ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রসঙ্গ ইসলাম

মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ (স.)

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ (স.)

প্রসঙ্গ ইসলাম

হযরত আদম (আ.) থেকে ঈসা (আ.) পর্যন্ত সম্মানিত নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। সবাই কোন না কোন নির্দিষ্ট ভূখ- অঞ্চল, গোত্র বা দলের হেদায়েতের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দীর দিকে পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে আদম সন্তান। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জনজীবনেও পরিবর্তন দেখা দেয় দ্রুত। জনজীবনে নেমে আসে অশান্তি অরাজকতা। আইনশৃঙ্খলার আনুগত্য বোধ ছিল মানুষের অজানা। গরমযঃ রং ৎরমযঃ’- জোর যার মুল্লুক তার, এমনটি হয়ে ওঠে জীবন চলার পাথেয়। ফলে হত্যা, হানাহানি, রাহাজানি ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। সমাজের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও তাওহীদের পরিবর্তে খোদাদ্রোহিতা ও অসামাজিকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পুরো দুনিয়ায় বিভীষিকাময় পরিবেশে প্রয়োজন দেখা দেয় কোন আঞ্চলিক বা গোত্রীয় নেতৃত্বের পরিবর্তে শক্তিশালী বিশ্ব নেতৃত্বের, যার মাধ্যমে পুরো জাহানে সমানভাবে আসবে শান্তিÑসমৃদ্ধি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও তৌহিদের জোয়ার।
ইতিহাসের এই দাবির প্রেক্ষিতে আল্লাহ শান্তির দূত ও মুক্তির রাজপুরুষ হিসেবে পাঠালেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদকে (স.)। সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন ও ধর্মীয় অনুশাসন জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষের ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির বন্দোবস্ত করার জন্য একজন পরিচালকের যে সব গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, সবগুলোর সমাহার ঘটিয়েছেন মহান আল্লাহ হযরত রাসূলে পাকের জীবনে। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ পূর্ণতা দান করেছেন আল্লাহর শাশ্বত ধর্ম ইসলামকে। সুতরাং তিনিই সমগ্র দুনিয়ার একমাত্র আদর্শ। তারপর আর কোন মহাপুরুষ কিংবা মতাদর্শের প্রয়োজন নেই মানুষের পথ চলার জন্য। মহানবীই (স.) হচ্ছেন বিশ্ব মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ অনুকরণীয় আদর্শ, সর্বকালীন মুক্তির দিশারি, রাহমাতুল্লীল আলামীন। মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রচ্ছন্ন আদর্শ।
আজ সে মহান নেতা রাসূলে মাকবুল (স.) এর পয়দায়েশ ও ওফাতের পূতস্মৃতি বিজড়িত মাহে রবিউল আউয়াল আমাদের মাঝে চলমান। এদিনে আমাদের তাঁর চরিত্র বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব ও কৃতিত্বগুলো পুনঃপুনঃহৃদয়ঙ্গমকরত তাঁর প্রতি আরও অধিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা প্রদর্শন করে এগিয়ে যেতে হবে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের দিকে। তাহলেই আজকের বিশ্ব শান্তিÑপ্রগতি ও সমৃদ্ধির পানে ধাবিত হবে।
আমাদের উদ্দেশ করে আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর রাসূলের (স.) জীবনালেখ্যর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য প্রশংসিত আদর্শ। আর সে আদর্শের পূর্ণাঙ্গ রূপ আল কুরআন এখনও অক্ষত ও অবিক্রীত অবস্থায় আমাদের মাঝে বিদ্যমান। একদা জনৈক সাহাবা মা আয়েশার (রা.) খিদমতে হাজির হয়ে প্রিয় নবী (স.) এর চরিত্র সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। জবাবে উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা বললেন: ‘কুরআনে যে আদর্শ ও চরিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায় হযরতের চরিত্রও ঠিক অনুরূপ।’ ইসলামী দুনিয়ার ৪র্থ খলিফা হযরত আলীর (রা.) ভাষায়: আল্লাহর হাবীব নিজের চরিত্র হতে তিনটি জিনিস দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন- ১. তর্ক-বিতর্ক, ২. অপ্রয়োজনীয় কথা, ৩. কারও অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মুখে নিতেন না, প্রকাশ করতেন না কারও দোষ।’
নবীজী ছিলেন যেমনি বিনয়ী তেমনি মিষ্টভাষী। অতিরোগের মুহূর্তেও তিনি কোনদিন কাউকে কটু কথা বলেননি। তাঁর মধুময় ব্যবহারে শত্রুরাও মুগ্ধ হয়ে যেত। অসতর্ক মুহূর্তেও তাঁর মুখ হতে কোনদিন মিথ্যা কথা বের হয়নি। সত্যবাদিতার জন্যই আরববাসীরা তাঁকে ‘আল আমীন’ ‘আস সাদিক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
অভাবগ্রস্তকে তিনি কখনও হতাশ করেননি। নিজে না খেয়েও তিনি গরিব, মুসাফির ও ক্ষুধার্তদের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতেন। শত্রু-মিত্র, স্বজন-পরজন সবার জন্য তার করুণা সমানভাবে বর্ষিত হতো। বিপদের মুহূর্তে তিনি কোনদিন অসৎ পন্থা অবলম্বন করেননি বা নেননি কোন মিথ্যার আশ্রয়। হযরত ছিলেন দৃঢ় মনোবল এবং অসীম ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কঠিন বিপদের কথা জেনেও তিনি আল্লাহর একাত্ববাদের ঘোষণা দিতেন।
তিনি ছিলেন ক্ষমার মূর্ত প্রতীক। সন্তুষ্ট চিত্তে তিনি যে কোন চির শত্রুকেও ক্ষমা করতে পারতেন। মক্কা জয়ের পর তিনি প্রাণঘাতী শত্রুকেও ক্ষমা করে ক্ষমার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁর ক্ষমার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক মুইর কত সুন্দর বলেছেন, ঞযব গধমহধহরসরঃু রিঃয  যিরপয  গড়যধসসধফ  ঃৎবধঃবফ ধ ঢ়বড়ঢ়ষব যিরপয যধফ ংড় ষড়হম যধঃবফ ধহফ ৎবলবপঃবফ যরস ধিং ড়িৎঃযু ড়ভ ধফসরৎধঃরড়হ. একবার যুদ্ধ ক্ষেত্রে বলা হলো : হে আল্লাহর রাসূল (স.), আপনি যদি শত্রুদের জন্য বদদোয়া করতেন, তাহলে খুবই ভাল হতো।

