ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষাক্রম নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ২৩ নভেম্বর ২০২২

শিক্ষাক্রম নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা

শিক্ষার প্রতিস্তরের নির্ধারিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে শিক্ষাক্রম

শিক্ষার প্রতিস্তরের নির্ধারিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীর কাছে বিষয়বস্তুর মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট অর্জনযোগ্য যোগ্যতা-জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, যোগ্যতা বা পড়সঢ়বঃবহপু- সুনির্দিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুর নানা রকম কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণির বাইরে শিক্ষকই পৌঁছে দেন। এ কারণে শিক্ষকই প্রধান ব্যক্তি, যিনি শিক্ষার্থীকে উক্ত যোগ্যতাগুলো অর্জনে প্রধানত শ্রেণিকক্ষে সহায়তা করেন। শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় অর্জনযোগ্য কতিপয় যোগ্যতার সমাহার। এই যোগ্যতাগুলো অর্জনের জন্যই বিষয়বস্তু এবং শিখন-শেখানো কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়। যোগ্যতার একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্তরের লেখাপড়া সমাপ্ত করে বাংলা ভাষায় লেখা গল্প, কবিতা, রচনা পড়ে বুঝতে পারবে এবং শুদ্ধ বাংলায় নিজের ভাষায় কোনো কিছু লিখতে পারবে।

এখানে দুটো যোগ্যতা একত্রে রয়েছে- একটি হলো ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম শ্রেণির পাঠ শেষ করে শিক্ষার্থী বাংলা ভাষায় লেখা গল্প, কবিতা, রচনা পড়ে বুঝতে পারবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- উক্ত পাঁচটি শ্রেণির পড়া শেষ করে শিক্ষার্থী নিজের ভাষায় যে কোনো কিছু (প্রশ্নের উত্তরসহ) লিখতে পারবে। এক কথায়- আমাদের বা যে কোনো দেশের শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য- সব শিক্ষার্থী তার মাতৃভাষায় লেখা কোনো কিছু পড়ে সহজে বুঝতে পারবে এবং নিজের ভাষায় (বইয়ের ভাষায় নয়) যে কোনো কিছু শুদ্ধভাবে লিখতে পারবে।
উল্লেখ্য, যে কোনো ভাষায় চারটি দক্ষতা রয়েছে- শোনা, বলা, পড়া এবং লেখা। বাংলা, ইংরেজি, অপর যে কোনো ভাষার এ চারটি দক্ষতা সব দেশের সব শিক্ষার্থীকে শিখতেই হয়। আমরা এই দুটি ভাষার সঙ্গে গণিতের দক্ষতা শেখার প্রয়োজনীয়তার কথা এখানে তুললাম না। যদিও আমরা সবাই জানি গণিত ছাড়া বিজ্ঞানের বা কমার্সের বিষয়গুলো শেখা সম্ভব হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, কম্পিউটার সায়েন্স বা পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা কৃষিবিজ্ঞানের সব রকম গবেষণায় প্রয়োজন হয় গণিতের দক্ষতার। মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোতে প্রয়োজন হয় মানব ইতিহাসের মান ও সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত জ্ঞান, ভাষা জ্ঞান এবং চারু-কারুসহ সব রকমের শিল্পচর্চা।

সব শিক্ষার্থীকে একদিকে যেমন ভালো মানের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হয়, তেমনি হতে হয় মানবিক মানুষ। সেজন্য ভালো মানের শিক্ষা দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা ও ইংরেজি ভাষা শেখার পাশাপাশি তাদের শেখাতে হবে শিক্ষার্থীরা যেন নিজেরাই শেখা ভাষা ব্যবহার করে আরও নানা বিষয়ের তথ্য, সংবাদ পড়ে নিজেদের জ্ঞান বাড়াতে পারে। এটাকে ইউনেস্কোর শিক্ষা কমিশন নাম দিয়েছিল- ‘Learning to Learn’. মনে রাখতে হবে- একটা পাঠ্যপুস্তক বা পাঁচ বছর সময়ের শ্রেণিকক্ষে পড়া আমাদের প্রয়োজনীয় সব বিষয় শেখাতে পারবে না। যে কোনো শিক্ষার্থী ভাষার দক্ষতাগুলো শিখে যেমন- সংবাদপত্র পড়তে পারবে, তেমনি নানারকম বিষয়ের বই-ম্যাগাজিন-লিফলেট-বুকলেট-প্রচার পুস্তিকা, গল্প, উপন্যাস, নাটক পড়ে নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

