ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রসঙ্গ ইসলাম

মিথ্যা ও প্রতারণা পরিহারে মহানবীর (স.) বাণী

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ৬ অক্টোবর ২০২২

মিথ্যা ও প্রতারণা পরিহারে মহানবীর (স.) বাণী

প্রসঙ্গ ইসলাম

খাতামুন্নাবীয়্যিন বা সর্বশেষ নবী সায়্যেদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য নবী রাসূলগণের ন্যায় কোন নির্দিষ্ট কওম, অঞ্চল কিংবা কোন নির্দিষ্ট জনপদের মানুষকে হিদায়ত দান করার জন্য পৃথিবীতে তাশরীফ আনয়ন করেননি। তিনি পৃথিবীতে তাশরীফ এনেছেন সমগ্র মানবজাতির জন্য তথা সমগ্র বিশ্ব জগতের জন্য রহমত ও করুণার আধার হয়ে। তিনি আবির্ভূত হন এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে যখন সমগ্র পৃথিবী অন্ধকার ও অজ্ঞতার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিল। আইয়্যামে জাহিলিয়াতের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল পৃথিবী। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন : হে নবী! নিশ্চয় আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীস্বরূপ, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর প্রতি আহ্বানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে।-(আহযাব: ৪৫-৪৬)।
তিনিই বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে আলোর সন্ধান দিয়েছেন মানুষের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে সমাজকে উপহার দিয়েছেন নির্মল ও নবতর জীবনধারা। আজ আমরা ্এখানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজের এক কল্যাণমূলক কতিপয় বিষয়ের তাৎপর্য ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করব। সত্যবাদিতা ইমানের অন্যতম প্রধান শর্ত। সত্য অন্ধকার থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার করে সোজা সরল পথে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি আলোর সন্ধান পায়নি তার কাছে ইহকাল-পরকাল কিছুই সুস্পষ্ট নয়।

সত্য সকল মানুষের মধ্যে সৎকর্ম করার অভ্যাস সৃষ্টি করে এবং জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, সত্য কথা বলা তোমাদের কর্তব্য। কেননা, ‘সিদক’ বা সত্য নেকির পথে পরিচালিত করে এবং নেকি জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। যখন মানুষ সত্য বলে এবং সত্য গ্রহণ করে, তখন আল্লাহর দরবারে তার নাম ‘সিদ্দিক’ বা সত্যবাদী হিসেবে লেখা হয়। মিথ্যার বিষয়ে তোমরা সতর্ক থাক। কেননা, মিথ্যা বদকর্মের দিকে নিয়ে যায় এবং বদকর্ম জাহান্নামে নিয়ে যায়। যখন মানুষ মিথ্যা বলে এবং মিথ্যা গ্রহণ করে তখন আল্লাহর কাছে তার নাম মিথ্যাবাদী হিসেবে লেখা হয়।-(বুখারী, মুসলিম)।
যেসব ব্যবসায়ী আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর বিশ্বাস করেন, হারাম-হালাল মেনে চলেন, ইসলামে অবশ্য পালনীয় জিম্মাদারী পালন করেন এবং ব্যবসাবাণিজ্যে সততা ও আমানতদারীর পরিচয় দেন, বাণিজ্যিক লেনদেনে ধোঁকা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় গ্রহণ করেন না সে সব ব্যবসায়ী মহান আম্বিয়া, শুহাদা ও সিদ্দিকীনের (রা.) দলভুক্ত হবেন। সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ  (স.) বলেছেন, পরকালে সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী আম্বিয়া সিদ্দিকীন ও শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।-(তিরমিজি)।
ইসলামের বিচার ব্যবস্থা ইনসাফভিত্তিক। তাই ভাল কাজ করলে যেমন পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে, তেমনি মানুষের হক নষ্ট করলে, মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দিলে তারও শাস্তির বিধান রয়েছে। উপরোক্ত হাদিসে সততা আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে যে সমস্ত ব্যবসায়ী ব্যবসা পরিচালনা করবেন তাদের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে।

