ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তঝরা বিজয় ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ৪ ডিসেম্বর ২০২২

রক্তঝরা বিজয় ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

.

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এ মাসের ১৬ তারিখে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে রচিত হয় সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায়। ৩০ লাখ শহীদ আর অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ বিজয়। তাই মহান এ মাস উদ্্যাপনে জাতীয় কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। প্রথমদিন ১ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বাঙালির সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয় এ মাসে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর জল, স্থাল আর আকাশপথে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে। এ মাসে সুদীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা আর অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয় বীর বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও ডিসেম্বরে এসে পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের শেষ করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে তৎপর হয়। তালিকা করে একে একে হত্যা করা হয় দেশের খ্যাতিমান শিক্ষক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের। তা সত্ত্বেও তারা বাঙালিদের দমাতে পারেনি।
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি   সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যেখান থেকে ৭ মার্চ স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,’ বলে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেখানেই পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী। এর মধ্য দিয়ে রচিত হয় নতুন ইতিহাস। বাংলার আকাশে উদিত হয় নতুন সূর্য। উল্লেখ্য, সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল অনেক আগেই। যেমন- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদি। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক নিরস্ত্র জনতার ওপর অতর্কিতে আক্রমণ শুরু করে।

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ জেলে আটক রাখা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার। পরে বৈদ্যনাথতলাকেই নামকরণ করা হয় মুজিবনগর হিসেবে। যে সরকারের প্রধান বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসনমন্ত্রী করে গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। এদিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও অনুমোদন হয়।
আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ দিনাজপুরের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। একাত্তরের ১৭ এপ্রিলের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্য নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সকাল ৯টার দিকে বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছান। গ্রামবাসীর পাশাপাশি দেশী-বিদেশী শতাধিক সাংবাদিক আসেন। তাদের মধ্যে ছিলেন-ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালি ও পিটার হেস। বহু প্রতীক্ষিত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ১১টায়। মেজর আবু উসমান চৌধুরীর পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনসারের একটি ছোট্ট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়।

তাজউদ্দীনের ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। এরই পথপরিক্রমায় পরের দিন দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদমাধ্যমে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের এই সংবাদ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক সূচনা বা আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ হিসেবে দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, যে নামেই বলি না কেন এই সরকারটি গঠিত হয়েছিল ১০ এপ্রিল, ১৯৭১, কলকাতায়। ওই সময়ে গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যে কয়েকজন সদস্য কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন তাদের সম্মতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয়েছিল যুদ্ধকালীন সরকার তথা মুজিবনগর সরকার।

তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করা হয়; যার আইনগত দিকগুলো ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ঠিক করে ঘোষণাপত্রটি চূড়ান্ত করেছিলেন।
আসা যাক মুক্তিযুদ্ধের অপারেশনাল দিক নিয়ে, যেখানে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যদের সকল ধরনের সমর্থন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারতীয় সৈন্যরা শুধু আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংই দেয়নি, যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধের কৌশল হিসাবে সারাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল এবং প্রতিটি সেক্টরের দায়িত্ব একেকজন কোম্পানি কমান্ডারকে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এমএজি ওসমানীর নেতৃত্বে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশের অভ্যন্তরে কাদেরীয়া বাহিনী টাঙ্গাইলের মধুপুর জঙ্গলে তাদের আস্তানা গেড়ে বসে। সেখান থেকে গেরিলাযুদ্ধে লিপ্ত হয়, যা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। চারদিকে আক্রমণের মধ্যে বর্তমানে শেরপুর জেলার কামালপুরের অপারেশন ছিল ভয়াবহ, যেখানে বহু যোদ্ধা আত্মাহুতি দিয়েছিল। যার মধ্যে আমার ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্বকিদ্যালয়ের সহপাঠী নাজমূল আহসানের নাম উল্লেখযোগ্য- যার নামে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ করা হয়। আমার অনেক নিরীহ বিহারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীকেও প্রাণ দিতে হয়েছে, যাদের আর পড়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থী জীবন, মেঘালয়ের এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়, তারপর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের বর্ণনা বলে শেষ করার নয়।
বাংলাদেশ থেকে ১ কোটি শরণার্থী ভারতের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, যার মধ্যে ত্রিপুরার বিশ্রামগড় অন্যতম। যুদ্ধের সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারগুলো ছিল টার্গেট, বিশেষত রাজাকার-আলবদর-পাকসেনাদের কাছে। তারপরও আমরা তো স্বাধীন দেশের মাটিতে বেঁচে আছি। বেঁচে থাকব বঙ্গবন্ধুর এই বাংলায় মাথা উঁচু করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে। বিজয়ের ডিসেম্বর মাসটি তাদের কাছে বেদনাবিধুর, যারা মুক্তিযুদ্ধে তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে, বিশেষত বাবা, মা, ভাইবোনসহ কাছের মানুষদের। সার্থক হোক দুই হাজার বাইশের বিজয় দিবস।
লেখক : গবেষক ও ডিন
সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

 

×