ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শীতে খেজুরের রস-পিঠাপুলি

শতদল বড়ুয়া

প্রকাশিত: ২১:৪১, ২৫ নভেম্বর ২০২২

শীতে খেজুরের রস-পিঠাপুলি

.

খেজুর রস আর ভাপা পিঠা- এই জুটির নেই তুলনা। ভাপা পিঠাকে অঞ্চল ভেদে শীতপিঠা, ধুপিপিঠা বা ধুঁই পিঠাও বলে। শীতকালে তৈরি হয় বলে ‘শীতপিঠা’, গরম পানির ভাপে তৈরি বলে ‘ভাপা পিঠা’ বলি আমরা। আঞ্চলিক ভাষায় ‘ধুই পিঠা’কে প্রকৃত শুদ্ধ ভাষায় বলে ‘ধুপ পিঠা’। ধুপির আভিধানিক অর্থ হলো- ক্ষুদ্র স্তূপ, রাশি, চূর্ণ বস্তুর রাশি, ঢিপি ইত্যাদি। ভাপা পিঠা চালের গুঁড়া, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির সংমিশ্রণে আগুনের তাপে প্রস্তুত পিঠা বিশেষ। ভাপা পিঠাকে আভিধানিক অর্থে বলা যেতে পারে বাষ্পের উত্তাপে সিদ্ধ করা পিঠা। যাক আমি ভুল-শুদ্ধ নিয়ে প্যাঁচাল বাড়াতে চাই না। এ পিঠাকে যে যার মতো করে ভাবতে পারেন।
শুধু একটি কারণে উল্লিখিত বিষয়গুলোর অবতারণা করেছি। আমার নিজের সমস্যা বিষয়ে ভেবে ভেবে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি। স্থানীয় হিলভিউ আবাসিক এলাকা দিয়ে যাচ্ছি বিবিরহাট বিদ্যুৎ অফিসে। রেললাইন পেরুতেই দেখা হলো আমার এক পরম আত্মীয়ের সঙ্গে। তিনি সেটেল কুমিল্লা টাউনে। শীত পিঠা খাচ্ছিলেন রেললাইনের পাশে ঝুপড়িতে বসে। তার অনুরোধে আমিও শীতপিঠা দুইটা খেলাম। পেট ভরে খেতে হলে আমার দশ-বারোটা লাগবে।
আত্মীয়কে বললাম- পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় এসেছে আমরা বলি- কিন্তু না, এক অর্থে কথাটি হয়তো বা সত্যি নয়। আবার বলি পৃথিবীটা ছোট হয়ে এসেছে। আত্মীয়কে বললাম, এই পিঠাগুলো ছোট হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে টপাটপ পাঁচটা পিঠা ডান হাতে তুলে নিলাম। পিঠা বিক্রেতা পিঠা না বানিয়ে হা করে আমাদের কথা শুনছিল। এক কৃষি কর্মকর্তাও আমাদের সঙ্গে কথা শেয়ার করল। তিনি বললেন, বাঙালি জাতির নানা ঐতিহ্যের মধ্যে শীতপিঠা অন্যতম। শীতপিঠার সঙ্গে খেজুর রস থাকলে আর কথা নেই। শীতকালে খেজুরের রস পাওয়া যায়। খেজুর রসের সঙ্গে ভাপা বা শীতপিঠার একটা যোগসূত্র রয়েছে বিধায় ভাপা পিঠা শীত মৌসুমে বানানো হয়। সেই বহুকাল আগের কথা, তখনও খেজুর রসের যথেষ্ট কদর ছিল। আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুরপাড়ে একেবারে পানি সংলগ্ন একটা খেজুর গাছ ছিল। পড়ন্ত বিকেলে গাছ কেটে মাটির পাতিল ঝুলিয়ে দিয়ে সকাল বেলায় গিয়ে দেখা গেল পাতিল পূর্ণ হয়ে রস গাছের নিচে জমা হয়ে রয়েছে।
একদিন পাতিল না দিয়ে সিলভারের বড় কলসি ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম। মধ্যরাতে গিয়ে দেখি সেটিও পূর্ণ হয়ে গেছে। কলসি থেকে রস নিয়ে আবার কলসি ঝুলিয়ে দিয়েছি। সকালে গিয়ে দেখি তাও রস আধা কলসি হয়েছে। খেজুর রস সংগ্রহ করার এক ধরনের কৌশল রয়েছে। কৌশল না জানলে গাছ থেকে রস পাওয়া যাবে না। এমনকি গাছও মরে যেতে পারে। শীত মৌসুমের শুরুতে রস সংগ্রহের জন্যে খেজুর গাছ কেটে তৈরি করতে হয়। প্রায় সপ্তাহখানেক পর যথা নিয়মে গাছ কেটে বাঁশের টুকরো আটকিয়ে দিতে হয়। এটিকে আমরা ‘তোতা’ বলতাম। বিশেষ কৌশলে এগুলো করতে হয়। পাতিলের রশি আটকানোর জন্য কাটার স্থাানের দুইপাশে দুইটা শক্ত বাঁশের খুঁটি গভীরে গেড়ে দিতে হয়। প্রতিদিন খেজুর গাছ কাটার নিয়ম নেই। একদিন পর একদিন গাছ কাটতে হয়। খেজুর গাছের বংশবৃদ্ধি তেমন একটা চোখে পড়ে না। সীতাকুন্ড-মিরসরাইয়ে এখনো খেজুর গাছ দৃশ্যমান।
মিরসরাইয়ে দমদমা একটা প্রসিদ্ধ গ্রাম। বৌদ্ধ অধ্যুষিত এ গ্রামে বেড়াতে গিয়েছি শীতকালে। রাতে সহপাঠীরা আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হলো। যেই ঘরে যাই সকলে শীতপিঠা ও খেজুরের রস খেতে দিচ্ছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় রাতটি খুব মজা করে উপভোগ করলাম। এ গ্রামে মানিক বড়ুয়া নামে এক আইনজীবী আছে। তার সঙ্গে দেখা। চট্টগ্রাম আদালত ভবনে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। সে জানালো- দমদমা গ্রামের একটা ঐতিহ্য আছে, সেটি হলো খেজুর রসের সঙ্গে শীতপিঠা।
প্রায় ২৫-৩০ বছর পর আবার সেই গ্রামে গেলাম। আগের সেই ঐতিহ্য এখন তেমন একটা নেই দুটি কারণে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে গ্রামের অনেকে দিশাহারা, খেজুর রস মহার্ঘ্য। খেজুরের রস পেতে হলে কয়েকদিন আগে বিক্রেতাকে বলে রাখতে হয়। দামের কোনো কথা নেই, রস পেলেই হলো। খেজুর রসের পায়েস আরেক মুখরোচক খাবার। কাকন চালের পায়েস গরম গরম যারা খেয়েছে তারাই বুঝতে পারবে কি মজাদার খাবার। তাছাড়া রস দিয়ে আরও নানা রকমের খাদ্য তৈরি করে গৃহিণীরা। ভাপাপিঠা ও খেজুরের রস সামাজিক ঐতিহ্যের একটা অংশ। কোনো কোনো সম্প্রদায়ে মেয়ে বিয়ে দিলে প্রথম বছর শীতকালে শীতপিঠা ও খেজুরের রস দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ভাদ্র মাসে তালেরপিঠা ও মধুভাত। মোট কথা- মৌসুমি সবকিছু এক বছরের মধ্যে দিতে হয়। না দিলে যে অসুবিধা হবে তা কিন্তু নয়। মেয়ের সুখ-শান্তির কথা ভেবে পরিবারের লোকেরা এ দায়িত্ব পালন করে।
নুন ধানের চাল শীতপিঠার জন্য বেশ উপযোগী। রসের জন্য ধারাবাহিক কোনো নিয়মনীতি নেই। রস যেহেতু মহার্ঘ্য। কিন্তু শীতপিঠা অনিবার্য। কর্তব্য সম্পাদনে কত কষ্ট করতে হচ্ছে মেয়েপক্ষকে এ ধরনের উদাহরণ আমাদের সমাজে অনেক।