স্কুলের ও শিক্ষকের দায়িত্ব হলো- শিক্ষার্থীদের ভালো মানের ভাষা, দক্ষতা শিখিয়ে দেওয়া, যাতে তারা অর্জিত ভাষা ব্যবহার করে বিশ্বের জ্ঞানভা-ার থেকে তাদের পছন্দের এবং আগ্রহের বিষয়গুলো পড়তে পারে। সব রকম বিষয়বস্তু পড়ানো স্কুল ও শিক্ষকের দায়িত্ব নয়, তা সম্ভবও নয়। তাছাড়াও মানুষের জ্ঞানভা-ার দিনে দিনে বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হচ্ছে এবং এটি বাড়তেই থাকবে।
এখন আসা যাক নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে। আমাদের মতো শিক্ষা নিয়ে কাজ করা, গবেষণা করা, চিন্তা করা ব্যক্তিদের প্রধান মত ছিল-               
প্রাথমিক স্তরের শেষে এবং ক্লাস এইটের শেষের যে পাবলিক পরীক্ষা দুটি অনাবশ্যকভাবে ছিল, সেগুলো তুলে দেওয়া।
১. পরীক্ষা কমিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা দ্বারা শিক্ষার্থী ক, খ, গ, ঘ- এমন মানে ভাগ হবে। এভাবে তাদের শেখার মান নির্ধারণ করে তারা এক শ্রেণি থেকে পরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে।
২. মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (ঝঝঈ)-এর দশটি বিষয়ের মধ্যে প্রধান ৫টি বিষয়ের ওপর পাবলিক পরীক্ষা হবে। বাকি ৫টি বিষয় ধারাবাহিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে তাদের মান নির্ধারণ করা হবে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাধ্যমিক এসএসসি পরীক্ষার নির্ধারিত বিষয় ৫টি ছিলÑ বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান। সিদ্ধান্তের পর একটি নেতিবাচক গুজব তৈরি ও প্রচার করা শুরু করেছে একটি ধর্মজীবী দল এই বলে যে, নতুন শিক্ষাক্রম ধর্ম শিক্ষাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যা অসত্য।
এই বাস্তবতা বিবেচনায় বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী শিখন-প্রয়োজনকে বিবেচনায় নিয়ে পাঁচটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত যথার্থভাবে নেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশে বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ের পাশে ধর্ম শিক্ষা নামে কোনো বিষয় মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা উচ্চ শিক্ষায় নেই। ভারতেও নেই। তারপরও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে ‘ধর্ম শিক্ষা’ বিষয় হিসেবে শিক্ষাক্রমে অবস্থান করছে। সেটি সামাজিক এবং এ দেশের শিক্ষার দীর্ঘ ইতিহাসকে বিবেচনা করেই রাখা হয়েছে। তবু মানতেই হবে- বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির, জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে ধর্ম শিক্ষা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর নিজ ইচ্ছায় পরিবারেই অনুশীলন করার কথা।

স্মরণ রাখা দরকার- মানুষ জ্ঞান অর্জন করে তিন উপায়ে। প্রথমত, অনানুষ্ঠানিকভাবে। অর্থাৎ বাড়িতে বাবা-মা, প্রতিবেশী, সমাজের নানা আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব, সাংস্কৃতিক কর্মকা- থেকে পৃথিবীর সব দেশের সব মানুষ ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানসহ নানা বিষয় শেখে। দ্বিতীয়ত, মানুষ শেখে আনুষ্ঠানিকভাবে। অর্থাৎ, শিক্ষা গ্রহণের জন্য সরকার ও বেসরকারিভাবে শিক্ষা উদ্যোগী ব্যক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে সারাদেশের শিশুদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা দেওয়ার যে ব্যবস্থা করেছে, সেটিই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এটির প্রধান বৈশিষ্ট্য, এটি সুনির্দিষ্ট আইন ও নিয়মে বাঁধা। যেমন- শিশু পাঁচ বছর বয়সে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হবে, ৬ বছর বয়সে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির পাঠ শুরু করে ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করবে ১০ বছর বয়সে।

