ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মদিনে দুফোঁটা চোখের জল

ড. মুহাম্মদ সামাদ

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

জন্মদিনে দুফোঁটা চোখের জল

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে প্রথম দেখি ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকা বিমানবন্দরে; আনন্দে-অশ্রুতে-বৃষ্টিতে আর মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসায় সিক্ত কান্নাকাতর ও গভীর বেদনার্ত শেখ হাসিনাকে। সেদিন মুক্তির নতুন বারতা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে বর্ষণসিক্ত লাখো জনতার সমাবেশে সেদিনের ভাষণে তিনি বলেছিলেন: ‘...আমি আপনাদের বোন হিসেবে, কন্যা হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে... বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালী জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ জাতির পিতা হত্যার বিচারের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন সেদিন। অতঃপর পাথর ছড়ানো পথে পথে তাঁর সংগ্রামী জীবনের নবযাত্রা।
সেই পথে কত বাধা-বিপত্তি, প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র, কারা নির্যাতন, বিদেশে থেকে মাতৃভূমিতে ফিরতে না-দেয়ার চক্রান্ত, অসংখ্যবার হত্যাচেষ্টা- শেখ হাসিনাকে দমাতে কী করেনি মুজিববিরোধী-স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি? কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দমবার ও মাথা নোয়াবার নেত্রী নন। পিতার মতোই যা কিছু তাঁর দেশ ও মানুষের মঙ্গলের জন্যে প্রয়োজনীয় তা-ই নিয়ে সর্বক্ষণ ভাবেন এবং কঠিন পরিশ্রম ও একাগ্র নিষ্ঠায় তা বাস্তবে রূপদান করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সামরিক দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে এনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির সরকারের নেতৃত্বদান; বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার; চার জাতীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাঙালী জাতিকে করেছেন কলঙ্কমুক্ত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশকে এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছেন। বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উচ্চশিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। বৃত্তি ও বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে নারী শিক্ষায় অংশগ্রহণ অভাবিতভাবে বৃদ্ধি করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে রাজনীতি-প্রশাসন-বিচার বিভাগ, সেনা-নৌ-বিমান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে সারা বিশ্বে অনুকরণীয় নজির সৃষ্টি করেছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বয়স্কদের বর্ধিত হারে ভাতার ব্যবস্থা করেছেন; জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কার্যক্রমের সম্প্রসারণ করেছেন। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীর আওতায় হতদরিদ্র মানুষের জন্য বিধবা ভাতা; প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। তৃতীয় লিঙ্গের অসহায় মানুষদের উন্নয়ন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং কৃষির যান্ত্রিকীকরণ-আধুনিকীকরণ করে খাদ্যে-আমিষে-পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশের আনাচে-কানাচে বনজ-ফলদ-ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন। আগামী একশ’ বছরের জন্য ডেল্টা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি-দর্শন হলো- ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারোর সঙ্গে বৈরিতা নয়’। পররাষ্ট্রনীতিতে সেই দর্শন অনুসরণ করে বিশে^র বিবদমান পরাশক্তিসমূহ এবং প্রতিবেশীসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্য ঈর্ষণীয়। উন্নত দেশসমূহের সহায়তায় আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি ও অবকাঠামোতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়ে তিনি বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপ্লব সাধন করেছেন। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রেরণ করেছেন। পায়রা-সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও রূপপুর পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করেছেন। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকায় মেট্রোরেল, সারাদেশে নতুন নতুন রেলপথ, এ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুতকেন্দ্রসহ বহু মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের জন্য কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন নিশ্চিত করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছরের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি করেছেন। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আলোকে ২০১৫ সালের আগস্টে ছিটমহলবাসীর দীর্ঘ দুঃসহ জীবনে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছেন। ২০২২-এর সেপ্টেম্বরের ভারত সফরে কুশিয়ারা নদীর পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছেন। প্রতিবেশী দেশসমূহের জন্য বাংলাদেশী পণ্যের ফ্রি ট্রানজিটসহ সকল পথে সংযুক্তির বিস্তার ঘটিয়েছেন।

