ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আলোকিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

অমিত রায় চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ২২ নভেম্বর ২০২২

আলোকিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি উচ্চারিত হলেই প্রাচ্যের জনমানসে ভেসে ওঠে নালন্দা, তক্ষশীলার ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি উচ্চারিত হলেই প্রাচ্যের জনমানসে ভেসে ওঠে নালন্দা, তক্ষশীলার ছবি। জ্ঞানচর্চার এসব সারস্বত ঐতিহ্য, সৃজনশীল চিন্তার এমন ধ্রুপদী কেন্দ্রগুলো জ্বলজ্বল করে ওঠে। জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি ও ভাবনার কাঠামোয় সভ্যতাগুলোর মিল হয়ে ওঠে বেশ স্পষ্ট। বিশ্বসভ্যতার শুরু থেকে যে জ্ঞানের মশাল পথ দেখিয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বসভায় ইউরোপ বা আমেরিকার যে শ্রেষ্ঠত্ব, তার মূলেও আছে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞানসৃষ্টি ও তার প্রসারের জন্য একদা বিরান এ জনপদ এখন জ্ঞান বিতরণের তীর্থপীঠ। আলোর রেখায় সভ্যতার যে দূরন্ত জয়রথ ছুটে চলেছে তার মূলেও জাদুর কাঠি নেড়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা একটি দিন ২৫ নভেম্বর। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় এই দিনেই। সালটি ছিল ১৯৯১। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিলে প্রথমেই মুগ্ধ হতে হবে লেখাপড়ার একটা চমৎকার পরিবেশ দেখে। এমন শান্ত, স্থিতিশীল, নিরুপদ্রব পরিবেশ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সময় ও চাহিদার সঙ্গে মানানসই এমন নানা বিষয় নিয়ে ঝাঁক ঝাঁক শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করছে। শিক্ষার এমন আয়োজনই হয়তো দেশের মেধাবী সন্তানদের দলে দলে আকৃষ্ট করছে। গবেষণার অতি উচ্চমান শুধু দেশে নয়, উন্নত বিশ্বেরও নজর কেড়েছে।
স্বাধীনতা ও দারিদ্র্যের মাঝে যোগসূত্র দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর গরিবির এই শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সিঁড়ি হচ্ছে শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল-নিকট ভবিষ্যতে চাকরির ব্যাকরণ পাল্টে যাবে। জ্ঞান ও প্রযুক্তির দখল থাকবে যার হাতে, সময়ের কর্তৃত্বও চলে যাবে তার কাছে। প্রযুক্তিনির্ভর মানসম্পন্ন শিক্ষায় তিনি সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন দেশের গোটা প্রজন্মকে। যারা পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে। ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে তাই মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষাদর্শন প্রতিফলিত। আর সেখান থেকেই সঞ্চার ঘটে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রƒণ।
শিক্ষার মান নিয়ে যখন চারপাশে দীর্ঘশ্বাস, দক্ষতার সমকালীন চাহিদা আর জোগানের মাঝে বিস্তর ফারাক কিংবা জ্ঞান সৃষ্টির প্রক্রিয়া ঘিরে যখন দেশব্যাপী অস্বস্তিÑ ঠিক তখনই সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অনেক সম্ভাবনা অনেক প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের ডালি সাজিয়ে। শিক্ষার অভিজাত বলয়ে প্রবেশের সর্বজনীন আকাক্সক্ষা ছিল। কিন্তু কে ভেবেছিল-১৯৮৭ সালে যে বিদ্যাপীঠ যাত্রা শুরুর সংকেত পায়, তা এত অল্প সময়ে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা কিংবা ব্যবস্থাপনায় শুধু দেশে নয়, উন্নত বিশ্বেরও নজর কেড়ে নেবে? ময়ূর নদীর পাশে প্রকৃতি যেন নিজের হাতে এ ক্যাম্পাসকে ভরিয়ে রেখেছে অপরূপ কারুকাজে। ‘লার্ন, লিড অ্যান্ড লিভ’-এই সেøাগানকে ধারণ করে ছুটে চলেছে মাতৃভূমিকে আলোকিত করার সংকল্পে।

প্রতিষ্ঠাকাল বিবেচনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা নবম। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হলেও শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি গন্তব্য ঠিক করে নিয়েছিল। প্রতিজ্ঞা ছিল প্রথাগত রাজনীতির কলুষ কিংবা সেশন জট কখনই এর যাত্রাপথে বিঘœ ঘটাবে না। পাঠ্যক্রমে অর্থনীতি, ইতিহাস, সভ্যতা, ভাষা, সাহিত্য, আইন এমনকি চারুকলা অনুষদ থাকলেও বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি পক্ষপাত বেশ বোঝা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি স্কুল (অনুষদ), ২৯টি ডিসিপ্লিন (বিভাগ) এবং ২টি ইনস্টিটিউট আছে। কলা-মানবিক স্কুলে ইংরেজি, বাংলা এবং ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন। জীববিজ্ঞানে আছে অ্যাগ্রো-বায়ো-জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, এনভায়রনমেন্ট-ফিশারিজ-মেরিন রিসোর্সেস, ফরেস্ট্রি-উড, ফার্মেসি, সয়েল-ওয়াটার-এনভায়রনমেন্ট ডিসিপ্লিন। ব্যবস্থাপনায় বিবিএ ও হিউম্যান রিসোর্সেস।