স্কুলের পাঠ্য বিষয়, পিরিয়ড বা পাঠ ঘণ্টা বা শিখন সময়, স্কুল শুরুর ও শেষ হওয়ার সময়, বার্ষিক ছুটি- সবই থাকে পূর্বপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট। এরকমই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিয়মবদ্ধ। এসবের পাশে মানুষ উপানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং গ্রহণ করছে। যেমন- যে কোনো বয়সে যে কোনো ব্যক্তি কোনো পেশাগত প্রশিক্ষণ নিতে পারে। কম্পিউটার, দর্জিকাজ, কৃষিকাজ, সূচিশিল্প, নকশা-ফুল তোলা, কাঁথা বুনন, মৌ চাষ, হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল পালন, মাছচাষ, ফলচাষ, এমনকি কাগজের ঠোঙ্গা বাননো, ঘুড়ি বানানো ইত্যাদি হাজার রকমের পেশাভিত্তিক স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ ও ধারার শিক্ষা নিয়ে গড়ে উঠেছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা।

অনেক বেসরকারি সংস্থা সাক্ষরতা শিক্ষা দিচ্ছে স্থানীয় স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের। এটিও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রত্যেক ধারার প্রত্যেক পেশার প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষাক্রম, পাঠ্যবিষয়বস্তু, পাঠ্যবই, মড্যুল, লিফলেট, বুকলেট, চার্ট শিক্ষার্থী বা প্রশিক্ষণার্থীদের নির্দিষ্ট যোগ্যতা, দক্ষতা অর্জনের জন্য তৈরি করা থাকে। প্রশিক্ষণ শেষে থাকে মূল্যায়নের ব্যবস্থা।
আমাদের সাধারণ শিক্ষা ধারায় নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময় বিষয়ের পাঠ্যবিষয়বস্তুর ভার হ্রাস করা এবং পরীক্ষার চাপ কমানোর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই বিবেচনায় এসএসসির প্রধান পাঁচটি বিষয়ের পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। অন্য সহশিক্ষাক্রমিক বিষয়, যেমন- জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতির কোনো প্রান্তিক পরীক্ষা ছিল না। স্মর্তব্য, পুরো পৃথিবীর নানা উন্নত দেশে এমন অনেক বিষয় পড়ানো হয়, যেগুলোর কোনো পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করা হয় না এবং এর প্রয়োজনও নেই। আমরা যেমন নানা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে নানারকম বই পড়ি, সংবাদপত্রের সংবাদ, কলাম, গল্প-প্রবন্ধ পড়ি এবং এগুলো থেকে আমরা অনেক উচ্চ মানের জ্ঞান অর্জন করি।

কিন্তু এগুলো থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের কোনো মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে না- এটা পাঠক সহজেই উপলব্ধি করেন। এগুলো পাঠ করে আমরা নিজস্ব আগ্রহে সেগুলো থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান ও দক্ষতা শিখি, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ আয়ত্ত করি। নিজেদের আমরা আরও বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবোধসম্পন্ন, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক মানুষে পরিণত করি। এ সবের কোনো মূল্যায়নের প্রয়োজন নেই।
জানতে পারলাম, এই পরীক্ষাহীন, শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়নের জন্য রাখা এই বিষয়গুলো, যেগুলোর অধিকাংশ হাতে কলমে শেখার বিষয়, সেগুলোরও পরীক্ষা হবে। এসব পরীক্ষা কিভাবে হবে, বুঝতে পারলাম না। ধর্ম শিক্ষা মুখস্থ বিদ্যানির্ভর। এটি পুরনো পদ্ধতির প্রশ্নের মাধ্যমে মুখস্থ বিদ্যার পরীক্ষা হবে। কিন্তু কম্পিউটার বিজ্ঞান, সংগীত, নৃত্য, নাটকাভিনয়, জীবিকা শিক্ষা- এসবই তো হাতে কলমে শিখতে হয়। এসব বিষয়ের ওপর খাতা-পেন্সিলের পরীক্ষা, তাও আবার লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত প্রহসনে পরিণত হবে না তো? এ পরীক্ষাগুলো অহেতুক সময় ক্ষেপণ করবে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের জন্য অনাবশ্যক চাপ সৃষ্টি করবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এও জানতে পারলাম, নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর অন্যান্য  স্টেক হোল্ডারদের এক মতবিনিময় সভায় এসব বিষয়ের পরীক্ষা গ্রহণের পক্ষে শিক্ষকসহ সবাই মত দেন। তাদের মতে, পরীক্ষা না নিলে বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। শিক্ষার্থীরা বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে শিখবে না। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন- পরীক্ষা না থাকলে শিক্ষকদের কোচিং বা টিউশন করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়- সম্ভবত এটিও বিবেচনায় আসতে পারে।

লেখক : শিক্ষাবিদ

×