ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ টিকে থাকবে কীভাবে

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ টিকে থাকবে কীভাবে

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ টিকে থাকবে কীভাবে

বারবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের মনে এই দুশ্চিন্তা ঘুরেফিরে আসে এবং প্রতি মুহূর্তে নষ্ট করে মনের শান্তি। বিশেষত বিগত দিনে দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধীদের কুৎসিত অপরাজনীতি গণতন্ত্রের সব রীতিনীতি ভঙ্গ করে জোট বেঁধে ২০০১-এ পুরোপুরি ’৭১-এর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও জামায়াতের অনুসরণে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চালানো হয় চরম নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুট, এলাকা ছাড়া করা, জীবিকাহীন করার অমানবিক প্রক্রিয়া। এমনকি ’৭৫-এর আগস্টে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক নির্দেশে সেনানিবাসে মুক্তিযোদ্ধা কয়েক হাজার সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসি-নির্যাতনের খবর জনগণের কাছে সেভাবে প্রকাশ না হওয়ায় দীর্ঘদিন জিয়ার পাকিস্তানী আদর্শ সম্বন্ধে জনগণ স্পষ্ট ধারণা পায়নি।

সর্বপ্রথম, ঐ ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জাতি বিএনপি ও জামায়াতের আদর্শের ঐক্য দেখে বিস্মিত হয় এই জেনে যে, এরা প্রকৃতপক্ষে এক ও অভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মৌল চেতনা-অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরও এত বড় দানবীয় হুমকি হয়ে উঠবে একদিন- এ কথা ’৭১-থেকে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময়ে এ দুই দলের প্রকৃত পরিচয় এর আগে জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়নি।

এখন আকস্মিকভাবে বিএনপি নেতা ফখরুলের কাছে পাকিস্তানী আমলের সুখ-সাচ্ছন্দ্যের তুলনায় আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান শাসনামলে সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন, যাকে পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ-বিশ্লেষক দলও অভাবিত বলে প্রশংসা করছেন, সেটি তাদের কাছে কোন উন্নয়নই নয় বলে মূল্য পায় না! এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের কট্টর সমালোচক ছিলেন, তিনি দীর্ঘদিন পর মাঠে নামলেন। সভায় পাশে বসালেন জামায়াত নেতাকে! বললেন- ‘আমার পাশে আছে জামায়াত।’

এর চাইতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এত অসম্মানিত হতে জনগণ আগে দেখেনি। বলা হয়- ‘মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার হয়, কিন্তু রাজাকার কখনও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না।’ ইতোমধ্যে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে যুদ্ধাপরাধীদের আদর্শপন্থী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরকারের প্রশাসনের নানা উচ্চপদে আসীন থেকে নানা সরকারবিরোধী কর্মকা- চালাচ্ছে বলে সংবাদ সূত্রে জানা গেছে। এ সংবাদে জনগণের স্মরণে পড়েছে সম্ভবত ২০০৭-এর সংঘটিত ‘উত্তরা ষড়যন্ত্র’ নামের একদল আমলার গোপন কার্যক্রমের কথা। ঐ ষড়যন্ত্রটি উদঘাটন করেছিল একদল অনুসন্ধানী সাংবাদিক। এটিও ছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগ বিরোধিতা, যার লক্ষ্য ছিল ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধিতার আরেকটি দিক হচ্ছে- প্রথমে শিবির বা জামায়াত, তারপর ছাত্রদল এবং তারপর ছাত্রলীগে বা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী একটি গোষ্ঠীর ক্রমেই বেড়ে ওঠা। এটি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলাদলির ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী আদর্শের অনুসারীরা তো সবসময় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাহী দলের ক্ষতি করতেই অনুপ্রবেশ করে থাকে। স্মরণে পড়ছে, তারেক রহমান লন্ডনে পলাতক থেকে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ-উপদেশ দিয়েছিল- ‘তোমরা এখন ছাত্রলীগ হয়ে যাও, ছাত্রদল থাকার দরকার নেই, সবাই ছাত্রলীগে ঢুকে পড়।’ অর্থাৎ সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে ওরা বের হবে- এমনটিই ছিল কৌশল। এর পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রিয় নেতা হত্যা করা ছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিশ্চিহ্ন করার অন্যতম প্রধান পদক্ষেপ।
দেশ এবং দেশের উন্নয়ন, শান্তি ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধীদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হচ্ছে- তালেবানী ধর্মান্ধ জঙ্গী গোষ্ঠীর জন্মদান এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা, আশ্রয়-প্রশ্রয় দান। তাদের ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ পন্থী রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, সংস্কৃতি কর্মী, অন্য ধর্মীয় নেতা, লালন-ভক্ত, সঙ্গীত শিল্পী-বাদ্যযন্ত্রী, যাত্রাপালার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ওপর হামলা ও হত্যা। এর বাইরে দেশের উন্নয়ন- সহযোগী বিদেশীদেরও জঙ্গীদের দ্বারা হত্যার শিকার করা হয়েছে।