আবার সততা, ন্যায়-ইনসাফ এবং আমানতদারীর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা না করলে আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট হয়, বহু সংখ্যক মানুষের হক বিনষ্ট হয়। তাই আল্লাহপাক অসৎ এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বদকার হিসেবে কেয়ামতের দিন উঠাবেন এবং আযাব দান করবেন। নবী করীম (স.) বলেছেন, আল্লাহ ভীরু নেককার ও সৎ ব্যবসায়ী ছাড়া সকল ব্যবসায়ীকে বদকার হিসেবে কিয়ামতের দিন উঠানো হবে।- (তিরমীযি, ইবনে মাযা)।
দুর্বলতা মানুষের সহজাত। মু’মিন ব্যক্তি তার ব্যতিক্রম নন। মু’মিন ব্যক্তি নিজের দুর্বলতার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু দুটো অভ্যাস মু’মিনের স্বভাব বহির্ভূত। মু’মিন ব্যক্তির যত অধঃপতনই হোক না কেন, তিনি মিথ্যাবাদী ও খিয়ানতকারী হতে পারেন না। মিথ্যা ও খিয়ানত ইমানের বিপরীত কাজ। আর তাই নবী করীম (স.) বলেছেন, মু’মিনের সকল অভ্যাস থাকতে পারে। কিন্তু মিথ্যা ও খিয়ানত থাকতে পারে না।

আবু উসামা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, খিয়ানত ও মিথ্যা ছাড়া মু’মিন ব্যক্তির স্বভাবে প্রত্যেক অভ্যাস থাকতে পারে।-(আহমদ ও বায়হাকী)। মিথ্যা সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে আজ সমাজে আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে মানুষ মানুষের প্রতি কত জুলুম করছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। এজন্য মিথ্যা সাক্ষ্যদানকে শিরকের সমপর্যায়ের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
মিথ্যা সাক্ষ্যদানকে শিরকের সমপর্যায়ভুক্ত করার অর্থ হলো, এই অপরাধ শিরকের অপরাধের মতো মারাত্মক ও ক্ষমার অযোগ্য। মিথ্যা সাক্ষ্যদানের দ্বারা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করার কারণে আল্লাহ মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীর প্রতি অত্যধিক নারাজ ও অসন্তুষ্ট হন। যেরূপ শিরককারীর প্রতি আল্লাহ নারাজ, সেরূপ মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীর প্রতিও তিনি নারাজ ও অসন্তুষ্ট। একবার রাসূলুল্লাহ (স.) ফজরের নামাজ পড়লেন এবং নামাজ শেষ হওয়ার পর দাঁড়িয়ে বললেন, মিথ্যা সাক্ষ্যদান ও আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা সমপর্যায়ের করা হয়েছে। তিনি তিন বার তা বললেন।-(আবুদাউদ ও ইবনে মাযা)।
যার অন্তরে আল্লাহ ও আখেরাতের ভয় রয়েছে, সে কখনও আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করতে পারে না এবং শপথের মাধ্যমে অপর ভাইকে তার হক থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। যে এ ধরনের নিকৃষ্টতম কাজ করে, সে একসঙ্গে তিনটি অপরাধ করে। মিথ্যা বলা, অসঙ্গত কাজে  আল্লাহর নাম ব্যবহার করা এবং অন্যায়ভাবে অপর ব্যক্তিকে সম্পদ ও ইনসাফ থেকে বঞ্চিত করা।

মিথ্যা শপথের দ্বারা অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে কুষ্ঠ রোগী হিসেবে বিকৃত অঙ্গ নিয়ে হাজির হবে। বিখ্যাত সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে মিথ্যা হলফ করে কোন মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করে সে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় মোলাকাত করবে যে, তিনি তার ওপর ভয়ানক রাগাম্বিত থাকবেন।-(বুখারী, মুসলিম)।
ইসলাম চরিত্র গঠনের বিষয়ে শিশু বয়স থেকেই প্রধান্য দিয়েছে। কেননা, শিশুদের মন অনুকরণশীল।

