইত্যাদির সমন্বয়ে এবং বিশাল কর্ম এলাকায় পুনর্বাসনের মতো কাজ এক জটিল ও কঠিন কর্মমহাযজ্ঞ। ২য় ফেজে প্রশিক্ষণ প্রস্তুতি চলছে। প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্টস (সিএসসি), বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রেলওয়ে (বিআর) প্রশিক্ষণ শেষে আয় জীবিকা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীকে থোক ১৬ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করে থাকে এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে পুনর্বাসন পরিকল্পনা (আরপি) সূত্র ধরে তাদের বিকল্প আয় এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য পেশাগত দক্ষতা ও আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ও রপ্ত জ্ঞান এবং রেলওয়ে থেকে প্রাপ্ত অনুদান এ দুয়ের সমন্বয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। মহিলা খানাপ্রধান এবং অসচ্ছল পরিবার, সহায়হীন অতিবৃদ্ধ খানাপ্রধান, দরিদ্র পরিবার, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবার, তৃতীয় লিঙ্গসহ নারী ও পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে অক্ষম ক্ষতিগ্রস্তদের বিআর কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে জরিপের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী নির্বাচন করা হয়। মোট ১২টি বিষয়ে যেমন ওয়েল্ডিং ইলেকট্রিশিয়ান/ইলেকট্রনিক্স মোবাইল সার্ভিসিং অ্যান্ড রিপেয়ারিং, মোটরসাইকেল মেরামত, কম্পিউটার বেসিক, কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত, বিউটি পার্লার, ড্রাইভিং ইত্যাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সিএসসি এবং বিআরসহ প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, উপকরণ, লজিস্টিক, খামার নির্বাচন, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল/মডিউল ও ব্যবহারিক মাঠে হাতে-কলমে শিক্ষা, সার্টিফিকেট, সিড মানি প্রদান ব্যবস্থা, কমিউনিটি মিটিং ইত্যাদি কাজ দক্ষতার সঙ্গে করা হয়।

প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত উপকরণসমূহ- মাল্টিমিডিয়া, ল্যাপটপ, ফ্লিপচার্ট, হ্যান্ডআউট, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ফ্যাসিয়াল ও টয়লেট টিস্যু। জেলা/উপজেলা, স্থানীয় ভাষা, স্থান-কাল-পাত্রভেদে অংশগ্রহণমূলক, প্রশ্নোত্তর, দলীয় কাজ, রোলপ্লে, বক্তৃতা, গেম, মুক্তচিন্তার ঝড়, অভিনয়, খামার ভিজিট, হাতে-কলমে শিক্ষা হলো প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। ভেন্যু, পানি, ওয়াশরুম, বসার ব্যবস্থাপনা, খাবার, লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজনমাফিক দেওয়া হয়। ট্রেড/বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ ও দক্ষতাসম্পন্ন সরকারি/বেসরকারি প্রশিক্ষক এবং খামারিরা এর কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। ডরপ ট্রেনিং সেল কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নীতিমালা, ম্যানুয়াল ইত্যাদি তৈরি করেছে। সিএসসি ও বিআর কর্তৃপক্ষ প্রসেস মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন করেন। দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন প্রশিক্ষণ যুক্ত করা দরকার, যাতে প্রশিক্ষণার্থীদের মুক্তমন ও স্বাবলম্বী চেতনা গ্রথিত হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের মূল্যায়নে উঠে আসে প্রশিক্ষণকাল ১৮ দিনের স্থলে ১ মাস, ঝুঁকিপূর্ণদের রেল ও সড়ক চলাচলের ফ্রি/পাস ও রেলস্টেশনে দোকান বরাদ্দে তাদের/ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা রেলস্টেশনে সাঁটিয়ে রাখা।
জাতিসংঘ সুষম টেকসই উন্নয়নে এসডিজির এন্ডিং পভার্টি ১ নং, ইনোভেশন অ্যান্ড ইনফ্রাকস্ট্রাচার ৯ নং এবং ইকুইটি ১০ এজেন্ডার কার্যকর পথপরিক্রমা সরকারের বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার বিশেষ করে গরিবদের মূল অর্থনৈতিক মুক্তি স্রোতে আনার প্রয়াসে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্টদের জন্য প্রণোদনা-অংশীদারি গ্যাসলাইন, ওয়াসা পানি লাইনে ফ্রি সংযোগ, রেললাইন স্থাপনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেক ঝুঁকিপূর্ণ খানাপ্রধানকে সড়ক ও সেতুর জন্য পরিবহন/যাতায়াত ফ্রি টিকিট/ফ্রি পাস এবং টোল প্লাজার কিয়ৎ শতাংশ আয় বাৎসরিকভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদান, সংযুক্ত সদস্যদের প্রত্যেককে এককালীন থোক, ত্যাগ দান ও শক বিয়ারিং প্রণোদনা প্রদান, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, ভার্সিটিতে পড়ুয়াদের মানসিক শক্তি শিফটিং ভাতা, মাতৃত্বকালীন/অন্তঃসত্ত্বা নারীদের এককালীন স্বস্তি ও কোপিং ভাতা ইত্যাদি সহায়তা প্রদান দরকার। আমাদের সুজন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম পদ্মাপাড়ের পাচ্চর এলাকায় চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে জমিজমা, ভূমি, ওয়ারিশ, ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সেবাদান কর্মে জটিল প্রকল্প কর্মযজ্ঞে রেল, সিএসসি ও ডরপের যৌথ আয়োজন ও প্রশিক্ষণের সফলতার প্রশংসা করেন। পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে জাহাজ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, ওয়াসা কর্তৃপক্ষসহ সকলেই অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে পুনর্বাসন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রশিক্ষণের সমান গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, ডরপ,
গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার-২০১৩ বিজয়ী
[email protected]

 

 

×