বিজ্ঞান-প্রকৌশল-প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুলে আছে আর্কিটেকচার, আরবান অ্যান্ড রুরাল প্ল্যানিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রনিক অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত, পদার্থ, রসায়ন এবং পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিন। সামাজিক বিজ্ঞান স্কুলে রয়েছে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা। চারুকলায় আছে ড্রয়িং অ্যান্ড পেন্টিং, প্রিন্টমেকিং ও ভাস্কর্য ডিসিপ্লিন। শিক্ষা স্কুলের আওতায় আছে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট।
অভীষ্ট ও ভাবনার বৈচিত্র্যে এ বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য। সুন্দরবন ও উপকূল নিয়ে বিশ্বে প্রথম এখানেই স্থাপিত হয় ইনস্টিটিউট ফর ইনটিগ্রেটেড স্টাডিজ অন দ্য সুন্দরবন। পরিবেশবান্ধব গ্রিন ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার জন্য চলছে সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প। সেই সঙ্গে গ্রিনহাউস নির্মাণের উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি। দেশের প্রথম সয়েল আর্কাইভও এখানেই প্রতিষ্ঠিত। একাডেমিক এক্সেলেন্সের জন্য নিরন্তর কাজ করছে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাশিউরেন্স সেল। কারিকুলাস এবার যুক্ত হয়েছে আউটকাম বেজড এডুকেশন। লক্ষ্য-প্রথাবদ্ধ ছক থেকে বেরিয়ে প্রয়োজনমুখী শিক্ষা। বিশ্বজনীন শিখন প্রক্রিয়ার সঙ্গে অভিযোজন।

অনলাইনে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ফিডব্যাক নেওয়ার বন্দোবস্ত। কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে ইউনিভার্সাল টেস্টিং মেশিন, আরটি-পিসিআর ল্যাবসহ আধুনিক মানের গবেষণা সহায়ক নানা যন্ত্রপাতি। প্রস্তুত হচ্ছে ইনোভেশন হাব। বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে স্মার্ট ক্লাসরুম সক্রিয়। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ওয়াইফাই কর্ণার প্রাণবন্ত। পর্যাপ্ত ই-বুক আর অটোমেশন লাইব্রেরিকে যে আরও সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় করে তুলছে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।  
পাঁচ শতাধিক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। ৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে তারা অনাগত সময়ের জন্য তৈরি করছেন। শিক্ষকদের এক-তৃতীয়াংশই পিএইচডি। শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত ১:১২, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড উত্তীর্ণ। গেল ৩২ বছরে প্রায় ১৫ হাজার গ্র্যাজুয়েট কাজের বাজারে প্রবেশ করেছে। তারা দেশে-বিদেশে সম্মানজনক পেশায় কর্মরত। গবেষণা কার্যক্রমে শিক্ষকদের প্রণোদিত করতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকদের ৫ শতাধিক গবেষণা নিবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত শক্তি ও সামর্থ্যরে উৎসকে চিনে নেওয়া যায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে শিক্ষকদের নানা উদ্ভাবনী সক্ষমতার প্রমাণ মিলেছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাবিষয়ক  সমঝোতা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউভুক্ত দেশ, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য শিক্ষকরা বেশি সংখ্যায় স্কলারশিপ পাচ্ছেন। শুধু শিক্ষক নয়, গবেষণা সহায়তার আওতায় শিক্ষার্থীদেরও আনা হয়েছে। মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ের অনেক গবেষককে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে নবীন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজকে যুগোপযোগী করে গবেষণার গুণগত মানবৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দর্শনেই নিহিত ছিল পিছিয়ে পড়া মানুষকে এগিয়ে নেওয়ার সংকল্প। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই সামাজিক সমতার এই আকাক্সক্ষা জাগ্রত করেছিল। সেই মহান ঐতিহ্য থেকে এই প্রতিষ্ঠান বিচ্যুত হয়নি। ফটকে পা রাখতেই চোখে পড়বে জাতির পিতার সৌম্যদর্শন মুখচ্ছবি, জাতীয় চার নেতা, অগণিত শহীদ, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিকদের অমলিন স্মৃতিচিহ্ন। মূল্যবোধের গভীরে থাকা এসব অভিজাত অনুভবই দেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ বাড়িয়ে দেয়।

প্রত্যাশা জাগে, বিশ্ববিদ্যালয় যেন জ্ঞানসৃজন ও মুক্তবুদ্ধির চারণ ভূমিতে পরিণত হয়। যে শিক্ষা নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা করে, মানুষকে স্বার্থপর করে- সে শিক্ষাকে নির্বাসন দিতে হবে। যে শিক্ষা মানুষকে ক্ষুদ্র হতে বৃহৎ করে, মনকে মুক্ত করে সে শিক্ষার পরিচর্যা কেন্দ্র হোক বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষতা ও জ্ঞানসৃষ্টির কারিগর হয়ে উঠুক পদ্মাপারের শ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠ।

লেখক : ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

×