প্রিয় নবী (স.) বললেন, আল্লাহ আমাকে রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন, বদদোয়া করার জন্য পাঠাননি (বুখারী মুসলিম)। হাদিসে আরও এসেছে, একব্যক্তি তাঁকে হত্যা করতে আসলো, বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল।  সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘এ ব্যক্তি আপনাকে হত্যা করতে এসেছে।’ সে লোক ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হলো। কিন্তু রাসূল (স.) তাকে এ বলে সান্ত¡না দিলেন, ‘ভয় করো না, ভয় করো না, তুমি আমাকে কতল করতে পারবে না।’ রাসূল (স.) তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
অশেষ গৌরব, সীমাহীন প্রতিপত্তি ও রাজৈশ্বর্যের মালিক হয়েও তিনি নিতান্ত সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। খেজুর গাছের পাতা আর কাদা মাটির তৈরি একটি বাড়িতে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হযরত (স.) বাস করতেন। উটের লোমের তৈরি একটি কম্বলই ছিল তাঁর বিছানা।
প্রিয় নবী (স.) ছিলেন আদর্শ সামাজিক ব্যক্তিত্ব। নিজেকে শ্রমিক বলতে তিনি গৌরববোধ করতেন। তিনি একাধারে প্রেমময় স্বামী, স্নেহময় পিতা, ধৈর্যশীল সংসারী, দরদি বন্ধু, সফল ব্যবসায়ী, মহান আইন প্রণেতা, দক্ষ শাসক, দূরদর্শী রাজনীতিজ্ঞ সর্বস্তরেই তিনি সকলের উর্ধে। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে পরাক্রমশালী শত্রুদের পরাজিত করে নিজেকে সাহসী যোদ্ধা বলে প্রমাণিত করেছেন। বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে নিপুণ সেনাপতিরূপে তিনি অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
সকল অবস্থাতেই হযরত নিজেকে সুখী মনে করতেন। কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েও খুশি মনে সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। বাস্তবিক নবীজীর তুলনা স্বয়ং তিনিই। মানুষ যা কিছু সুন্দর ও মহৎ কল্পনা করতে পারে, নবীজী একা ছিলেন জ্বলন্ত আদর্শ। নিঃসন্দেহে স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি তিনি। তিনিই আমাদের জন্য একমাত্র অনুকরণীয়, অনুসরণীয়, উসওয়াতুন হাসানাহ - সর্বোত্তম মহান আদর্শ।
মহানবী তাঁর চারিত্রিক পরশ পাথরের মাধ্যমে পুনর্গঠন করতে পেরেছিলেন এক সুন্দরতম সমাজ। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জগতে সংঘটিত করলেন এক সফল বিপ্লব। তাঁর নৈতিকতা, সভ্যতা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক সমস্যার সমাধানে তিনি যে বিধান দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে বহু অর্থনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে তিনি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, তার মাধ্যমে আজ অবধি দুনিয়ার রাজনৈতিক চিন্তাধারায় অনেক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ইনসাফ ও আইনের যেসব মূলনীতি তিনি রচনা করেছিলেন, সেগুলো বিশ্বের বিচার ব্যবস্থা ও আইনতত্ত্বের চিন্তাধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে এবং এখনও এর প্রভাব নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ সকল প্রকার জুলুম-নিপীড়নের অবসান করে সমাজের বুকে সাময়িক চমক সৃষ্টিকারী সমুদয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতবাদের ওপর তিনি ইসলামের শাশ্বত আদর্শকে বিজয়ী করেছিলেন। বস্তুত এটাই ছিল মহানবীকে (স.) দুনিয়ায় প্রেরণে আল্লাহর পরিকল্পনা, ঈদে মিলাদুন্নবীর তাৎপর্য। আল্লাহ বলেন, তিনি সে সত্তা, যিনি রাসূলকে সত্য দীন ও হেদায়াতসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে সকল ধরনের মতাদর্শের ওপর ইসলামী আদর্শকে বিজয়ী করতে পারেন (আল কুরআন)।
মহানবী (স.) মানুষের মাঝে যে আদর্শের প্রবাহ সৃষ্টি করেছিলেন তা ছিল আল্লাহ প্রদত্ত ও নির্ভেজাল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর চরিত কথা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি স্থান, কাল ও সীমানার প্রভাবমুক্ত একজন বিশ্বনেতা, সার্বজনীন ও শাশ্বত আদর্শ। তাঁর আদর্শের উপযোগিতা সময় ও অবস্থার ব্যারিকেড ছিন্ন করে শতাব্দী ও সহস্রাব্দের সীমানা পেরিয়ে অগ্রসর হচ্ছে দেশ হতে দেশান্তরে- কাল হতে কালান্তরে।
তাই বিশ্বের সামাজিক বিশৃঙ্খলার এইদিনে রাজনৈতিক অস্থিরতার এইক্ষণে, অর্থনৈতিক জটিলতার এ যুগে মহানবীর চিন্তাধারা ও শিক্ষার বড় প্রয়োজন। তাঁর প্রচারিত আদর্শকে সমষ্টিগতভাবে আঁকড়ে ধরে বিশ্বকে নতুন করে গড়তে হবে। ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মহানবী (স.) এর চিরসুন্দর, চিরভাস্মর ও চির বিস্ময়কর আদর্শকে জীবনে সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আসতে পারে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি।
তিক্ত হলেও সত্য যে, যারা আমরা আজ সত্যিকারের মুসলমান বলে দাবি করি, দাবি করি নবী রাসূলের উত্তরাধিকারী হিসেবে, তারা আজ নবীর সে সার্বজনীন ও সর্বকালীন আদর্শ ও উপযোগিতাকে বেমালুম ভুলে বসেছি। আবার অনেকে ‘অন্ধের হাতি ধরার’ মতো নবী জীবনকে দেখেছি খ-িত রূপে। দলাদলি ও আন্তঃকোন্দলে আমরা সতত বিভক্ত আজ। তাই আমরা নিজেরাই পরিশুদ্ধি অর্জন করতে পারছি না। সুতরাং আসুন, রবিউল আউয়ালের এ পবিত্র দিনে আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে মুনাজাত করি, আল্লাহ পাক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের খ-িত অনুসরণ থেকে আমাদের হেফাজত করে নবীজীর পূর্ণাঙ্গ আদর্শ অনুসরণে নিজেদের দেহমন সবটুকুন সমর্পণ করার তৌফিক দিন এবং বাতিলের মোকাবেলা ও ইকামতে দীনের পথে সর্বস্ব ত্যাগের সাহস ও শক্তি দিন।

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

×