ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সোনার বাংলা গঠনে বঙ্গবন্ধুকন্যা

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২৩:৫৩, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

সোনার বাংলা গঠনে বঙ্গবন্ধুকন্যা

.

শেখ হাসিনার জীবনকাল বা তাঁর শাসনকাল এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে অপরিচিত বা অচেনা কিংবা অজানা নয়। তার সৈনিকেরা তো বটেই, এমনকি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও জানেন তিনি কে, কি করেছেন বা করছেন ও বাংলাদেশকে তিনি কোন্্ উচ্চতায় নিতে চান। আজকের বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার নেতিবাচক পর্যালোচনা করতে গেলেও শেখ হাসিনার অর্জনকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগই নেই। আমরা সৌভাগ্যবান যে ২২ সালে তিনি তাঁর ৭৫তম জন্মবার্ষিকী পার করছেন। শুরুতেই তাঁর সুদীর্ঘ জীবন প্রত্যাশা করেই দুটো কথা বলতে চাই।
আমাদের প্রজন্মের কাছে তিনি অনেক বেশি পরিচিত। কারণ, আমরা তাঁর জীবনের সব ক্ষণই দেখেছি। নতুন প্রজন্মের মধ্যে যাদের কিছুটা বোঝার বয়স হয়েছে, তারা অন্তত তাঁর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ভূমিকা হয় দেখছে, না হয় পড়েছে। চোখের সামনেই দেখছে, অংশ নিচ্ছে বা নিজেই পরখ করে দেখছে। বিশ্বের সকল জাতিরই এমন একজন মানুষ থাকেন যারা তাদের ভুলে যাবার পথটা নিজেরাই রুদ্ধ করে রেখে যান। আমাদের শেখ হাসিনা সেই মানুষটি, যে মানুষটিকে জাতি তাঁর রূপান্তরের নেতৃত্ব, দক্ষতা, সক্ষমতা ও সফলতার জন্য কোনকালেই ভুলতে পারবে না। এ যাবতকালে তাঁর ২৮ বছরের শাসন বাংলার ইতিহাসে কেবল বিরল নয়, স্বর্ণযুগ। যখন আমরা তাঁর জীবনের হীরক জয়ন্তী পালন করছি তখন খুবই ছোট করে আমরা একবার তাঁর অবয়বটা দেখার চেষ্টা করতেই পারি।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ হাসিনার জন্ম। বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার জ্যেষ্ঠ কন্যা তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির এক সঙ্কটময় মুহূর্তে শেখ হাসিনার জন্ম। তাইতো নিজের মেয়েকে দেখতে আসার সুযোগটুকুও পাননি পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা নিজেই লিখেছেন, ‘আমার জন্মের সময় বাবা কলকাতায় পড়তেন, রাজনীতি করতেন। খবর পেয়ে দেখতে আসেননি।
বাবাকে কাছে না পেলেও মা ও দাদা-দাদির স্নেহ-আদরে চিরসবুজ প্রকৃতির মাঝে সাধারণ পরিবারের সন্তানের মতো তিনি টুঙ্গিপাড়ায় বড় হতে থাকেন। টুঙ্গিপাড়ায় এক পাঠশালায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন। সেখানে বাল্যশিক্ষা শেষ করে সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু এমপিএ নির্বাচিত হলে পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। প্রথমে তিনি পুরনো ঢাকার মোগলটুলির রজনী বোস লেনে বাসা ভাড়া নেন। পরে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচিত হলে ৩ নং মিন্টো রোডের সরকারী বাসভবনে ওঠেন।
১৯৫৬ সালে শেখ হাসিনা ভর্তি হন টিকাটুলির বিখ্যাত নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে। ৩য় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন জাতির পিতার পরিবার। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন শেখ হাসিনা।
১৯৬৭ সালে ঢাকার বকশী বাজারের ইন্টারমিডিয়েট গবর্নমেন্ট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজছাত্র সংসদের সহ-সভানেত্রী (ভিপি) পদে নির্বাচিত হন। তিনি এ কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি ছিলেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।  
১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৭৩ সালে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। কিশোর বয়স থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম. এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শেখ হাসিনা। বিয়ের কিছুদিন পর শুরু হয় বাঙালী জাতির ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। সারাদেশ আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে পড়লে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশাল বিক্ষোভ মিছিল  বের করেন।

রেজিস্ট্রার ভবনের গেট দিয়ে ফুলার রোড হয়ে মিছিলটি পুরনো কলা ভবনের (বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগ) দিকে এগিয়ে যায়। এই মিছিলের প্রথম দিকে প্ল্যাকার্ড হাতে ছিলেন শেখ হাসিনা। প্রতিবাদী  স্লোগান আর বিপ্লবী চেতনায় সেদিন ছাত্রসমাজ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠেছিল। মেডিক্যালের জরুরী বিভাগের সামনের রাস্তায় পুলিশ বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে মিছিলের ওপর। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। সাহসিকতার সঙ্গে সেখানেও পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন শেখ হাসিনা। সেদিন ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদ। শহীদ হন মতিউর। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে। ঢাকা হয়ে ওঠে মিছিলের নগরী। এভাবে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও শাসকগোষ্ঠীর গুলিতে কেউ না কেউ নিহত হতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক নিরাপত্তা হেফাজতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ১৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্রদের ওপর আবারও গুলি চালায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। সারাদেশ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনা এসব আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। আর পরিবারের সঙ্গে থেকে প্রহর গুনতে থাকেন বাবার মুক্তির। ছাত্র জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২  ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়  গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ না করা পর্যন্ত বঙ্গমাতার নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিনিধি হয়ে শেখ হাসিনাই ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। অনেক বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর বার্তা পৌঁছে দিতেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও শেখ হাসিনা আগে থেকেই জানতেন। আর সেই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য আড়াল থেকে নিবেদিত কর্মী হয়ে কাজ করেছেন শেখ হাসিনা।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই নির্বাচনে বাবা প্রার্থী হওয়ায় বাবার নির্বাচনী এলাকায় একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দিনরাত মাঠে কাজ করেন। আর এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি নির্বাচন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শেখ হাসিনা ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে গৃহবন্দী থাকেন। বন্দী অবস্থায় নিদারুণ দুঃখকষ্ট ও ভয়ঙ্কর আতঙ্কের মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিটি মুহূর্ত পার করেন। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই গৃহবন্দী অবস্থায় শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান ‘জয়’ এর জন্ম হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কারণে শেখ হাসিনার পড়াশোনায় সাময়িক ছেদ পড়লেও  দেশ স্বাধীনের পর তিনি নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে ইডেন কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ইতোমধ্যে ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর তাঁর কন্যা সন্তান পুতুলের জন্ম হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার কিছুদিন আগে ছোটবোন শেখ  রেহানাকে নিয়ে তিনি স্বামীর সঙ্গে জার্মানি চলে যান। জার্মানিতে থাকার কারণে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান। জার্মানিতে কিছুদিন থাকার পর স্বামী-সন্তানসহ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। শুরু হয় এক বেদনাবিধুর নির্বাসিত জীবন। প্রবাস জীবনে তিনি আগস্ট হত্যাকান্ডের বিচার ও দেশে সামরিক শাসনের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজনমত গঠনে প্রয়াসী হন।
ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন, মাত্র ৩৪ বছর বয়স তাঁর। দেশের মাটিতে পা দিয়ে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউর লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন  কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই  নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।’
    ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২  

লেখক :  তথ্যপ্রযুক্তিবিদ,  কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী
[email protected]

www.bijoyekushe.net.bd

×