তারা যা দেখে বা শুনে থাকে সেটাই হুবহু তাদের কচি মনে প্রভাব বিস্তার করে। এজন্য পারিবারিক জীবনে পিতা, মাতা, ভাই, বোন ও পরিবারের অন্য সদস্যদের (বিশেষ করে যারা শিশুর সান্নিধ্যে থাকেন, কাছাকাছি থাকেন) আদর্শ  চরিত্রের অধিকারী হওয়া উচিত। আমরা অনেক সময় হাসি-তামাশা বা খেলার ছলে মিথ্যা বলে থাকি। বাচ্চাদের জিদ থামানোর জন্য মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে থাকি। এগুলো মোটেই ঠিক নয়। কেননা, ছেলেমেয়েরা পিতা-মাতাকে অনুসরণ করে। যেমন নরম কাদায় ছাপ পড়লে মাটি শুকিয়ে গেলে হুবহু ছাপটি দেখা যায়, তেমনি পিতা-মাতার আচরণ ছেলেমেয়েদের মাঝে সরাসরি কার্যকর হয়।

তাই তাদের সঙ্গে হাসি-তামাশার ছলেও মিথ্যা কথা বললে তারা মিথ্যা শিখবে এবং ধীরে ধীরে মিথ্যা বলা তাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়াবে। এভাবে বাচ্চাদের মিথ্যা শিখানোর জন্য পিতা-মাতার গুনাহ হবে। বাচ্চাদের কোন কিছু দেয়ার কথা বলে তা তাদেরকে না দেয়াও এক ধরনের ওয়াদা খেলাফী। তাই নবীজী হযরত মুহাম্মদ (স.) বাচ্চাদের সঙ্গে মিথ্যা বলতে বারণ করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী করীম (স.) আমাদের ঘরে বসেছিলেন।

আমার মা আমাকে ডাকলেন এবং বললেন আস তোমাকে কিছু দিব। নবী করিম (স.) বললেন, তাকে তুমি কি দিতে চেয়েছ? আমার মা বললেন, আমি তাকে খেজুর দিতে ইচ্ছা করেছি।নবী করীম (স.) তাকে বললেন, সাবধান যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে, তাহলে তোমার আমলনামায় একটা মিথ্যা লিখা হতো।-(আবু দাউদ, বায়হাকী)।
কোন রকম যাচাই না করে শোনা কথা অন্যের নিকট বলা বিপজ্জনক। মিথ্যা, গিবত, অপবাদ বা শত্রুর উদ্দেশে প্রণোদিত প্রচার-প্রচারণা শোনা কথার অন্তর্ভুক্ত হলে তা কোনভাবেই অন্যের কাছে বলা যাবে না। যে এ ধরনের কথাবার্তা অন্যের কাছে পৌঁছায় সে মিথ্যাবাদী, গিবতকারী এবং অপবাদকারী সমপর্যায়ভুক্ত। কারণ মিথ্যার প্রচার মিথ্যা, গিবতের প্রচার গিবত এবং অপবাদের প্রচার অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়।

সত্য মিথ্যা যাছাই না করে শোনা কথা অন্যের কাছে পৌঁছানো মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত এবং গুনাহের কাজ। অবশ্য শিক্ষামূলক, আদর্শমূলক বা উৎকৃষ্ট শোনা কথা অপরের কাছে বলা পাপ নয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সাওয়াবও বটে। সাহাবী হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কোন মানুষের মিথ্যা বলার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে ফেলে।-(মুসলিম)। আল্লাহ আমাদের প্রিয় নবী হযরত রাসূলে করীম (স.) ও তাঁর প্রিয় সাহাবীদের আমল ও বাণী অনুসরণ করে ন্যায়নিষ্ঠ ও ভদ্রোচিত জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন।

লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব।
[email protected]

×