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর শেখ হাসিনার উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ইউনেস্কো কর্তৃক ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ হেরিটেজ ডকুমেন্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্তি আমাদের জন্য পরম গৌরবের। তিনি হাজার বছরের আবহমান বাঙালী সংস্কৃতির বিকাশে ১৮৭৬ সালের ব্রিটিশ কালাকানুন- অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন; পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন, বাউল-সঙ্গীত, জামদানি ও শীতলপাটিকে ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড ইনটেঞ্জিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র তালিকাভুক্তিকরণের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বাঙালী সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ উন্মুক্ত ও অবারিত করেছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্বের একজন সৎ ও সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার-পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়ে আমাদের গৌরবান্বিত করেছেন।
পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা- ‘দেশে একজন মানুষও গৃহহীন, ভূমিহীন থাকবে না’ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সাল থেকে অদ্যাবধি দেশের পাঁচ লাখের অধিক পরিবারের জন্য দুই শতক জমির ওপর ঘরবাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন। গণমানুষের নেত্রী শেখ হাসিনার মমতামাখা হৃদয়ের ভালবাসায় আজ তারা এসব গুচ্ছগ্রামের পুকুরে মাছ, আঙিনায় সবজি, টিউবওয়েলের সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ নানান রঙের পাকা ঘরবাড়িতে বসবাস করছেন। সঙ্গে স্কুলে পড়ালেখা আর খোলা চত্বরে ছুটোছুটির আনন্দ নিয়ে শিশুদের বেড়ে উঠতে দেখে এখন আনন্দে দুচোখ জলে ভরে যায়।
করোনার বৈরী সময়ে কৃষি-শিল্প-স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি খাতে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা ও বরাদ্দ দিয়ে জনমানুষের জীবন ও দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছেন; অনেক উন্নত দেশ এমনকি চীনের চেয়েও অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। দেশের দরিদ্র-অসহায় মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দিয়েছেন। নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সহজলভ্য করেছেন। আমাদের দেশের কবি-শিল্পী-সাংবাদিক-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের সাধ্যমতো সহায়তা প্রদান করেছেন। এভাবে ক্লান্তিহীন ও নিরলসভাবে আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মহত্ত্ব ও মানবিক গুণাবলীর ওপর দু-এক কথা বলতেই হবে। তাঁর বিনয়ী-মিষ্টি স্বভাবে দেশে-বিদেশে সকলেই মুগ্ধ। বঙ্গবন্ধুর মতোই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের রোগে-শোকে-বিপদে-আপদে তাঁর দয়ার্দ্রচিত্ত যেভাবে ব্যাকুল হয়ে ওঠে, রাষ্ট্রের উচ্চাসনে বসা কারও কাছ থেকে তা আশা করা তো দূরে থাক- কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। শুধু রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট’-এর তহবিল থেকে দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীর সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষ করেছেন; অনেক পরিবারের ব্যয়ভার নিয়মিত বহন করছেন। কবি-লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের চিকিৎসা করানো; অসুখে অর্থ, ফলমূল-পথ্যাদি পাঠানো; কেউ মৃত্যুবরণ করলে বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সান্ত¡না দেয়া থেকে শুরু করে দাফন-সৎকারসহ সকল ব্যবস্থা নিজে তদারকি করা; পত্রিকায় খবর পড়ে অসহায় ভিক্ষুক-ভিখারিনীকে সহায়তা দেয়া; গোপনে বহুজনকে নিয়মিত অর্থ সহায়তা করে যাওয়া; হতদরিদ্র ও বিপদগ্রস্ত মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি তাঁর নিত্যদিনের মানবিক কাজের অংশ। এ ছাড়া জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তাঁর দায়িত্ববোধ ও প্রাণীকুলের প্রতি মায়া-মমতা অতুলনীয়।
প্রায় প্রতিদিনই জননেত্রী শেখ হাসিনার দরদি কণ্ঠে একথা শুনে ব্যথিত ও মুহ্যমান হই যে, তিনি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য পিতার মতো নিজের জীবন উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত। তিনি তো সকল কিছুই উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য, আমাদের জন্য। দেশের কল্যাণে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর দেয়া দায়িত্ব পালন করা; সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করা। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও বাঙালী সংস্কৃতির অস্তিত্বের প্রতীক আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, সফল রাষ্ট্রনায়ক ও সবার সুহৃদ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বাংলার মানুষের মুক্তিদাতা মুজিব পরিবারের অন্তহীন ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিনে কৃতজ্ঞতা ও দুফোঁটা চোখের জল ছাড়া কী আর দেয়ার আছে আমাদের!

লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ; প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়

×