শীতপিঠার প্রচলনেও যেন ভাটির টান পড়েছে। বাসা-বাড়ির পাশাপাশি বর্তমানে শীতপিঠাকে ব্যবসায়িক হিসেবে অনেকে নিয়েছে। রাস্তার পাশে বা বাজার কিংবা জনকোলাহল পূর্ণ এলাকায় গরম গরম শীতপিঠা বিক্রি করতে দেখা যায়। ক্রেতারও কিন্তু অভাব নেই। জমজমাট ব্যবসা চলছে মৌসুম হিসেবে শীতপিঠার।
এক লোক এসে পিঠা বিক্রেতাকে বলল- আমাকে পনেরোটি পিঠা দাও। বুঝতে পারলাম উনি শখের বসে পিঠা কিনছেন। সত্যি কথা বলতে কি আমিও একবার রাস্তায় বানানো চিতইপিঠা কিনে এনেছিলাম কাঁচা মরিচের চাটনি সমেত। বাসায় সবাই খেয়েছি। তবে এগুলো স্বাস্থ্যাসম্মত নয়। পেশাগত কারণে আমাকে বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়, ক্ষেত্র বিশেষে মনের অবাধ্য হয়ে উল্লিখিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলাতে হয়। অনেকে বলে বাঁচার জন্য খাচ্ছি। চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে নিজের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
খেজুর গাছের ব্যবহার বহুবিধ। খেজুর গাছের পাতা, খেজুর গাছ, খেজুরের রস ও খেজুর। খেজুরের পাতা দিয়ে পাকা, রসের ব্যবহার বিষয়ে আমরা সবাই জানি, খেজুর ধরলে সেটিও বেশ মজাদার। গাছের কথায় আসি—খেজুর গাছ কেটে পুকুরে ঘাট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কারণ এ গাছ সহজে নষ্ট হয় না, পচন ধরে না। রস সংগ্রহের জন্য গাছের নির্দিষ্ট জায়গার কাটা দাগগুলো ঘাটের থাক হিসেবে বেশ সুবিধাজনক।
খেজুর গাছের বংশবৃদ্ধি তেমন নেই। বৃক্ষ রোপণের খেজুর গাছ রোপণে পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে সরকারিভাবে। বৃক্ষ রোপণের সময় আমরা বিদেশী গাছ রোপণ করি। স্বদেশী গাছ পরিবেশবান্ধব। বিদেশী গাছ পরিবেশবান্ধব নয়। আমরা একটু লক্ষ্য করলে বুঝতে পারব এ গাছে কোনো পাখি বসে না, বাসা তৈরি করে না। এমনকি এ গাছের নিচে ঘাস পর্ষন্ত জন্মে না। স্বদেশী গাছে পাখির কলকাকলি আছে, গাছে বাসা তৈরি করে এবং এ গাছের নিচে ঘাসসহ অন্যান্য গাছ জন্মে। এ গাছে ফুল ফোটে, ফল ধরে। বিদেশী গাছে ফুল ফোটে না, ফল ধরে না। বিদেশী গাছ এবং স্বদেশী গাছের বংশবৃদ্ধি বিষয়ে একটু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র। বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আরও ভালো জ্ঞান রাখেন। তারা উল্লিখিত বিষয়গুলো গবেষণা করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলে পরিবেশ উপযোগী হবে। বিদেশী গাছের সঙ্গে খেজুর গাছের বিষয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবা উচিত। কারণ খেজুর গাছ ঐতিহ্যেরই একটা অংশ। দিন দিন খেজুর রস মহার্ঘ্য হওয়ার পেছনের কারণ একটাই। খেজুর গাছের বংশবৃদ্ধি নেই। তাই বলছি- আমাদের এখনই ভাবা উচিত, না হয় খেজুর গাছ ও খেজুর রস ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে।
লেখক : সাংবাদিক

 

 

×