কেননা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্মশত্রু তো ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী! তারা কিছুতেই বাংলাদেশের জন্ম মেনে নেয়নি এবং এখনও মেনে নিতে পারে না এ দেশের উন্নয়ন। বাংলাদেশের অতি উদার অসাম্প্রদায়িক শত শত লোক সঙ্গীতকার, গায়ক, পুঁথি-লেখক, যাত্রাপালা লেখক, অভিনেতা-অভিনেত্রী সবার যৌথ সৃষ্টি হাজার বছরের লোক-সাহিত্যকে এরা মান্য করে না। বরং সুযোগ পেলেই ধর্মান্ধ হেফাজতীদের, যারা জামায়াতীদের আদর্শ লালন করে, তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকে। অথচ বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাঙালী জাতি সর্বাধিক সম্মান লাভ করে তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য- নানা আচার অনুষ্ঠান ও লোকসঙ্গীতের অসাম্প্রদায়িক কথা ও সহজ সুরের সঙ্গীতের যাত্রাপালা ও পুঁথির জন্য।

বিদেশীদের কাছে আমাদের লোকসঙ্গীত ও লোকসাহিত্য এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত দিবসটি আজ বিশ্বের সব জাতির জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ঐদিন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে  ফেব্রুয়ারি’ গানটি সব জাতি গেয়ে থাকে। এটি আমাদের গৌরবান্বিত করে। বাঙালীর বর্ষবরণ উৎসব- পহেলা বৈশাখ তো ইউনেস্কোর বিশ^ হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
পাঠক, একটু পেছনে ফিরে গেলে স্মরণ করতে পারবেন- ২০১৩ সালে শাহবাগে ‘গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিষ্ঠা হয় তরুণ যুবশক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাদের উদ্যোগে। তারা ফিরিয়ে এনেছিল জাতির অসাম্পাদিত একটি বিশাল কাজ- ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী-দালাল-রাজাকারদের বিচারের দাবিকে। তাদের সর্বোচ্চ দ-ের দাবিকে তারা সবকিছুর ওপরে তুলে ধরে দেশে ও বহির্বিশ্বে। একই সঙ্গে তারা ফিরিয়ে এনেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রিয় প্রধান স্লোগান- জয় বাংলাকে।  পাঁচ মাসের মধ্যে তালেবানী ধর্মান্ধ হেফাজতের সশস্ত্র হামলা শুরু হয় গণজাগরণ মঞ্চের প্রগতিশীল তরুণ-তরুণীদের ওপর! আবারও সেই ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর আদর্শধারীরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাহী নতুন প্রজন্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় ২০১৩ সালে।
অবশ্য ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের শুরু হওয়া বিচার অব্যাহত রয়েছে। বড় বড় যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-বিএনপি নেতাদের ফাঁসি, যাবজ্জীবন দণ্ড হয়েছে। তবু বাস্তবতা হলো জামায়াত-শিবির-হেফাজত-আনসার আল ইসলাম- হরকত-উল-জিহাদ, জেএমবি হয়ে কতরকম জঙ্গী রূপ ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের শত্রু দল হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বহাল রেখে চলছে এখনও!
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন, মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা তার শত্রু যুদ্ধাপরাধীর হুমকি-হামলা মোকাবেলা করেই সারা জীবন চলতে থাকবে। যুদ্ধাপরাধী-মুক্ত স্বদেশ জনগণ ভেবেছিল এদের বিচারের মাধ্যমে তা শেষ হবে। কিন্তু শত্রুরা বারবার ডাইনির রক্তবীজ থেকে জন্ম নিচ্ছে। আর বারবার ছোবল দিচ্ছে দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বসীদের এবং বাঙালী সংস্কৃতিকে। বাঙালী সমাজে যুদ্ধাপরাধীর সন্তান যুদ্ধাপরাধী হবে, এটা ছিল কল্পনারও অতীত। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এমনটি হয়নি। কারণ, শুরুতেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছিল এবং ফ্যাসিবাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল পুরো ইউরোপে।কেউ এ রাজনীতি করলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল। ফ্যাসিস্টদের সরকারে ও প্রশাসনে প্রবেশ এবং রাজনীতি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবেই এই যুদ্ধাপরাধীদের উত্থান বন্ধ করতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তাঁর ও চার জাতীয় নেতা হত্যা, অগণিত মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দেশকে পাকিস্তানী ও ধর্মান্ধ আদর্শের দিকে নিয়ে গিয়েছিল পরবর্তী প্রত্যেকটি সেনা শাসক এবং বিএনপি-জামায়াত জোট। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের বেনিফিশিয়ারিরা বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা অব্যাহতভাবে করতে করতে এ প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ আজ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং বর্তমান অবস্থানে দাঁড়িয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে রক্ষা করাই বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম, সর্বোপরি জনগণের প্রধান কর্তব্য হয়ে আছে। এ কর্তব্য অসম্পাদিত থাকলে সেই ডাইনির রক্তবীজ থেকে আবারও শত শত, হাজার, হাজার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দানব-দানবীর জন্ম হবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা রূপকথার মাধ্যমে সত্যকে প্রকাশ করে গেছেন। জনগণকে তার সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ভুল করার আর কোন সুযোগ এখন নেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ

×